বাসস
  ২৩ আগস্ট ২০২৫, ১৯:১০

লালমনিরহাটে সাহাবি যুগের ‘হারানো মসজিদ’

সাহাবি যুগের ‘হারানো মসজিদ’। ছবি : বাসস

 বিপুল ইসলাম

লালমনিরহাট, ২৩ আগস্ট, ২০২৫ (বাসস) : ঐতিহাসিক ‘হারানো মসজিদ’ দেশের স্থাপত্য ও ঐতিহ্যের এক অমূল্য নিদর্শন। এটি লালমনিরহাট সদর উপজেলার পঞ্চগ্রাম ইউনিয়নের রামদাসে অবস্থিত। সম্প্রতি মসজিদটির নামকরণ করা হয়েছে ‘৬৯ হিজরীয় হারানো (সাহাবা) মসজিদ কমপ্লেক্স’। 

প্রায় ১৪০০ বছর আগে নির্মিত এই মসজিদ শুধু বাংলাদেশের নয়, এশিয়ারও অন্যতম প্রাচীন মসজিদ হিসেবে বিবেচিত। মসজিদটি বাংলাদেশে মুসলমানদের আগমনের প্রারম্ভিক ইতিহাসের রাজসাক্ষী হয়ে দাঁড়িয়ে আছে।

জানা যায়, ১৯৮৩-৮৪ সালে জঙ্গল পরিষ্কারের সময় মসজিদটির ধ্বংসাবশেষ প্রথম আবিষ্কৃত হয়। পরবর্তীতে ১৯৮৬ সালের ১০ মহররমে স্থানীয় নাগরিক আইয়ুব আলী একটি খোদাইকৃত ইট উদ্ধার করেন। ইটে লেখা ছিল-‘লা ইলাহা ইল্লাল্লাহু মুহাম্মাদুর রাসুলুল্লাহ, হিজরি সন ৬৯।’ 

শিলালিপি প্রমাণ করে মসজিদটির বয়স প্রায় ১৩৫০ বছর। বর্তমানে এটি মসজিদের ভেতরে সংরক্ষিত ও প্রদর্শিত হচ্ছে। মসজিদের ভেতরে উদ্ধারকৃত শিলালিপি ও সংরক্ষিত প্রাচীন শিল্পকর্মগুলো পর্যবেক্ষণ করলে স্পষ্ট হয়, স্থাপত্যশৈলীতে প্রাচীন আরবীয় নকশার ছোঁয়া বিদ্যমান। মোটা ও খাঁজকাটা ইটে নির্মিত দেয়াল, সূক্ষ্ম অলংকৃত মেহরাব এবং খিলান স্থাপনার শিল্পকর্মের উৎকৃষ্ট নিদর্শন। ধ্বংসাবশেষের দৈর্ঘ্য ছিল ২১ ফুট ও প্রস্থ ১০ ফুট। 

ভেতরে চারটি খুঁটির অবশিষ্টাংশ এবং একটি প্রাচীন প্রবেশপথ এখনও সংরক্ষিত রয়েছে।

জানা যায়, ইসলাম প্রচারের প্রাথমিক সময়ে সাহাবায়ে কেরাম এ অঞ্চলে এসে মসজিদটি নির্মাণ করেন। অনেকে মনে করেন, হজরত আবু ওয়াক্কাছ (রা.) চীনের পথে এ অঞ্চলে অবস্থানকালে মসজিদটির ভিত্তি স্থাপন করেছিলেন। তৎকালীন ব্রহ্মপুত্র-তিস্তা অববাহিকা আন্তর্জাতিক বাণিজ্যপথ হিসেবে ব্যবহৃত হত, যা মসজিদের ঐতিহাসিক গুরুত্ব বাড়িয়ে তোলে।

পরবর্তীতে মসজিদ পরিচালনা কমিটির উদ্যোগে প্রতিষ্ঠিত হয় ‘আস-সাহাবা কমপ্লেক্স’, যা বর্তমানে ‘৬৯ হিজরীয় হারানো (সাহাবা) মসজিদ কমপ্লেক্স’ নামে পরিচিত। এখানে মসজিদ কমপ্লেক্সের পাশাপাশি একটি কওমি মাদ্রাসাও স্থাপন করা হয়েছে। যেখানে প্রায় ২০০ শিক্ষার্থী পাঠ গ্রহণ করছে।

স্থানীয় স্কুল শিক্ষক রিয়াজুল ইসলাম রাজু বলেন, ১৯৯০ থেকে ২০১৫ সালের মধ্যে মসজিদটির খবর আল জাজিরাসহ বিভিন্ন দেশি-বিদেশি গণমাধ্যমে প্রকাশিত হয়েছে। বর্তমানে প্রতিদিন দেশের নানা প্রান্ত থেকে অসংখ্য পর্যটক ও ধর্মপ্রাণ মুসলিম এখানে নামাজ আদায় করতে আসছেন।

গত শুক্রবার জুম্মার নামাজ আদায় করতে আসা হরিদেব দয়েজ উদ্দিন উচ্চ বিদ্যালয়ের অবসরপ্রাপ্ত শিক্ষক মাওলানা মোহাম্মদ আব্দুল বাতেন বলেন, প্রতিদিন দেশ-বিদেশ থেকে দর্শনার্থীরা আসেন এখানে। তবে মসজিদের পরিবেশ এমনভাবে উপস্থাপন করা দরকার যাতে প্রবেশ করলেই দর্শনার্থীরা ইতিহাস ও আধ্যাত্মিকতা অনুভব করতে পারেন। সরকারি উদ্যোগে মসজিদের স্থাপত্য ও পরিবেশ আরও উন্নত করা সম্ভব।

মসজিদের মোয়াজ্জিন সোলাইমান আলী বলেন, প্রতিষ্ঠান পরিচালনা শক্তিশালী ও কার্যকর হলে মসজিদের যথাযথ মূল্যায়ন বৃদ্ধি পাবে। এতে দর্শনার্থী ও স্থানীয় মুসলিম উভয়ই উপকৃত হবেন।

পেশ ইমাম তাওহীদুল ইসলাম বলেন, প্রাচীন ইট ও স্থাপত্য উপাদান সংরক্ষিত রয়েছে। এটি এ অঞ্চলের ইসলামী ঐতিহ্যের অমূল্য নিদর্শন।

স্থানীয় ধর্মপ্রাণ মানুষরা মনে করেন, সরকারি উদ্যোগে মসজিদের পরিবেশ ও স্থাপত্য উন্নয়ন করা হলে এটি দেশ-বিদেশের পর্যটকদের জন্য আরও আকর্ষণীয় হয়ে উঠবে।

লালমনিরহাটের জেলা প্রশাসক ও জেলা ম্যাজিস্ট্রেট এইচ এম রকিব হায়দার বলেন, প্রাচীন ‘হারানো মসজিদ’ ইসলামী ঐতিহ্যের এক অমূল্য নিদর্শন। সম্প্রতি এর নাম পরিবর্তন করে ‘৬৯ হিজরীয় হারানো (সাহাবা) মসজিদ কমপ্লেক্স’ রাখা হয়েছে। মসজিদটির স্থাপত্য ও পরিবেশ উন্নয়নে প্রশাসনের পক্ষ থেকে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নেওয়া হবে।