শিরোনাম
নারায়ণগঞ্জ, ১৭ জুন ২০২৫ (বাসস) : ‘ছোটবেলা থেকেই স্বপ্ন দেখেছি বাংলাদেশের জাতীয় দলের জার্সি গায়ে খেলব। জ্ঞান হওয়ার আগেই যখন বাবা-চাচাদের মাঠে খেলতে দেখতাম, তাদের সাথে খেলতে চাইতাম। বাবার হাত ধরেই শুরু হয় আমার এই পথ চলা। স্বপ্নটা আমার একার ছিলনা। স্বপ্নটা ছিল বাবারও।’ কথাগুলো বলেছেন বাংলাদেশ অনূর্ধ্ব-১৯ দলের সাবেক ক্রিকেটার জিসান আলম। বাবার স্বপ্ন পূরণেই ক্রিকেটের সঙ্গে গড়ে তুলেছিলেন সখ্য। বাংলাদেশ যুব বিশ্বকাপ দলের পথ পেরিয়ে এখন তিনি বাংলাদেশ ক্রিকেটে আশার আলো হয়ে উঠেছেন।
বাবার অনুপ্রেরণা পেয়েই বাংলাদেশের জার্সিতে মাঠ মাতানোর স্বপ্ন দেখেছিলেন জিসান। তার রক্তে মিশে আছে ক্রিকেট। বাবা জাহাঙ্গীর আলম ছিলেন বাংলাদেশ জাতীয় দলের উইকেটরক্ষক-ব্যাটার। চাচা জুয়েল হোসেন মনা, সোহেল হোসেনও লিস্ট-এ খেলোয়াড় ছিলেন। বাবা-চাচাদের সাথে ক্রিকেট খেলেই এই পথের পথিক হয়েছেন।
বাসস’র সাথে একান্ত সাক্ষাৎকারে বাংলাদেশের প্রতিভাবান এই খেলোয়ার জিসান আলম জানান বাংলাদেশ জাতীয় দলে নাম লিখিয়ে পূরণ করতে চান বাবার স্বপ্ন।
বাবার সাথে ছোট্টবেলায় নারায়ণগঞ্জ ক্লেমন ক্রিকেট একাডেমিতে জিসানের হাতেখড়ি। ছোটবেলার সেই স্মৃতি স্মরণ করে জিসান বলেন, আমার বাবা, চাচারা খেলতে যেতো মাঠে।
তাদের সাথে আমিও মাঠে চলে যেতাম। তারা খেলতো আমি দেখতাম। তখন আমার বয়স ৭-৮ হবে । মাঠে তাদের ব্যাট-বল, গ্লাভস দেখতাম। আবার এগুলো পড়ে বসে থাকতাম। ধীরে ধীরে এসব আমার জীবনের সঙ্গী উঠে।
নারায়ণগঞ্জের সদর উপজেলার জামতলার বাসিন্দা জিসান। বাবা-মা ও ছোট ভাই জায়ান আলমকে নিয়েই তার পরিবার। তিনি নারায়ণগঞ্জের আদর্শ স্কুল থেকে এসএসসি পরীক্ষা দিয়েছেন। বর্তমানে নারায়ণগঞ্জ কলেজে পড়ছেন।
জিসান বাসস’কে বলেন, বাসা থেকে পড়াশোনার প্রতি চাপ ছিলনা কখনো। বাবা-মা দুজনেই আমার খেলাকে অনেক সাপোর্ট করেছেন। বারো বছর বয়সে পুরোপুরি প্রশিক্ষণ নেওয়া শুরু করি। আমি অনূর্ধ্ব-১৪ দলে বিভাগীয় পর্যায়ে সেরা খেলোয়ার হয়েছিলাম। এরপর খেলার প্রতি আগ্রহ আরো বেড়ে যায়। বাসায় থাকলে সকাল-বিকাল দুবেলা অনুশীলন করা হয়। এছাড়া হাই পারফরম্যান্স (এইচপি) ক্যাম্পে থাকলে তো দিনের নির্দিষ্ট সময়ে অনুশীলন করি। সবশেষ আন্তর্জাতিক পর্যায়ে অনূর্ধ্ব-১৯ দলের হয়ে ২০২৪ সালে বিশ্বকাপ খেলেছি।
জিসান তার আক্রমণাত্মক ব্যাটিং স্টাইল এবং অফব্রেক বোলিংয়ের জন্য বেশ পরিচিত । ২০২৩ যুব এশিয়া কাপজয়ী দলের এই ওপেনার পাওয়ার হিটিংয়ের সঙ্গে বড় বড় ছক্কা হাঁকিয়ে ইতোমধ্যেই সকলের নজড়ে এসেছেন। বাংলাদেশের ক্রিকেট নতুন এক সম্ভাবনার নাম হয়ে উঠেছেন। সবশেষ এনসিএলে তার ব্যাট থেকে ৭ ম্যাচে ১৫৮.৭৬ স্ট্রাইক রেটে ২৮১ রান এসেছে । ঢাকার বিপক্ষে উদ্বোধনী ম্যাচে ঢাকা ডিভিশনের এই ওপেনার ৪ বাউন্ডারি ও ১০ ওভার বাউন্ডারিতে ৫২ বলে সেঞ্চুরি পেয়েছেন। এছাড়াও এবারের বিপিএলে জিসান দুর্বার রাজশাহীর হয়ে খেলেছেন। দেশের পাওয়ার হিটারের অভাব পূরণে অনন্য নাম হয়ে উঠতে পারেন এই খেলোয়াড়।
আক্রমণাত্মক ব্যাটিং প্রসঙ্গে জিসান বলেন, ক্যারিয়ারের শুরু থেকেই পাওয়ার হিটিং আমার কাছে পছন্দ। এইভাবে খেলাটা আমাকে বেশ আনন্দ দেয়। আমি যখন বোলারদের আক্রমণ করি, তারা ঘাবড়ে যায়। এটাকে আমার বিশেষত্ব করে তুলতে চাই। এই কৌশল নিয়েই আমি নিয়মিত কাজ করি। এছাড়া পুল শট খেলতে আমার বেশি ভালো লাগে।
ভবিষ্যতে এটাকে আমার পরিচিতির অংশ করে তোলার চেষ্টা করব। বর্তমানে আমার প্রিয় খেলোয়াড় দেশে লিটন দাস ও দেশের বাইরে ভারতীয় ওয়ানডে অধিনায়ক রোহিত শর্মা। তাদের দুজনের খেলার স্টাইল আমার অনেক ভালো লাগে।
জাহাঙ্গীর আলম বাংলাদেশ জাতীয় দলের খ্যাতিমান খেলোয়ার ছিলেন। ১৯৮৯ সালে অনূর্ধ্ব-১৯ দলের হয়ে ইংল্যান্ড সফরের এক ম্যাচে ১৩২ রান করে প্রথম সকলের নজর কাড়েন। ১৯৯৭ সাল থেকে ১৯৯৯ সাল পর্যন্ত তিনি জাতীয় দলে ছিলেন। ১৯৯৪ সালের আইসিসি ট্রফিতে দলের সেরা খোলোয়াড় নির্বাচিত হন। ঢাকা লিগে তিনবারের সর্বোচ্চ স্কোরার ছিলেন জাহাঙ্গীর। তবে উইকেটরক্ষক খালেদ মাসুদ পাইলটের কাছে জাতীয় দলের জায়গা হারিয়েছিলেন। বর্তমানে জিসানের বাবা জাহাঙ্গীর আলম অনূর্ধ্ব-১৫ দলের ব্যাটিং কোচ হিসেবে কর্মরত আছেন।
ছেলের সাফল্য কামনা করে জাহাঙ্গীর আলম বাসস’কে বলেন, ‘আমাদের বাড়ির কাছেই ওসমানী পৌর স্টেডিয়াম। এজন্য ছোটবেলা আমার সাথে খেলতে জিসান মাঠে চলে আসত। আমি খেলতাম, ও অনেক আগ্রহ নিয়ে দেখত। অল্প বয়সেই সে তার কার্যকলাপে ক্রিকেটের প্রতি আগ্রহ প্রমান করে। এসএসসি পরীক্ষার সময় একটা পরীক্ষা না দিয়েই বিশ্বকাপে খেলতে চলে যায়। ওর আগ্রহের কারণেই আমিও সর্বোচ্চ চেষ্টা করি, ওর পিছনে শ্রম দেই। প্রতিটা ম্যাচের পর ভিডিও দেখে ওর খেলায় ভুল-ত্রুটি নিয়ে আলোচনা করি। নিজের চেষ্টায় আজ জিসান ক্রিকেটে এগিয়ে যাচ্ছে।’
ক্রিকেটের সঙ্গে এই যাত্রার পুরো কৃতিত্বই বাবাকে দিয়েছেন জিসান আলম। তিনি বলেন, ‘ক্রিকেটে এই পর্যন্ত আসার পিছনে পুরো অবদান আমার বাবার। উনি আমার জন্য অনেক কষ্ট করেছেন। একাডেমীর স্যাররা আমাকে অনেক শিখিয়েছেন, তাদের প্রতি আমি কৃতজ্ঞ। কিন্তু আমাকে প্রচুর অনুশীলন করিয়েছেন আমার বাবা। ঘন্টার পর ঘন্টা বল থ্রো করতেন, আমি ব্যাটিং করতাম। এখন আমাকে জাতীয় দলে দেখাই বাবার স্বপ্ন। তার স্বপ্ন পূরণ করাই আমার লক্ষ্য। কোন ম্যাচের আগে এখনো বাবা আমাকে অনেক সহায়তা করেন। আমাকে পরামর্শ দেন। আমার বাবাই আমার গুরু, আমার শিক্ষক, আমার কোচ।’