শিরোনাম
প্রতিবেদন : ওবাইদুর রহমান, গাইবান্ধা থেকে ফিরে
ঢাকা, ২৬ জুন, ২০২৫ (বাসস) : ‘আমি শাকিনুরকে জীবিত অবস্থায় শেষ দেখাও দেখতে পারিনি। মোবাইল মারফত শুনে হাসপাতালে গিয়ে সবুজ কাপড়ে মোড়ানো অবস্থায় তার গুলিবিদ্ধ লাশটি দেখেছি। সে গুলিবিদ্ধ হয়ে শহীদ হয়েছিল তার বুকটা ছিল রক্তে ভেজা।’ কাঁদতে কাঁদতে এসব কথা বলছিলেন শহীদ শাকিনুর রহমানের স্ত্রী মোছাম্মৎ শারমিন আক্তার।
গত ৫ আগস্ট আশুলিয়ায় থানার সামনে শান্তিপূর্ণভাবে বিজয় মিছিলে অংশ নিতে গিয়ে গুলিবিদ্ধ হয়ে মৃত্যুবরণ করেন ২৭ বছর বয়সী শাকিনুর রহমান। শেখ হাসিনা পালিয়ে গেছে শুনে বিজয় মিছিলের সাথে আশুলিয়া থানার সামনে জনতা জড়ো হলে হঠাৎই পুলিশের গুলিতে রাস্তায় লুটিয়ে পড়েন অনেকে। তাদেরই একজন ছিলেন শাকিনুর।
শহীদ হওয়ার একদিন পর ৬ আগস্ট সকালে গ্রামের বাড়িতে জানাজা শেষে পারিবারিক কবরস্থানে তাকে দাফন করা হয়।
গাইবান্ধার পলাশবাড়ী উপজেলার কিশোরগাড়ি গ্রামের শাকিনুর রহমান- একটি নাম, যার পেছনে লুকানো আছে হারিয়ে ফেলা একটি শৈশবের গল্প। তিনি যখন মাত্র সাত বছরের শিশু, তখনই মায়ের স্নেহমাখা ছায়াটি চিরতরে হারিয়ে ফেলেন। বাকি জীবনটা চলে গেছে ‘মা’ ডাকের তীব্র অভাব আর আত্ননির্ভরতা গড়ে তোলার এক নীরব যুদ্ধের মধ্যে দিয়ে।
শাকিনুর রহমান ছিলেন ইবনে সাঈদ মন্ডল (৫৭) ও সীমা আক্তারের চার সন্তানের মধ্যে তৃতীয়।
অভাব অনটনের মাঝেও এসএসসি পাশ করেছিলেন। এরপর নিজেরই গ্রামের মেয়ে শারমিন আক্তারকে পারিবারিকভাবে বিয়ে করেন শাকিনুর। বিয়ের পর সংসারের হাল ধরতে ২০২০ সালে ঢাকায় আসেন। কাজ নেন আশুলিয়ার শামস গার্মেন্টসে। স্বচ্ছলতার জন্য চাকরির পাশাপাশি স্বল্প পুঁজিতে দোকানে দোকানে গার্মেন্টসের সে সব প্যান্ট সরবরাহ করতেন। শারমিনও বসে থাকেননি, সংসারে বাড়তি আয়ের জন্য প্রাইম বিডি লিমিটেডে ক্যাপ তৈরির কাজ শুরু করেন।
স্বামীর সঙ্গে শেষ মুহূর্তের স্মৃতি জানতে চাইলে কাঁদতে কাঁদতে শারমিন আক্তার বললেন, ‘৫ আগস্ট তারিখ ওর সঙ্গে তেমন কোনো স্মৃতি নেই। আমাদের শেষ একসাথে খাওয়া হয়েছিল ৪ তারিখ রাতে। ঘটনার দিন আমি ঘুমিয়ে ছিলাম। সকালে ও একাই খেয়ে বাড়ি থেকে বেরিয়ে যায়।’
‘৪ তারিখ সেই একসাথে রাতের খাবার খাওয়াটাই এখন আমার হৃদয়ে সবচেয়ে মূল্যবান স্মৃতি হয়ে আছে।’ আমার শিশু সন্তান এতিম হয়েছে।
তিনি বলেন, ‘সংসারের চাপের মধ্যেও দেশের ভবিষ্যৎ নিয়ে চিন্তা ছিল তার। সন্তান ও সংসারের জন্য ভাবত। বলত আমাদেরও তো সন্তান আছে। ওর ভবিষ্যৎ আছে। শুধু চুপ করে বসে থাকলে চলবে না। প্রায়ই বলতেন সবাইকে আন্দোলনে যেতে হবে।’
শাশুড়ি আম্বিয়া বেগম (৪০) স্মৃতিচারণ করতে গিয়ে বলেন, ‘শাকিনুর ভদ্র, শান্তশিষ্ট ও বিনয়ী মানুষ ছিল।
আমাদের প্রতিবেীশী ছিল ছোটবেলা থেকে তাকে দেখেছি। নিয়মিত ৫ ওয়াক্ত নামাজ পড়ত। আশেপাশের সবাই তাকে শ্রদ্ধা করত।’
কথা বলতে বলতে কান্না ভেজা কণ্ঠে তিনি বলেন, ‘আমি তাকে নিজের ছেলের মতোই দেখতাম। তখন আমাদের পারিবারিক অবস্থাও ভালো ছিল না। কিন্তু সে এসে বলেছিল: আমার মা নেই। আপনার মেয়েকে বিয়ে করলে আপনি আমার আম্মা হবেন। ওর সেই তখনকার বলা কথাটা আজও ভুলতে পারি না।’
আম্বিয়া বেগম আরও জানালেন, ‘ও প্রতি শুক্রবার নাতিকে নিয়ে নামাজে যাওয়ার আগে আমাদের সাথে দেখা করে নিয়ে যেত।
আক্ষেপ করে তিনি বলেন, এই ভালো মানুষ ছেলেটা আমার আগে দুনিয়া ছেড়ে চলে গেল। আমি শুধু জামাই না, আমার ছেলেকে হারালাম। আমার নাতিটা এতিম হয়ে গেল।
শহীদ শাকিনুরের রেখে যাওয়া একমাত্র সন্তান শোয়াইব মাহমুদ (৬) গাইবান্ধার পলাশবাড়ী উপজেলার কিশোরগাড়ি সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের প্রথম শ্রেণিতে পড়ছে। বাবাহারা এই শিশু এখন গ্রামে অনিশ্চয়তায় বড় হচ্ছে।
স্বামীর মৃত্যুর পর সরকারি-বেসরকারি কী সহায়তা পেয়েছেন জানতে চাইলে শারমিন আক্তার জানান, ‘জুলাই শহীদ স্মৃতি ফাউন্ডেশন থেকে ৫ লাখ টাকা, জামায়াতে ইসলামীর পক্ষ থেকে ২ লাখ টাকা, আস-সুন্নাহ ফাউন্ডেশন থেকে ১ লাখ টাকা, আর জেলা পরিষদ থেকে ২ লাখ টাকা সহায়তা পেয়েছি।’
তিনি বলেন, যে স্বপ্ন নিয়ে আমরা স্বামী পথে নেমেছিল সেই স্বপ্ন অসম্পূর্ণ রয়ে গেল। নিজের ও সন্তানের জন্য নতুন লড়াইয়ে নামতে হচ্ছে। আমি শাকিনুরকে হারিয়ে চারদিকে অন্ধকার দেখছি।
যারা বৈষম্যবিরোধী আন্দোলনে শহীদ হয়েছেনে তাদের স্বজনদের কল্যাণে সরকারেরদৃষ্টি আকর্ষণ করে দ্রুত অপরাধীদের সুষ্ঠু বিচার কামনা করেন।
তিনি বলেন, ‘যোগ্যতা অনুযায়ী আমাকে যদি সরকার একটি স্থায়ী চাকরির ব্যবস্থা করে দিলে সন্তানের ভবিষ্যৎ নিয়ে নিশ্চিন্ত হতে পারব।’