শিরোনাম
// মো.আমিনুল হক //
সুনামগঞ্জ, ১৩ সেপ্টেম্বর, ২০২৫ (বাসস) : সমাজে বৈষম্য উত্তরণের কথা বাউল শাহ আব্দুল করিমের গানে ওঠে এসেছে। বাউল শাহ আবদুল করিম তাঁর গানে হাওর অঞ্চলের মানুষের জীবন, বিশেষ করে ফসলহানি ও বন্যার সমস্যা এবং এ থেকে উত্তরণের কথা তুলে ধরেছেন, যেইসব গান মানুষকে প্রভাবিত করেছে। তিনি তাঁর গানে হাওরের প্লাবিত হওয়া, জলাবদ্ধতা, ও বাঁধ ভেঙে যাওয়ার মতো কৃষিজ জীবনযাত্রার সংকটকে তুলে ধরেছেন।
বাউল শাহ আবদুল করিম তাঁর গানে সমাজের অর্থনৈতিক বৈষম্য, শোষণ, কুসংস্কার এবং ধর্মীয় গোঁড়ামির বিরুদ্ধে প্রতিবাদ করেছেন, যা তাঁকে গণমানুষের বাউল হিসেবে পরিচিতি দিয়েছ। তিনি কেবল গানই লেখেননি, বরং বিভিন্ন সামাজিক ও রাজনৈতিক আন্দোলনেও গান গেয়ে মানুষকে উদ্বুদ্ধ করেছেন। তাঁর গানে সাম্য, অসাম্প্রদায়িকতা ও প্রগতিশীল চেতনার প্রতিফলন দেখা যায়, যা ধর্মীয় অন্ধত্ব ও অবিচারের বিরুদ্ধে হাতিয়ার হতে পারে। যার ফলে মানুষে মানুষে বিভেদ বৈষম্য দূর হবে।
তাঁর গানগুলো হলো, বন্দে মায়া লাগাইছে, পিরিতি শিখাইছে/আগে কি সুন্দর দিন কাটাইতাম, গাড়ি চলে না/আমি কূলহারা কলঙ্কিনী/কেমনে ভুলিবো আমি বাঁচি না তারে ছাড়া/ কোন মেস্তরি নাও বানাইছে/কেন পিরিতি বাড়াইলারে বন্ধু/বসন্ত বাতাসে সইগো/আইলায় না আইলায় নারে বন্ধু/মহাজনে বানাইয়াছে ময়ুরপংখী নাও/আমি বাংলা মায়ের ছেলেসহ অসংখ্য জনপ্রিয় গানের স্রষ্ট্রা শাহ্ আব্দুল করিম না থাকলেও গানে আর সুরে তিনি বেঁচে আছেন। এভাবেই বেঁচে থাকবেন অনন্তকাল মানুষের মাঝে।
অসংখ্য জনপ্রিয় বাউল গান ও গণসংগীতের রচয়িতা বাউল শাহ আব্দুল করিমের মৃত্যুবার্ষিকী ছিল গতকাল। কিংবদন্তি এই শিল্পী ২০০৯ সালের ১২ সেপ্টেম্বর ৯৩ বছর বয়সে মৃত্যুবরণ করেন। মৃত্যুর পর সর্বস্তরের বিশেষ করে সাধারণের কাছে আরো বেশি জনপ্রিয় হয়ে ওঠেন বাউল শাহ আব্দুল করিম।
১৯১৬ সালের ১৫ ফেব্রুয়ারী বাউল শাহ আব্দুল করিম সুনামগঞ্জ জেলার দিরাই উপজেলার ধল গ্রামে জন্মগ্রহণ করেন। তাঁর বাবা ইব্রাহিম আলী ও মা নাইওরজান। দারিদ্র ও জীবন সংগ্রামের মাঝে বড় হওয়া বাউল শাহ আবদুল করিমের সঙ্গীত সাধনার শুরু ছেলেবেলা থেকেই। শৈশব থেকেই একতারা ছিল তার নিত্যসঙ্গি। জীবন কেটেছে সাদাসিধে ভাবে। বাউল ও আধ্যাত্মিক গানের তালিম নেন কমর উদ্দিন, সাধক রসিদ উদ্দিন, শাহ ইব্রাহিম মোস্তান বকস এর কাছ থেকে। কিংবদন্তি এই বাউল স্বশরীরে আমাদের মাঝে না থাকলেও তাঁর গান ও সুরধারা কোটি কোটি তরুণসহ সকল স্তরের মানুষের মন ছুঁয়ে যায়।
শাহ আবদুল করিম বাংলার লোকজ সঙ্গীতের ধারাকে আত্মস্থ করেছেন। ভাটি অঞ্চলের সুখদুঃখ তুলে এনেছেন গানে গানে। নারী পুরুষের মনের কথা ছোট ছোট বাক্যে প্রকাশ করেছেন আকর্ষণীয় সুরে। ভাটি অঞ্চলের মানুষের জীবনের সুখ প্রেম ভালোবাসার কথা ফুঁটে ওঠেছে তাঁর গানে। তাঁর গান কথা বলে সকল অন্যায়, অবিচার, কুসংস্কার আর সাম্প্রদায়িকতার বিরুদ্ধে। তিনি তাঁর গানের অনুপ্রেরণা পেয়েছেন প্রখ্যাত বাউল সম্রাট ফকির লালন শাহ, পুঞ্জু শাহ এবং দুদ্দু শাহ এর দর্শন থেকে। জীবিকা নির্বাহ করেছেন কৃষিকাজ করে। কিন্তু অভাব, অভিযোগ তাঁকে গান সৃষ্টি করা থেকে বিরত রাখতে পারেনি।
অসংখ্য গণজাগরণের গানের রচয়িতা বাউল শাহ আব্দুল করিম । গানে গানে অর্ধ শতাব্দিরও বেশী লড়াই করেছেন ধর্মান্ধদের বিরুদ্ধে। এজন্য নানা সময় লাঞ্ছনারও শিকার হয়েছিলেন তিনি। ব্রিটিশবিরোধী আন্দোলন, কাগমারী সম্মেলন, ভাষার আন্দোলন, মুক্তিযুদ্ধ, স্বৈরাচার বিরোধী আন্দোলনে মানুষকে প্রেরণা যোগায় শাহ আবদুল করিমের গান। শাহ আবদুল করিম লিখেছেন ও সুর দিয়েছেন ১৬শ’র বেশি গান। এগুলো সাতটি বইয়ে গ্রন্থিত আছে। বাংলা একাডেমীর উদ্যোগে তার ১০ টি গান ইংরেজীতে অনূদিত হয়েছে। কিশোর বয়স থেকে গান লিখলেও কয়েক বছর আগেও এসব গান শুধুমাত্র ভাটি অঞ্চলের মানুষের কাছেই জনপ্রিয় ছিল। তাঁর মৃত্যুর কয়ে বছর আগে ক’জন শিল্পী বাউল শাহ আব্দুল করিমের গানগুলো নতুন করে গেয়ে ব্যাপক জনপ্রিয়তা অর্জন করলে তিনি দেশব্যাপী পরিচিতি লাভ করেন। তিনি একুশে পদকও পেয়েছেন।
শাকুর মজিদ তাঁকে নিয়ে নির্মাণ করেছেন ভাটির পুরুষ নামে একটি প্রামাণ্য চিত্র। এখনও সুবচন নাট্য সংসদ করিমকে নিয়ে শাকুর মজিদের লেখা মহাজনের নাও নাটকের প্রদর্শনী করে জনপ্রিয়তা লাভ করেছে। এছাড়াও ২০১৭ শাহ আবদুল করিমের জীবনভিত্তিক প্রথম উপন্যাস ‘কূলহারা কলঙ্কিনী’ লিখেন সাইমন জাকারিয়া। শিল্পী জমির উদ্দিন জানান, আমি বাউল করিমের ভক্ত।
বাউল সম্রাট আব্দুল করিমের গানের মধ্যে দিয়ে তাঁকে খুঁজে পাই। তাই তো প্রতিদিন ভক্ত ও স্বজনরা গানের আসর বসান। তাঁর গান গেয়ে তাঁর প্রতি শ্রদ্ধা আর গানের মধ্যে তাঁকে বাঁচিয়ে রাখতেই সবার মাঝে তাঁর গান ছড়িয়ে দিতে চান ভক্তরা। একইসঙ্গে তাঁর সুরধারাকে বিকৃতভাবে না গাওয়ার দাবি জানান ভক্তরা।