শিরোনাম
\ আল-আমিন শাহরিয়ার \
ভোলা, ৩১ জুলাই, ২০২৫ (বাসস) : ২০২৪ এর জুলাই গণঅভ্যুত্থানকালে জীবন জীবিকা মেটাতে রাজধানী ঢাকার নানা জায়গায় বসবাস করছিলেন ভোলার বিভিন্ন উপজেলার কয়েকহাজার মানুষ। বৈষম্যবিরোধী আন্দোলনে রাজপথ যখন উত্তাল তখন ছাত্র জনতাকে সাহস যোগাতে তাদের মিছিলে যোগ দেয় ভোলার বিভিন্ন শ্রেীপেশার মানুষ। নিজেদের কর্মব্যাস্ততাকে ছুড়ে ফেলে ভোলাবাসীও যোগ দেয় ঢাকাবাসীর অধিকার আদায়ের রনাঙ্গনে। গণঅভ্যুত্থানে বিজয়ের পুরস্কার ছিনিয়ে আনতে ভোলার বীর মানুষেরা নিজেদের জীবনের মায়া করেননি। অধিকার আদায়ের উত্তাল রাজপথে ভোলার ৪৭টি তাজা প্রাণ ঝড়ে যায়। রাজধানী ঢাকার বিভিন্ন এলাকায় আন্দোলনে অংশ নিয়ে হায়েনাদের হিংস্রতার শিকার হয়ে নিজেদের জীবনকে উৎসর্গ করেন তারা।
ঐতিহাসিক গণঅভ্যুত্থানের এক বছর পেরিয়ে সেই জুলাই ট্র্যাজেডির দিনক্ষণ আবার ফিরে আসলেও ভোলার বাতাসে স্বজন হারানো কষ্ট আর গগনবিদারী আর্তনাদের প্রতিধ্বণী যেনো এখনো ভেসে বেড়ায়। আপন মানুষের বন্ধনহারা শোক এখনো ভুলতে পারেননি ভোলার শহীদ পরিবারগুলো। ভয়ঙ্কর সেই দিনগুলোতে স্বৈরশাসকের বিষাক্ত বুলেটের আঘাতে কেউ হারিয়েছেন বাবা, কেউ ভাই, কেউ স্বামী-সন্তান আবার কেউবা হারিয়েছেন ভালোবাসার আপন মানুষটিকে। জুলাই বিপ্লবের সেই রক্তাক্ত রাজপথের পাষন্ডতার নির্মম আঘাতে একমাত্র উপার্জনক্ষম ব্যক্তিটিকে হারিয়ে বহু পরিবারই এখন সীমাহীন কষ্ট আর সংকটে দিনাতিপাত করছেন। এদের মধ্যে সবচেয়ে বেশি বিপর্যস্ত হতদরিদ্র পরিবারের সদস্যরা।
জীবিকার তাগিদে শহরে যাওয়া সেই মানুষগুলোর কেউ আর জীবিত ফেরেননি। ভবিষ্যৎ গড়ার এক বুক আশা নিয়ে যে ছেলেটি গ্রাম ছেড়ে শহরে গিয়ে স্বপ্নের জাল বুনেছিল তার নিথর নিস্তব্ধ দেহটির জায়গা হয়েছে সেই গ্রামেরই মসজিদের পাশের সাড়ে তিনহাত মাটির ঘরে। তারা পরিবারের কাছে এখন আছে শুধুই স্মৃতির মিনার হয়ে।
জুলাই বিপ্লবকালে নিহতদের মধ্যে একজন শুধু ভোলা সদরে, আর বাকিদের মৃত্যু ঘটে ঢাকার রাজপথে। এসকল শহীদের অধিকাংশরই দাফন সম্পন্ন হয় ভোলার বিভিন্ন উপজেলার নিজ গ্রামের পারিবারিক কবরস্থানে।
তথ্যমতে, ২০২৪ সালের ১৬ জুলাই থেকে ৫ আগস্ট পর্যন্ত টানা ২১ দিনের একটানা আন্দোলনের মাত্র তিন দিনেই প্রাণ হারান ভোলার ৩৩ জন। এর মধ্যে ১৯ জুলাই শহীদ হন ১৩ জন, ৪ আগস্ট ১১ জন এবং ৫ আগস্ট শহীদ হন ৯ জন।
শহীদদের মধ্যে রয়েছেন-ছাত্র, দোকান কর্মচারী, ট্রাক চালক-হেলপার, রাজমিস্ত্রি, গার্মেন্টসকর্মী, ফুটপাতের দোকানদার, সিএনজি চালক, মসজিদের ইমাম, রিক্সা চালক ও শ্রমিক, শিশুসহ নানা শ্রেণিপেশার মানুষ। নিহতরা সকলেই নিম্ন ও মধ্যবিত্ত পরিবারের সন্তান। জুলাই বিপ্লবের এক বছর পেরিয়ে গেলেও থামেনি স্বজন হারা মানুষের কান্না আর বুকফাটা আহাজারি।
তথ্যানুযায়ী, ঢাকায় যারা শহীদ হন তাদের মধ্যে ভোলা সদর উপজেলার ১২ জন, দৌলতখানের ৩ জন, তজুমদ্দিনের ১ জন, লালমোহনের ১১ জন, চরফ্যাশনের ১২ জন এবং বোরহানউদ্দিন উপজেলার শহীদ হয়েছেন ৯ জন। ঢাকার রাজপথে ভোলা সদর উপজেলার শহীদরা হলেন, ইলেকট্রিক মিস্ত্রি মো. শামিম হাওলাদার (৩৮), স্কুল শিক্ষার্থী মিরাজ ফরাজী (১৮), রিকশা চালক মো. ইমন (২২), ফার্নিচার ব্যবসায়ী মো. দেলোয়ার হোসেন (৩৬), মুদি দোকানী মো : মহিউদ্দিন (২৬), বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষার্থী জুলফিকার আহমেদ শাকিল (২৩), সিকিউরিটি গার্ড মো. আলাউদ্দিন মল্লিক (৫৭), শ্রমিক মো. রনি (২৩), ছাতা মেরামতকারী মো. জসিম উদ্দিন (৪৪), গাড়ী চালক মো. বাবুল (৪০), শ্রমিক জহিরুল ইসলাম শুভ (৩২) এবং দোকান কর্মচারী মো. হাছান (১৮)।
দৌলতখান উপজেলার শহীদ ব্যাক্তিরা হলেন, ফুটপাতের ক্ষুদ্র ব্যবসায়ী মো. শাহজাহান (২৬), রাজমিস্ত্রি মো. রিয়াজ (২৬) এবং গাড়ি চালক মো. শাহিন (২৪)।
বোরহানউদ্দিন উপজেলার শহীদ ব্যাক্তিগন হলেন, বিকাশকর্মী মো. নাহিদুল ইসলাম (২১), ট্রাক শ্রমিক মো. সুজন (২২), রাজমিস্ত্রি মো. ইয়াছিন (২৩), রিকশাচালক মো. জামাল উদ্দিন (৩৫), কলেজ শিক্ষার্থী দীপ্ত দে (২২), গৃহকর্মী লিজা আক্তার (২৩), দোকান কর্মচারী মো. নয়ন (৩৪), গার্মেন্টসকর্মী মো. জাকির হোসেন (২৬) এবং গার্মেন্টসকর্মী মো. সোহেল রানা (২২)।
তজুমদ্দিন উপজেলার শহীদ হলেন, ঝুট ব্যবসায়ী মো. মনির হোসেন (৩৪)।
লালমোহন উপজেলার শহীদরা হলেন, হোটেল কর্মচারী মো. আরিফ (১৭), লন্ড্রি দোকানি মো. মোছলেহ উদ্দিন (৩৫), রিকশাচালক মো. আক্তার হোসেন (৩৫), মসজিদের ইমাম মুফতি শিহাবউদ্দিন (৩০), মিষ্টির দোকানের কর্মচারী মো. শাকিল (২০), মাইক্রোচালক মো. হাবিবুল্লাহ (৪০), হোটেল কর্মচারী মো. সাইদুল (১৪), কোম্পানির বিপণনকারী মো. ওমর ফারুক (১৭), সিএনজি চালক মো. সবুজ (২১), ট্রাক হেলপার মো. আক্তার হোসেন (২৭) এবং সবজি বিক্রেতা মো. হাসান (৩০)।
চরফ্যাশন উপজেলার শহীদরা হলেন, ফুটপাতের দোকানি মো. সিয়াম (১৫), বেসরকারি চাকরিজীবী মো. রাকিব মোল্লা (২৫), কোম্পানির বিপণনকর্মী মো. সোহাগ (১৭), রাজমিস্ত্রি মো. বাহাদুর হোসেন মনির (১৮), গার্মেন্টস কর্মী মো. ফজলু (২৮), রাজমিস্ত্রি মো. ফজলে রাব্বি (২০), ইন্টারনেট কর্মী মো. হাসনাইন (২৫), কলেজ শিক্ষার্থী মো. মমিন (১৯), ট্রাক চালক মো. হোসেন (২৫), দোকান কর্মচারী মো. হাবিবুর রহমান (২৯), মুদি দোকানের কর্মচারী মো. ওমর ফারুক (১৬) এবং দর্জি মো. তারেক (১৮)।
এদিকে দৌলতখানের শহীদ শাহজাহানের স্ত্রী ফাতেহা বেগম বলেন, তার স্বামী ঢাকার নিউমার্কেট এলাকায় পাপসের ব্যবসা করতেন। ১৬ জুলাই ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় চত্বরে গুলিবিদ্ধ হয়ে মৃত্যুবরণ করেন তিনি। পরিবারের একমাত্র উপার্জনক্ষম ব্যক্তিটিকে হারিয়ে তাদের ৮ মাস বয়সী একমাত্র সন্তান বাবার মুখ দেখতে পারেননি।
ভোলা সদর উপজেলার দক্ষিণ দিঘলদী ইউনিয়নের শহীদ রনির মা মাইনুর বেগম বলেন, রনি ঢাকার যাত্রাবাড়ীতে টাইলস মিস্ত্রির কাজ করতো। ৫ আগস্ট সকাল ১০টায় ছেলের সঙ্গে মোবাইলে কথা হয়। তিনি ছেলেকে অনুরোধ করেছিলেন বাইরে না যেতে। বলেছিলেন, একদিন ভাত না খাইলে মানুষ মরে না। কিন্তু ওইদিন বিকেল ৪টার দিকে ঢাকা মেডিকেল থেকে ফোন আসে রনি গুলি খেয়ে মারা গেছে।
কথাগুলো বলতে বলতে মাইনুর বেগম বুকফাটা আর্তবিলোপ দিয়ে কান্নায় ভেঙে পড়েন। তিনি বলেন, পোলা আমার বাড়িত আইলে কতরকম ফল আনতো, নিজে পাশে বইসা আমারে খাওয়াইতো। কামাইর টাকা আইনা আমার হাতে দিতো। এহন আমার পোলায় নাই, খাইতেও পাই না। অন্য মাইনষের পুতে আনে আমি চাইয়া থাকি, আমার কি পেট ভরে? তিনি বলেন, আমার পুতেরে (ছেলে) তো আর ফিইরা পামু না। এই জন্য বড় পেলাডাও কুমিল্লায় কাজ করতো, তারেও এখন আর কাজ করতে দেই না। বাড়িতেই থাহে। মাইনুর বেগম বলেন, আমি বাইচা থাকতেই যেনো আমার পুতের হত্যার বিচার দেইখা যাইতে পারি। তিনি বলেন, যেই ডাকাইতেরা আমার পোলাডারে মারছে আমি তাদেরও মৃত্যু দেইখা যাইতে চাই।
ভোলার বোরহানউদ্দিন উপজেলার বড় মানিকা ইউনিয়নের উত্তর বাটামারা গ্রামের শহীদ নাহিদুল ইসলামের মা বিবি ফাতেমা বেগনের সাথে কথা হয়। তিনি বলেন, আমার মেয়ের পর আল্লায় একটা ছেলে দিছিলো, আমার সেই ছেলেডারে বুক থেইক্কা ছিনাইয়া নিয়া গেল, আমার বুকের মানিকরে ওরা গুলি কইরা মাইরা ফালাইছে। এখন আমার সংসারে বাত্তি জ্বালাইবার লোকটাও নাই। আমার পুতের (ছেলের) খুব মেধা ছিল পড়ার। নিজে চাকরি-বাকির করতো নিজে পড়াশোনাও করতো। বাপের সংসারে অভাব। নদী ভাঙছে কিছু নাই। চাকরি কইরা ভোলা কলেজে ভর্তি হইছে। আমি একটা ছেলে পাইয়া আল্লার কাছে বড় খুশি হইছিলাম। কিন্তু আল্লায় বুক থেকে ছিনাইয়া লইয়া গেল। একটা বছর হয়া গেছে, বাবার মুখটা দেখি না। আমার এখনো মনে হয় ঢাকা থেকে বাড়িতে আইবো। তিনি বলেন,আমি আমার ছেলে হত্যার বিচার চাই।
এভাবেই ভোলার শহীদ পরিবারগুলোতে এখনো চলছে কান্না-আহাজারি আর স্বজন হারানো আর্ত বিলাপের করুন ধ্বণী। কেউ কাঁদছে স্বামী হারিয়ে, কেউবা সন্তান। এ কান্না যেন সইবার নয়। এ কষ্ট যেনো চিরদিনের,চিরকালের।
ভোলার জেলা প্রশাসক মো. আজাদ জাহান বাসস'কে বলেন, জুলাই গণঅভ্যুত্থানে সবচেয়ে বেশি শহীদ হয়েছেন, ভোলার সন্তানরা। তিনি বলেন, স্বজন হারানো এসব পরিবারগুলোর ক্ষতি কখনোই পূরণ হবার নয়। তারপরও সরকারের পক্ষ থেকে শহীদ পরিবারগুলোর পাশে থাকার চেষ্টার কোনো ক্রুটি হচ্ছেনা। জেলা প্রশাসনের পক্ষ থেকেও বিভিন্ন সময়ে সহায়তা দেয়া হয়েছে। ভবিষ্যতেও যেকোনো প্রয়োজনে প্রশাসন তাদের পাশে থাকবে বলে জানান জেলা প্রশাসনের এ শীর্ষকর্তা।