বাসস
  ০৩ জুলাই ২০২৫, ২০:৪০

বাজার-সওদা নিয়ে ঘরে ফেরা হয়নি মিজানুরের

মো. মিজানুর রহমান- ছবি : বাসস

প্রতিবেদন : খায়রুল বাশার বুলবুল

বরগুনা, ৩ জুলাই, ২০২৫ (বাসস) : চব্বিশের ১৯ জুলাই সকাল ৮টার দিকে স্ত্রী, সন্তান ও অসুস্থ বাবাকে বাসায় রেখে প্রতিদিনের মতো কাজের উদ্দেশ্যে বের হন মিজানুর। কাজ শেষে যথারীতি বিকেলের দিকে বাসায় ফেরার পথে মানিকনগর বিশ্বরোড এলাকায় গুলিবিদ্ধ হয়ে শহীদ হন।

২০২৪ সালের জুলাইয়ের প্রথম থেকে বৈষম্যবিরোধী আন্দোলন শুরু হওয়ার পর বিশেষ করে দুই সপ্তাহ পর ঢাকার রাজপথ  চরম উত্তাল হয়ে ওঠে। ঠিক তখনই মিজানুরের পাঁচজনের সংসারেও নেমে আসে সংকট। বাইরে জীবনের ঝুঁকি, ঘরে খাবার মতো বাজার নেই। কাজে না গেলে, না খেয়ে থাকতে হবে, তাই বাধ্য হয়েই স্ত্রী শিরিন স্বামীকে কাজে বের হতে বলেন। 

কিন্তু সেই বের হওয়া যে শেষ বের হওয়া হবে তা কে জানত? কাজ শেষ করে বাজার নিয়ে ঘরে ফেরার পথে বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনকারীদের ওপর পুলিশের নির্বিচারে ছোঁড়া একটি গুলি এসে বিঁধে মিজানুরের শরীরে। ঘটনাস্থলেই শহীদ হন ঠেলা-গাড়ি চালক মো. মিজানুর।

এ সময়ে সঙ্গে থাকা কয়েকজন মিলে তাকে ঢাকা মুগদা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে নিয়ে গেলে কর্তব্যরত চিকিৎসকরা তাকে মৃত ঘোষণা করেন। পরে ওই দিন রাতেই মিজানুরের মরদেহ বরগুনায় নিয়ে আসেন স্বজনরা। পরদিন সকালে তার নিজ গ্রামের বাড়িতে দাফন করা হয় তাকে।

মো. মিজানুর রহমান বরগুনা সদর উপজেলার ৮ নম্বর ইউনিয়নের কালিরতবক এলাকার বাসিন্দা জাকির হোসেন দুলালের বড় ছেলে ছিলেন। প্রায় বছর দশেক আগে জীবিকার তাগিদে বরগুনা ছেড়ে কাজের উদ্দেশ্যে পরিবার নিয়ে ঢাকায় যান মিজানুর।  যখন যে কাজ পেতেন তখ সে কাজই করতেন মিজানুর। তবে বেশিরভাগ সময়ই তিনি বাবার সঙ্গে ঠেলাগাড়ি চালাতেন। 

মিজানুরের মৃত্যুর পরে তার অসুস্থ মা-বাবা, স্ত্রী ও অবুঝ ছেলে-মেয়েরা মানবেতর জীবন যাপন করছেন। নয় বছর বয়সী মেয়ে সামিয়া আক্তার পিংকি বাবা হারানোর বেদনায় বেশিরভাগ সময়ই নির্বাক কাটায়। পাঁচ বছর বয়সী ছেলে সাজিদুল ইসলাম এখনও খুঁজে বেড়ায় তার বাবাকে।  

মিজানুরের গ্রামের বাড়িতে নিজের কোনো ঘর না থাকায় তার স্ত্রী জাকিয়া আক্তার শিরিন দুই ছেলে-মেয়ে নিয়ে দেবরের বাড়িতে আশ্রয় নেন। স্বামীর কথা মনে পড়লে কবরের কাছে গিয়ে নীরবেই চোখের পানি ফেলেন তিনি। আর বড় ছেলেকে হারিয়ে অসুস্থ হয়ে পড়েন মিজানুরের মা শাহিনুর বেগম। বাবা মো. জাকির হোসেন দুলাল এখনও ক্ষণে ক্ষণে ভেঙে পড়েন কান্নায়। 

মিজানুরের ছোট চাচা সরোয়ার জানান, ‘মিজান ছোটবেলা থেকেই খুব কর্মঠ ছিল। সংসারে অভাবের কারণে সে তার বাবার সাথে ঢাকায় কাজ করতে গিয়েছিল। বিয়ে করার পরে স্ত্রীকেও ঢাকায় নিয়ে যায়। ঈদে, কোরবানিতে গ্রামে আসলেও বসে থাকত না। ওর মাকে মাছ কিনে দিতে ঢাকা থেকে প্রায়ই আমার কাছে টাকা পাঠাত।’ 

মিজানুরের পিতা মো. জাকির হোসেন দুলাল বলেন, ‘ঘটনার দিন আমার ওর সাথে যাবার কথা ছিল। কিন্তু সকালে শরীর খারাপ লাগায় আমি যাই নাই। গেলে হয়তো ওরে বাঁচাইতে পারতাম।’ 

মিজানুরের স্ত্রী শিরিন বলেন, ‘মিজানের মৃত্যুতে আমি এখন দুই সন্তান নিয়ে অসহায় হয়ে পড়েছি। আমার মা মানুষের বাসায় কাজ করে আর বাবা পাগল। বাপের বাড়িতেও কোনো থাকার জায়গা নেই। আর এখানেও আমাদের কোনো জায়গা-জমি নাই। দেবরের বাসায় আছি; কিন্তু কতদিন থাকব! সরকারের কাছে আমার আবেদন আমাকে সরকার যেনো একটা থাকার জায়গা আর একটা কর্মসংস্থানের ব্যবস্থা কইরা দেয়।’

জানা যায়, বরগুনার জেলা প্রশাসকসহ কর্মকর্তারা শহীদ মিজানুরের বাড়ি পরিদর্শন করেছেন। জেলা প্রশাসন তার পরিবারকে সরকারের পক্ষ থেকে আর্থিক সহায়তা দিয়েছে।

বরগুনার বর্তমান উপজেলা নির্বাহী অফিসার ইয়াসিন আরাফাত রানা জানান, শহীদ পরিবারগুলোকে কর্মসংস্থান ও আর্থিক সহয়তার আওতায় আনা হয়েছে। এই সুযোগ-সুবিধাগুলো প্রদানের ব্যবস্থা চলমান রয়েছে।