শিরোনাম
প্রতিবেদন : বাবুল আখতার রানা
নওগাঁ, ১৬ জুলাই, ২০২৫ (বাসস) : বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলন চলাকালে গত ২০ জুলাই দুপুরে গাজীপুর মেট্রোপলিটন পুলিশগাছা থানার কলমেশ্বর বোর্ডবাজার বেলমন্ট টেইলার্সের সামনে রাস্তায় গুলিবিদ্ধ হন রায়হান আলী (১৮)। স্থানীয়রা তাকে উদ্ধার করে শহীদ তাজউদ্দিন মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে নিয়ে যায়। সেখানে মারা যায় রায়হান আলী।
শহীদ রায়হান নওগাঁর নিয়ামতপুর উপজেলার পানিশাইল গ্রামের মামুন সরদারের ছেলে। বর্তমানে মামুন সরদার রিকশা চালিয়ে সংসার চালান। এ ঘটনায় তিনি শেখ হাসিনা, ওবায়দুল কাদের ও সাধন চন্দ্র মজুমদারসহ ১৬৭জনকে আসামি করে হত্যা মামলা দায়ের করেছেন।
২০১৭ সালে জীবিকার তাগিদে নওগাঁর নিয়ামতপুর থেকে ঢাকায় পাড়ি জমান শহীদ রায়হান আলীর বাবা মামুন সরদার ও তার স্ত্রী রানী বেগম। ঢাকার গাজীপুর বোর্ডবাজার আল-হেরা পাম্প এলাকার কলমুস্বর গ্রামের মুক্তার বাসায় ভাড়া থাকতেন তারা। সেই সুবাধে বাসার মালিক মুক্তা ও তার ছেলে সোহাগের সাথে ভালো সম্পর্ক গড়ে ওঠে।
এ সময় শহীদ রায়হান আলীর বাবা মামুন সরদার ইউনিক ডিজাইন নামে এক গার্মেন্টেসে চাকুরি করতেন। আর সেই সাথে তার স্ত্রী রানী বেগমও অন্য একটি গার্মেন্টেসে চাকুরি করতেন। দীর্ঘদিন বসবাস করার পর নওগাঁতে চলে আসেন। আর ছেলে শহীদ রায়হান আলীকে স্থানীয় বরেন্দ্র আলীয়া মাদ্রাসায় ভর্তি করে দেন।
শহীদ রায়হান আলীর বাবা মামুন সরদার তখন রিকশা চালিয়ে আর তার স্ত্রী রানী বেগম কাপড় সেলাই করে জীবিকা নির্বাহ করতেন। ঢাকায় বসবাস করার সময় তাদের একটি কন্যা সন্তানের জন্ম হয়। তার নাম তাছলিমা। সে বর্তমানে ৫ম শ্রেণিতে পড়ালেখা করছে।
শহীদ রায়হান আলীর পিতা মামুন সরদার বলেন, ছেলে রায়হান ঢাকায় থাকার সুবাদে ওই পরিবারের সাথে ভালো সুসম্পর্ক হওয়ায় সে ওইখানে থাকত। সোহাগের স্টুডিও ছিল। সেখানে সে কম্পিউটারের কাজ করত।
বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলন চলাকালে রায়হান বোর্ডবাজার বেলমন্ট টেইলার্সের সামনে ঢাকা ময়মনসিংহ হাইওয়ে রোড পাকা রাস্তায় গুলিবিদ্ধ হয়। স্থানীয়রা তাকে উদ্ধার করে সরকারি শহীদ তাজউদ্দিন আহমেদ মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল গাজীপুর নিয়ে যায়। সেখানে তার মৃত্যু হয়।
খবর পাওয়া মাত্র ঢাকায় অবস্থানরত আত্মীয়-স্বজনদের খবর দেই। তারা ওইদিন ভোর রাতে রায়হানের লাশ নওগাঁর নিয়ামতপুরের পানিশাইল গ্রামের বাড়িতে পাঠিয়ে দেয়। সে সময় পরিস্থিতি বিবেচনায় ময়নাতদন্ত ছাড়াই তার লাশ কবরস্থানে দাফন করা হয়।
তিনি আরো বলেন, এ ঘটনায় গত ১০ অক্টোবর ঢাকা মেট্রোপলিটনের আওতাধীন পুলিশগাছা থানায় শেখ হাসিনা, ওবায়দুল কাদের ও সাধন চন্দ্র মজুমদারসহ ১৬৭জনকে আসামি করে হত্যা মামলা দায়ের করেন। সুষ্ঠ তদন্তের স্বার্থে মরদেহটি কবর থেকে তুলতে আদালত নির্দেশ দেয়া হয়।
আদালতের নির্দেশে দাফনের ১৩৩ দিন পর গত ১ ডিসেম্বর বেলা ১১টায় পানিশাইল গ্রামের কবর থেকে রায়হান আলীর মরদেহ তোলা হয়। পরে ময়না তদন্তের জন্য মরদেহ নওগাঁ সদর হাসপাতালে পাঠানো হয়েছিল। মরদেহ তোলার সময় উপজেলার সহকারী কমিশনার ও নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেট, মামলার তদন্ত কর্মকর্তা, পুলিশ ও নিহতের পরিবারের সদস্যরা উপস্থিত ছিলেন।
শহীদ রায়হান আলীর মা রানী বেগম বলেন, নিয়ামতপুর উপজেলার বরেন্দ্র আলীয়া মাদ্রাসার থেকে এ বছর এসএসসি পরীক্ষায় অংশ নেওয়ার কথা ছিল। সে স্বপ্ন আর পুরুন হলো না। শেখ হাসিনা আমার ছেলেকে গুলি করে মেরে ফেলেছে। আমার এখন এক মেয়ে রয়েছে।
তিনি আরো বলেন, এখন পর্যন্ত মোট ১৭ লাখ টাকা পেয়েছি। ১০ লাখ টাকা সঞ্চয়পত্র রেখেছি। ৫ লাখ টাকা দিয়ে জমি বন্ধক নিয়েছি। আর আমাদের সবাস করার মত নিজের একখন্ড জমি নেই। সরকারী জায়গায় বসবাস করছি। এখন বর্ষার সময় টিনের ঘর উড়ে যাবে এই ভয়ে ঘর মেরামত করেছি। আর স্বামীকে নতুন রিকশা কিনে দিয়েছি।
তিনি আরও বলেন, শেখ হাসিনা যে অপরাধ করেছে তার শাস্তি হওয়া দরকার। তাই আমি এর বিচার চাই।
বরেন্দ্র আলীয়া মাদ্রাসার অধ্যক্ষ আতিকুর রহমান বলেন, ‘স্বৈরাচারী শাসকের হাত থেকে বাংলাদেশকে রক্ষার জন্য রায়হানসহ নওগাঁর কয়েকজন প্রাণ হারিয়েছেন। রায়হান আলীসহ বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনে শহীদ হওয়া ভাইবোনদের কারণে আজকে আমরা নতুন করে বাংলাদেশের স্বাধীনতা পেয়েছি। পুরো বাংলাদেশের মানুষ স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলতে পারছেন। আমরা মুক্ত বাতাসে আজ চলতে পারছি।’
তিনি বলেন, ‘শহীদ রায়হান দেশের জন্য প্রান দিয়েছে। সে খুব ভালো শান্ত স্বভাবের ছেলে ছিল।’ শুধু নওগাঁ জেলা নয়; দেশের সকল শহীদদের বিচারের আওতায় আনা দরকার বলে মনে করছেন এই শিক্ষক।
নওগাঁর জেলা প্রশাসক মোহাম্মদ আব্দুল আউয়াল বলেন, গণঅ্যভ্যুত্থানে শহীদ রায়হান আলীসহ ৮জনের পরিবারকে ১০ লাখ টাকা সঞ্চয়পত্র প্রদান করা হয়েছে। এর আগেও তাদেরকে টাকা প্রদান করা হয়েছে। আমরা শহীদ পরিবারের সকল সদস্যদের প্রতি সমবেদনা জ্ঞাপন করছি।
বাসস/এসপিএল/সংবাদদাতা/১৯৩৫/-এইচএন