বাসস
  ০২ জুলাই ২০২৫, ১৯:৫৬
আপডেট : ০২ জুলাই ২০২৫, ২০:০০

বিচারক হওয়ার স্বপ্ন ছিল সাহসী তরুণ জোবায়ের ওমরের

ছবি : বাসস-শহীদ জোবায়ের ওমর

প্রতিবেদন : নুসরাত সুপ্তি 

নারায়ণগঞ্জ, ২ জুলাই, ২০২৫ (বাসস) : স্বপ্ন ছিল বিচারকের আসনে বসে মানুষের ন্যায়ের সেবা করবেন। ছিলেন দৃঢ়চেতা, সাহসী, ন্যায়ের পথে অটল এক তরুণ। চব্বিশের ছাত্র-জনতার গণঅভ্যুত্থানে সম্মুখসারিতে থেকে আন্দোলন করেছেন, প্রাণ রক্ষা করেছেন অনেকের। শেষ পর্যন্ত স্বৈরাচার পতনের দিন নিজেই শহীদ হন জোবায়ের ওমর।

দিনটা ছিল ২০২৪ এর ৫ আগস্ট, সকালবেলা। বাড়ির পাশ্ববর্তী এক দোকানে খাবার কেনার জন্য গিয়েছিলেন। দোকানদার জোবায়েরকে বলে, তুমি তো নাকি আন্দোলনে যাও, এই জায়গায় তো অনেক ঝামেলা হয়, যাইও না।

জোবায়ের উত্তরে বলেছিল, আপনি আজকে সারাদিনে কত টাকা আয় করবেন? আমাকে বলেন, সেই টাকা আমি আপনাকে দিবো। চলেন দেশের জন্য আন্দোলনে যাই।’ এমন ছিল আমার ছেলে। দেশের প্রসঙ্গে বজ্রের মত কঠিন, পাহাড়ের মত অটল। কথা গুলো বলছিলেন জোবায়েরের বাবা সুপ্রীম কোর্টের ডেপুটি অ্যাটর্নি জেনারেল জাহাঙ্গীর আহমেদ।

সিদ্ধিরগঞ্জের দক্ষিণ কদমতলী এলাকানিবাসী জাহাঙ্গীর আহমেদ ও  নূরননেসার ছোট সন্তান ছিলেন জোবায়ের। তার বড় দুই ভাই ও এক বোন রয়েছে। বড় ভাই জাবেদ ইমরানও আইনপেশার সঙ্গে জড়িত। বোন মুসফিকা সিফাত জুডিসিয়াল ম্যাজিস্ট্রেট হওয়ার প্রস্তুতি নিচ্ছেন। 

পরিবারের সকলের মতো জোবায়েরও নিজেকে এই পেশায় দেখতে চেয়েছিলেন। তবে তার স্বপ্ন ছিল আরো মহৎ। বিচারকের চেয়ারে বসে মানুষের স্বার্থে কাজ করার ইচ্ছে ছিল জোবায়েরের। বাংলাদেশ ইউনিভার্সিটি অব প্রফেশনাল (বিইউপি)’র আইনবিভাগের শিক্ষার্থী ছিলেন জোবায়ের।

জাহাঙ্গীর আহমেদ জানান, নিরাপদ সড়ক আন্দোলনে জোবায়েরের ছিল সরব উপস্থিতি। নিজ হাতে প্লেকার্ড বানিয়ে কলেজের বন্ধুদের সাথে আন্দোলন করেন। সেই থেকে ন্যায়ের পথে শুরু হয় তার আন্দোলন সংগ্রাম। 

জাহাঙ্গীর আহমেদ বলেন, আমার ছেলে আন্দোলনে সক্রিয় ছিল। ওর ক্লাসে বন্ধুদের একত্রিত করে একসাথে আন্দোলন করত। পরে যখন সেই সময়ে হলগুলো বন্ধ করে দিলো। বন্ধুদের সাথে রুম গিয়ে উঠলো। পরিস্থিতি খারাপ হওয়ায় বাড়িওয়ালা বাড়ি ছেড়ে দেওয়ার পরামর্শ দিল। উপায় না পেয়ে বাড়িতে ফিরে আসে কিন্তু একদিনও আন্দোলনে যাওয়া বন্ধ করেনি। ওর কলেজের বন্ধুদের সাথে আন্দোলনে যোগদান করতো।

জোবায়েরের বাবা পাঁচ আগস্টের হৃদয়বিদারক স্মৃতি মনে করে বলেন, ‘মার্চ টু ঢাকা’ কর্মসূচির উদ্দেশ্যে সেদিন সকালের নাস্তা করেই বন্ধুদের সাথে রওনা হয় জোবায়ের। দুপুরে ওরা যাত্রাবাড়ী থানার কাছে পৌঁছলে ওদের ওপর হামলা হয়। তখন আমার ছেলের হাতের নিচে এসে গুলি লাগে। অনেকক্ষণ রাস্তায় পড়েছিল সে।

পরে কবির হোসেন নামক এক রিকশাচালক ওকে সেখান থেকে উদ্ধার করে শহরের অলিগলি হয়ে সলিমুল্লাহ মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে নিয়ে যায়। পরে জোবায়েরের বন্ধুরা খোঁজ পেয়ে সেখানে আসে।  হাসপাতালের জরুরি বিভাগের দায়িত্বরতডাক্তার জোবায়েরকে মৃত ঘোষণা করেন।

সারাদেশে যখন বিজয়ের উল্লাস শহীদ জোবায়েরের বাড়িতে তখন শোকের মাতম। দেশের পরিস্থিতি পুরোপুরি শান্ত হয়নি, তাই জোবায়ের মরদেহ বাসায় ফেরানো যায়নি। পরবর্তীতে তাকে তার দাদার বাড়ি ব্রাহ্মণবাড়িয়া জেলায় নিয়ে যাওয়ার সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়। কসবা থানার সৈয়দাবাদ গ্রামে তাদের পারিবারিক কবরস্থানে দাফন করা হয় তাকে।

জাহাঙ্গীর আহমেদ বলেন, ছেলেকে সেদিন রাতে আমরা আমাদের গ্রামে নিয়ে যাই। পরদিন সকালে সৈয়দাবাদ মাদরাসা মাঠে তাকে দাফন করা হয়।

এই বছর  জুলাই শহীদদের জন্য আয়োজিত এক ইফতার মাহফিলে জোবায়েরের বন্ধুদের সঙ্গে দেখা হয় জাহাঙ্গীর আহমেদের। জাহাঙ্গীর আহমেদ বলেন, জোবায়েরের ভার্সিটির ছোট ভাই আসিফ। সেদিন ও আমার কাছে এসে বলল, আঙ্কেল জোবায়ের ভাইয়ের কারণেই আজ আমি বেঁচে আছি।

আসিফ বলল, ‘ছাত্রলীগের ছেলেরা আন্দোলনের সময় একদিন আমাকে ধরে নিয়ে যায়, ভাই সাহস আর কৌশল করে সেখান থেকে আমাকে নিয়ে আসছিল। ভাই আমারে বাঁচাল কিন্তু ভাই আজকে নাই। ভাই আন্দোলনে অনেকেরেই বাঁচিয়েছে।’

জোবায়ের ছিলেন সাহসিকতার উজ্জল দৃষ্টান্ত। তার আন্দোলন সংগ্রামের স্মৃতি মনে করে তার বন্ধু প্রিন্স বলেন, আমাদের ভার্সিটি আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর কড়া নজরে ছিল। স্বৈরাচারের বাহিনী আমাদের অবরুদ্ধ করে অনেক নির্যাতন করেছিল। আমরা তবুও লড়েছি। আর আমাদের বীর নায়ক ছিল আমার বন্ধু জোবায়ের ওমর। ও কয়েকবার আহতও হয়েছে কিন্তু পিছপা হয়নি।

আন্দোলনের শুরু থেকে ৫ আগস্ট পর্যন্ত জোবায়ের ছিল সামনের সারির সৈনিক। কিন্তু বিজয়ের স্বাদ নেওয়ার সুযোগ হয়নি ওর। জোবায়েরের সংগ্রামের হয়তো কোনো ভিডিও ফুটেজ নেই। শহীদ মীর মাহফুজুর রহমান মুগ্ধের মতো আমরা ওরে নিয়েও গর্ব করি।   

জন্মের ছয়মাস পরেই মায়ের আদর-ভালোবাসা থেকে বঞ্চিত হন জোবায়ের। বড় বোনের কাছে মায়ের আদরে বড় হয়েছেন। মুসফিকা সিফাত বলেন, আমরা বড় দুই ভাই-বোন মায়ের ভালোবাসা কিছুটা পেলেও, জোবায়ের মায়ের ভালোবাসা একেবারেই পায়নি। জন্মের ছয় মাস পর মা স্ট্রোক করে মারা যায়। মায়ের কোন স্মৃতিও ওর নেই। আমার দাদু আর আমার বাবা ওকে আদর দিয়ে বড় করেছেন। 

তার প্রিয় ভাইকে স্মরণ করে মুসফিকা বলেন, ‘মাঝে মধ্যে ওকে ছাড়া এখন সবকিছু বিষাদময় লাগে। মনে হয়, ওকে জানাই, ‘জানো প্রিয় ভাইয়া, তোমার সাথে আমার কতো কথা জমা পড়ে আছে? রাতে খেতে বসলে তোমার সাথে কথা বলতে না পেরে আমার কষ্ট হয়। তুমি চলে যাওয়ার পর কী কী হয়েছে জানো? আর তোমার বন্ধুরা তোমার নিয়ে রাস্তার দেয়ালে দেয়ালে গ্রাফিতি এঁকেছে। ৩৬শে জুলাইয়ের পর দেশের নতুন খবর কী তুমি জানো? ওর চলে যাওয়াটা এখনও বিশ্বাস হয় না।’