বাসস
  ২৭ নভেম্বর ২০২৫, ২১:৪৬

পিআরআই-এর ‘মান্থলি ম্যাক্রোইকোনমিক ইনসাইটস’ প্রতিবেদন প্রকাশ

ঢাকা, ২৭ নভেম্বর, ২০২৫ (বাসস) : পলিসি রিসার্চ ইনস্টিটিউট অব বাংলাদেশ (পিআরআই)-এর সেন্টার ফর ম্যাক্রোইকোনমিক অ্যানালাইসিস (সিএমইএ) অস্ট্রেলিয়ার ডিপার্টমেন্ট অব ফরেন অ্যাফেয়ার্স অ্যান্ড ট্রেড (ডিএফএটি)-এর সহযোগিতায় ‘মান্থলি ম্যাক্রোইকোনমিক ইনসাইটস (এমএমআই)’-এর সেপ্টেম্বর-অক্টোবর সংস্করণ আজ বৃহস্পতিবার প্রকাশ আয়োজন করেছে। 

অনুষ্ঠানে অর্থনীতিবিদ, নীতিনির্ধারক, কূটনীতিক এবং বেসরকারি পর্যায়ের নেতৃবৃন্দ অংশ নেন।

প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়, রপ্তানি প্রবাহ ও রেমিট্যান্স বৃদ্ধি এবং মুদ্রাস্ফীতি হ্রাসের ফলে অর্থনীতিতে প্রাথমিক স্থিতিশীলতার ইঙ্গিত দেখা যাচ্ছে। বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভও কিছুটা শক্তিশালী হয়েছে, যা স্বল্পমেয়াদি স্বস্তি এনে দিয়েছে। তবে, বিনিয়োগ প্রবণতা দুর্বল থাকা, বেসরকারি ঋণপ্রবৃদ্ধি মন্থর হওয়া এবং রাজনৈতিক অনিশ্চয়তা ব্যবসায়িক আস্থাকে ক্ষুণ্ন করায় সামগ্রিক পুনরুদ্ধার এখনো নাজুক অবস্থায় রয়েছে বলে প্রতিবেদনে সতর্ক করা হয়।

এতে অর্থনৈতিক খাতের কিছু দুর্বলতা তুলে ধরা হয়েছে, যেখানে অনাদায়ী ঋণের কথা বলা হয়েছে। এই সমস্যা ঋণপ্রবাহ ও সামগ্রিক অর্থনৈতিক পুনরুদ্ধারকে হুমকির মুখে ফেলছে— যা দৃঢ় সুশাসন, সংস্কার এবং একটি সমন্বিত এনপিএল-সমাধান কাঠামো প্রণয়নের প্রয়োজনীয়তাকে আরো জোরালো করে।

রাজস্ব ক্ষেত্রে প্রতিবেদনে বলা হয়, বাংলাদেশের ট্যাক্স-টু-জিডিপি অনুপাত এখনো অত্যন্ত নিম্ন, যা উন্নয়ন ব্যয়কে বাধাগ্রস্ত করছে। রপ্তানি প্রবৃদ্ধি ইতিবাচক হলেও তা এখনো প্রধানত পোশাক শিল্প নির্ভর, রপ্তানি বৈচিত্র্যকরণ এবং প্রতিযোগিতামূলক উন্নতির দাবি করে।

অনুষ্ঠানে প্রধান অতিথির বক্তব্যে বাংলাদেশ চেম্বার অব ইন্ডাস্ট্রিজ (বিসিআই)-এর সভাপতি আনোয়ার-উল-আলম চৌধুরী বলেন, রাজনৈতিক স্থিতিশীলতার ভিত্তিতে স্থানীয় উন্নয়নকে অগ্রাধিকার দিতে হবে। নিয়মিত ও বিশ্বাসযোগ্য নির্বাচন নিশ্চিত করাই টেকসই অগ্রগতির প্রধান শর্ত। একই সঙ্গে শক্তিশালী নীতিগত কাঠামো, দীর্ঘমেয়াদি জ্বালানি কৌশল এবং ধারাবাহিক রাজস্ব সহায়তা প্রদান জরুরি। জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের কার্যকারিতা বৃদ্ধি করতে হবে, ব্যাংকিং খাত সংস্কার করতে হবে এবং দক্ষতা উন্নয়নে ব্যাপক বিনিয়োগ করতে হবে-যাতে অর্থনীতি আরও প্রতিযোগিতামূলক ও স্থিতিশীল হয়ে ওঠে।

অনুষ্ঠানে সভাপতির বক্তব্যে পিআরআই চেয়ারম্যান ড. জাইদী সাত্তার বলেন, মে মাস থেকে রিয়েল ইফেক্টিভ এক্সচেঞ্জ রেট (আরইইআর) সূচক বৃদ্ধি পেয়েছে, এটি রপ্তানিকারকদের জন্য উদ্বেগের কারণ হওয়া উচিত। বাংলাদেশ ব্যাংক এখন আর বাজার থেকে ডলার ক্রয় করে টাকার অবমূল্যায়ন ঘটাতে পারে না; ফলে আমদানি নিষেধাজ্ঞা শিথিল করাই একমাত্র বাস্তবসম্মত পথ-যা রপ্তানিকারকদেরও সহায়তা করবে। অধিকতর সক্রিয় আমদানি প্রবাহ নমনীয় বিনিময় হার ব্যবস্থাপনায় সহায়ক ভূমিকা রাখবে এবং রপ্তানি পরিবেশকে আরও গতিশীল করবে।

পিআরআই-এর প্রধান অর্থনীতিবিদ ড. আশিকুর রহমান বলেন, বাংলাদেশের আর্থিক খাতে অনাদায়ী ঋণ সংকটের এমন মাত্রা অতীতে দেখা না যাওয়ায় আন্তর্জাতিক মানদণ্ডে এনপিএল-সমাধান প্রক্রিয়া বাস্তবায়নের জন্য প্রয়োজনীয় প্রাতিষ্ঠানিক সক্ষমতা এখনো গড়ে ওঠেনি। কিন্তু সময় এসেছে এখন সেই সক্ষমতা তৈরি করার।

মালয়েশিয়া, যুক্তরাজ্য ও চীনের মতো দেশগুলোর অভিজ্ঞতা থেকে আমাদের অনেক শেখার আছে।

তিনি ব্যাখ্যা করে বলেন, বহু দেশে বিশেষায়িত অ্যাসেট ম্যানেজমেন্ট কোম্পানি (এএমসি) ব্যাংকের খারাপ ঋণ ক্রয় করে থাকে। যদি দেশের সমন্বিত পাঁচটি ব্যাংকের কাছে প্রায় দেড় লাখ কোটি টাকার অনাদায়ী ঋণ থাকে, তবে সেগুলো কিনতে একটি এএমসির বিপুল অর্থের প্রয়োজন হবে। চীন ও মালয়েশিয়া বন্ড ইস্যুর মাধ্যমে এ ধরনের অর্থায়ন করেছে-যেগুলোর পেছনে প্রায়শই সরকারি গ্যারান্টি ছিল। বাংলাদেশের কোনো এএমসিকে যদি সরকার-গ্যারান্টিযুক্ত বন্ড ইস্যুর অনুমতি দেওয়া হয়, তবে ব্যাংকগুলো দ্রুতই তাদের খারাপ ঋণ ব্যালেন্স শিট থেকে অপসারণ করতে সক্ষম হবে।

তবে, তিনি উল্লেখ করেন, মূল চ্যালেঞ্জ হলো মূল্যায়ন : কোন মূল্যে এনপিএল হস্তান্তর হবে-নামমাত্র মূল্য নাকি বাজারমূল্যে? বাংলাদেশের অধিকাংশ এনপিএল-এ কার্যকর জামানত নেই, ফলে প্রকৃত বাজার মূল্যায়ন জটিল হয়ে দাঁড়ায়। এতে পুরো সমাধান প্রক্রিয়া বাধাগ্রস্ত হতে পারে।

ড. রহমান আরও বলেন, আর্থিক খাতে আনুমানিক ৬ দশমিক ৪ ট্রিলিয়ন টাকার অনাদায়ী ঋণ বহাল থাকা সামগ্রিক অর্থনীতির ওপর গভীর চাপ সৃষ্টি করছে। এত বিপুল পরিমাণ খারাপ ঋণের কারণে ব্যাংকগুলোকে উচ্চ সুদহার বজায় রাখতে হয়, কেন্দ্রীয় ব্যাংকের তারল্য সহায়তার ওপর নির্ভর করতে হয় এবং উৎপাদনশীল খাতে ঋণপ্রবাহ কমে যায়। এর ফল হলো একটি বিষাক্ত চক্র- বিনিয়োগ কমে, মুদ্রাস্ফীতি বাড়ে, প্রবৃদ্ধি দুর্বল হয়।

তিনি সতর্ক করেন, এনপিএল সংকট সঠিকভাবে মোকাবিলা করা সম্ভব না হলে দেশ উচ্চ সুদহার, উচ্চ মুদ্রাস্ফীতি, নিম্ন বিনিয়োগ, নিম্ন প্রবৃদ্ধির ফাঁদে আটকে পড়তে পারে। এটি আর শুধু ব্যাংক খাতের সমস্যা নয়-এটি একটি সামষ্টিক অর্থনৈতিক বাধ্যবাধকতা।

প্যানেল আলোচক হিসেবে উপস্থিত ছিলেন এনবিআর-এর সাবেক চেয়ারম্যান ড. নাসিরউদ্দিন আহমেদ, নর্থ সাউথ ইউনিভার্সিটির অধ্যাপক ড. এ কে এম আতিউর রহমান, বিল্ড-এর রিসার্চ ডিরেক্টর ড. ওয়াসেল বিন সাদাত এবং পিকার্ড বাংলাদেশের ডিএমডি ও এলএফএমইএবি-এর পরিচালক আমৃতা মাকিন ইসলাম।

ড. ওয়াসেল বলেন, সৎ করদাতারা শাস্তির মুখে পড়ছেন, যা কর নীতির ন্যায়বিচারের পরিপন্থি। এ কারণেই অর্থনীতির প্রায় ৮৫ শতাংশ এখনো অনানুষ্ঠানিক খাতে রয়ে গেছে। পাশাপাশি রাজনৈতিক দলগুলোর ইশতেহারগুলো অর্থনীতির বাস্তব পরিস্থিতিকে যথাযথ গুরুত্ব দেয় না।

ড. নাসিরউদ্দিন আহমেদের মতে, করনীতি প্রণয়ন করা উচিত রাজনীতিবিদ ও ব্যবসায়ী মহলের মাধ্যমে-আমলাদের মাধ্যমে নয়, যাদের কেউ কেউ নীতিকাঠামোর দুর্বলতার কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছেন। তিনি কর্মসংস্থান ঘাটতি এবং মানসম্মত, দক্ষতাভিত্তিক শিক্ষার অভাবকে পরবর্তী সরকারের প্রধান অগ্রাধিকার হওয়া উচিত বলে উল্লেখ করেন।

ড. আতিউর রহমান বলেন, জুলাইয়ের গণঅভ্যুত্থান না হলে এনপিএল-সংকটের প্রকৃত মাত্রা আড়ালেই থেকে যেত। তিনি পোশাক শিল্পের নির্ভরতা কমিয়ে রপ্তানির বিস্তৃত বৈচিত্র্যকরণের তাগিদ দেন।