বাসস
  ১৯ জুন ২০২৫, ১৬:৩১
আপডেট : ১৯ জুন ২০২৫, ১৬:৩৬

ইয়ারজানের হাত ধরে পরিবারে স্বচ্ছলতা, বাবা-মায়ের মুখে হাসি

পঞ্চগড়, ১৯ জুন, ২০২৫ (বাসস) : রেনু বেগমের জীবন জুড়েই সংগ্রাম। মাত্র তিনমাস বয়সে মা’কে হারিয়েছেন, বেড়ে ওঠেছেন দুঃখে-কষ্টে। সংসার জীবনেও পাননি সুখের দেখা। পুরোদমে লড়াই করেছেন জীবন যুদ্ধে, দিনমুজুরের কাজ করে আগলে রাখতে হয়েছে স্বামী-সন্তান। নিজে মায়ের স্নেহ না পেলেও সন্তানের কাছে হয়েছেন মমতাময়ী মা। এভাবেই কেটে গেছে অনেকটা সময়। অবশেষে নাগাল পেয়েছেন সুখের। অবসান হয়েছে তার দীর্ঘ সংগ্রামী জীবনের। এই সুখের নাগাল ধরিয়েছেন তার ফুটবলার কন্যা।

রেনু বেগম জাতীয় নারী ফুটবল দলের গোলরক্ষক ইয়ারজান বেগমের মা। গত বছরের ১০ মার্চ নেপালের মাঠে অনুর্ধ্ব-১৬ নারী ফুটবল চ্যাম্পিয়নশিপে টাইব্রেকারে ৩-২ গোলে ভারতকে হারিয়ে বাংলাদেশ দল শিরোপা জেতার পর ব্যাপক আলোচিত হন ইয়ারজান। সেখানে অসাধারণ ক্রীড়া নৈপুণ্য দেখিয়ে সেরা গোলরক্ষকের স্বীকৃতি পান তিনি। এরপর উঠে আসে ইয়ারজানের মায়ের সংগ্রামী জীবন কাহিনী।

ইয়ারজান বেগমের বাড়ি পঞ্চগড় সদর উপজেলার হাড়িভাসা ইউনিয়নের খোপড়াবান্দি গ্রামে। তার বাবার নাম আব্দুর রাজ্জাক।

ফুটবল খেলার প্রতি ছোটবেলা থেকেই ঝোঁক ছিল ইয়ারজানের। এক সময় পঞ্চগড় টুকু ফুটবল একাডেমিতে অনুশীলন শুরু করেন। এতে বাবার উৎসাহ ছিল না, প্রতিবেশীরা অনেক সময় কটু কথা শোনাতেন। সে সব কথায় কান দিতেন না ইয়ারজান, কারণ তাকে একজন উৎসাহ দিতেন, তিনি হলেন মা রেনু বেগম।

রেনু বেগমের স্বপ্ন পূরণ হয়েছে। শেষ হয়েছে দিনমুজুরি পেশার। তার পরিশ্রম আর অনুপ্রেরণার প্রতিদান দিয়েছে মেয়ে ইয়ারজান। যেই রেনু বেগম ভাঙা ঝুপরি ঘরে রাত যাপন করতেন, বৃষ্টি এলে নির্ঘুম রাত কাটাতেন- সেই রেনু বেগমের মুখে এখন সুখের হাসি, চোখে আনন্দ অশ্রু। তার বড় পরিচয় ফুটবলার ইয়ারজানের মা। বাকী জীবন পার করতে চান এই পরিচয় নিয়েই।

রাজ্জাক-রেনু দম্পতি একসময় নতুন ঘরের স্বপ্ন দেখলেও ছিলোনা সাধ্য। তাদের বাড়িতে ছিলনা তেমন আসবাবপত্রও। এখন পেয়েছেন পাকা ঘর, সংসারে ফিরেছে স্বচ্ছলতা। তাদের দিন কাটছে সুখেই। বেড়েছে সামাজিক সম্মানও।

ইয়ারজানের বাবা আব্দুর রাজ্জাক শারীরিকভাবে অসুস্থ। কোন কাজ করতে পারেননা। ফলে পরিবারের একমাত্র উপার্জনক্ষম ব্যক্তি ছিলেন মা রেনু বেগমই। রেনু বেগমের উপার্জনেই চলতো তাদের সংসার। সম্পদ বলতে ছিলো তাদের কেবল ভিটেমাটি। সড়কের পাশের বাড়িটিতে ছিলো ছোট ছোট দুইটি ঘর। এরমধ্যে একটি ঘর ছিলো একেবারেই জরাজীর্ণ।

সম্প্রতি ইয়ারজানের বাড়িতে গিয়ে দেখা যায়, ভাঙা ঝুপরি ঘরের জায়গায় গড়ে ওঠেছে দৃষ্টিনন্দন রঙিন একটি পাকা ঘর। জেলা প্রশাসনের উপহারের এই ঘরটির নাম ‘ইয়ারজান নীড়’। বাড়িতে ছোট পরিসরে করেছেন গরুর খামার। মানুষের কৃষি জমিতে দিনমুজুরের কাজ ছেড়ে এখন গরু পালনে মনোযোগী হয়েছেন ইয়ারজানের মা রেনু বেগম।

রেনু বেগম বলেন, ‘মানুষের কৃষিজমিতে কাজ করে মেয়েকে বড় করেছি। দৈনিক ২৫০ টাকা মজুরি পেতাম। এরমধ্যে ১০০ টাকা দিতাম মেয়েকে, বাকী ১৫০ টাকা সংসারের অন্যান্য কাজে। খুব টানাপোড়নের সংসার ছিলো। জীবনে মায়ের ভালোবাসা পাইনি। ঈদের দিন গুলোতেও ভালো পোশাক, ভালো খাবার জুটেনি। আমার সব অপূর্ণতা পূর্ণ করেছে আমার মেয়ে ইয়ারজান। স্বপ্ন ছিলো- মেয়ে ভালো কিছু করবে, করেছে। যেদিন ইয়ারজান সেরা গোলরক্ষক হয়েছে, সেদিনই আমার সব কষ্ট দুর হয়েছে। ইয়ারজান নেপালের মাঠে যখন প্রথম খেলতে যায় তখন বাড়িতে টিভি ছিলোনা। কাজ থেকে বাড়িতে এসে মানুষের মোবাইলে মেয়ের খেলা দেখতাম। তখন কাজ না করলেতো খাবার জুটতোনা।’

ইয়ারজানের বাবা আব্দুর রাজ্জাক বলেন, ছোট থেকেই ফুটবলের প্রতি আগ্রহ ছিলো মেয়ের। তবে আমরা কখনো উৎসাহ দেইনি, মানুষও ভালো বলতোনা। তাছাড়া অনুশীলনে পাঠানোর মত ব্যবস্থাও ছিলোনা। কিন্তু মেয়ে এসবে তোয়াক্কা করতোনা। তাই সংসারের টানাপোড়ন উপেক্ষা করেই তাকে সাপোর্ট দিয়েছি। সবচেয়ে বেশি অবদান তার মায়ের। টুকু ফুটবল একাডেমিও অনেক সহযোগিতা করেছে। এখন আমার মেয়ে জাতীয় দলে খেলছে। মেয়ের সাফল্যে গর্বে আমার বুক ভরে গেছে। যখন মেয়ের বিষয়ে কেউ জানতে চায়, তখন খুব ভালো লাগে আমার।

আব্দুর রাজ্জাক আরও বলেন, আমি মেয়েকে কখনো ভালো পোশাক কিনে দিতে পারিনি, কিন্তু আমার মেয়ে এই ঈদেও আমাকে নতুন পোশাক কিনে দিয়েছে। ভালো খাবার খাইয়েছে। জীবনের সব দুঃখ দুর করেছে আমার মেয়ে। পাকা ঘরে ঘুমাবো এমন স্বপ্ন কখনই দেখিনি, এখন পাকা ঘরে ঘুমাতে পারছি। এর চেয়ে আনন্দের আর কি হতে পারে। মেয়ের জন্য দোয়া চাই, সে যেন দেশের ফুটবলকে ভালো কিছু দিতে পারে।

ইয়ারজান বেগম স্থানীয় বালিয়াডাঙ্গী সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় পড়াশুনা করেছেন। প্রাথমিকে থাকাকালীনই আকৃষ্ট হন ফুটবলের প্রতি। এরপর হাড়িভাসা বালিকা উচ্চ বিদ্যালয়ে পড়ার সময়ও ফুটবলে বিভিন্ন কৃতিত্ব অর্জণ করেছেন। মাধ্যমিক শেষ না হতেই অনুশীলনে যুক্ত হন পঞ্চগড় টুকু ফুটবল একাডেমিতে। শুরু করেন বয়স ভিত্তিক বিভিন্ন টুর্নামেন্টে খেলা। এরপর খুলে যায় তার সম্ভাবনার দ্বার।

পঞ্চগড় টুকু ফুটবল একাডেমির পরিচালক টুকু রেহমান বলেন, ইয়ারজানের উপর আমার আস্থা ছিলো- সে ভালো কিছু করবে, করেছেও। সাফ চ্যাম্পিয়নশীপে শিরোপা এনে দিয়েছে দেশকে। এখন জাতীয় নারী ফুটবল দলের হয়ে খেলছে। ইয়ারজান তার সাফল্যে আমাকে এবং আমার একাডেমিকে গর্বিত করেছে। গ্রামগঞ্জ থেকে এমন আরো ইয়ারজান যেন তৈরি করতে পারি- সবার কাছে এই দোয়া চাই।

নেপালের মাঠে সাফ অনুর্ধ্ব-১৬ চ্যাম্পিয়নশীপে শিরোপা জেতার পর বিভিন্ন গণমাধ্যমে উঠে আসে ইয়ারজানের পরিবারের অস্বচ্ছলতার গল্প। গণমাধ্যমের এমন খবরে তাদের বাড়িতে ছুটে যান প্রশাসনের লোকজনসহ বিভিন্ন স্তরের মানুষ। জেলা প্রশাসনের সৌজন্যে করে দেয়া হয় দৃষ্টিনন্দন একটি পাকা ঘর- ইয়ারজান নীড়। বাড়ীর সাথে সুপেয় পানির ব্যবস্থাও করা হয়। এছাড়া বিভিন্ন দপ্তর, সংস্থা থেকে অর্থসহায়তাও করা হয় পরিবারটিকে।