বাসস
  ২৬ জুন ২০২৫, ১৭:৩২
আপডেট : ২৬ জুন ২০২৫, ২০:৩৭

ফ্যাসিস্ট হাসিনাকে উৎখাত করতে জীবন দিতে হবে : মাকে বলেছিলেন রেদওয়ান

শহীদ হাফেজ রেদওয়ান ইসলাম : ছবি : বাসস

প্রতিবেদন : মো. মামুন ইসলাম

রংপুর, ২৬ জুন, ২০২৫ (বাসস) : নিজের সদা হাস্যোজ্জ্বল ছেলের দেশপ্রেমের কথা স্মরণ করে আজও আকাশের দিকে তাকিয়ে কাঁদেন আর আল্লাহর কাছে মোনাজাত করেন শহীদ হাফেজ রেদওয়ান ইসলামের মা ৪৬ বছর বয়সী মল্লিকা খাতুন।

২০২৪ সালের জুলাই মাসের শুরু থেকেই বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনে প্রতিদিন সম্মুখ সারিতে ছিলেন রেদওয়ান, যেমন তিনি নামাজেও মসজিদের প্রথম কাতারে দাঁড়াতে ভালোবাসতেন।

মা যখন তাকে আন্দোলনে যেতে নিষেধ করতেন, রেদওয়ান বলতেন, ‘মা, দুনিয়ার সবচেয়ে ভয়ংকর ফ্যাসিস্ট হাসিনাকে উৎখাত করতে আমাদের জীবন দিতে হবে। অনেক মা তাদের ছেলেদের রক্ত দিয়ে দিচ্ছেন।’ মৃত্যুর দিনও বলেছিলেন, ‘ফ্যাসিস্ট হাসিনার শাসন উৎখাত করে দেশকে শয়তান ডাইনির হাত থেকে মুক্ত করতে জীবন বিসর্জন দেওয়া ছাড়া কোনো পথ নেই।’

বাবাও আন্দোলনে যেতে নিষেধ করতেন। তখন রেদওয়ান বলতেন, ‘আমি যদি মিছিলে গিয়ে শহীদ হই, আপনারা শহীদের গর্বিত বাবা-মা হবেন। তখন আমার ছেলেকে হাফেজ বানাবেন।’

পরিবারের নিষেধ সত্ত্বেও রেদওয়ান গোপনে আন্দোলনে যেতেন। স্ত্রী রোকাইয়াও তাদের ১৬ মাস বয়সী একমাত্র ছেলে বায়েজিদ বোস্তামীর কথা ভেবে তাকে নিষেধ করতেন। কিন্তু রেদওয়ান বলতেন, ‘আমি আল্লাহর হাতে নিজেকে সঁঁপে দিয়েছি। তিনিই তোমাদের জন্য যথেষ্ট।’

১৬ জুলাই বেগম রোকেয়া বিশ্ববিদ্যালয়ে পুলিশের গুলিতে ইংরেজি বিভাগের মেধাবী ছাত্র আবু সাঈদের মৃত্যু তাকে মানসিকভাবে ভীষণভাবে প্রভাবিত করে। আবু সাঈদের বুক পেতে পুলিশের গুলিতে শহীদ হওয়ার ভিডিও সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে ভাইরাল হয়, দেশজুড়ে প্রতিবাদ ছড়িয়ে পড়ে। তখন রেদওয়ান বলেন, ‘এই অবিচার সহ্য করা যায় না।’
 
রেদওয়ানের বাবা সাইদুল ইসলাম, মা মল্লিকা খাতুন, বড় ভাই আবদুর রহিম, বোন সাদিকা, আত্মীয়স্বজন বাসসকে তার সংগ্রামী জীবন, দারিদ্র্য, ধার্মিকতা ও আত্মত্যাগের গল্প বর্ণনা করেন।

রেদওয়ানের জন্ম ২০০১ সালের ১ জুলাই, রংপুর জেলার বদরগঞ্জ উপজেলার শিমুলতলী গ্রামের এক ভূমিহীন দরিদ্র কৃষক পরিবারে। বাবা মো. সাইদুল ইসলাম (৫০) ছিলেন দিনমজুর, মা গৃহিণী।

২০১৩ সালে দারিদ্র্য সহ্য করতে না পেরে পুরো পরিবার নিয়ে গাজীপুরের টঙ্গীতে চলে আসেন। বর্তমানে তারা বনামালা রোডের দত্তপাড়ায় ভাড়া বাসায় থাকেন।

রেদওয়ান ছোটবেলায় থেকেই রাস্তায় টুপি ও আতর বিক্রি করতেন, সেই আয়ে তিনি টঙ্গীর আবু বকর সিদ্দিক (রহ.) হাফিজিয়া মাদ্রাসায় পড়েন এবং ২০১৯ সালে হাফেজ হন।

বড় ভাই আবদুর রহিম (২৯) বর্তমানে টঙ্গীতে ‘মায়ের দোয়া’ নামের ছোট হোটেল চালান। বোন সাদিকা গার্মেন্টসে কাজ করেন, স্বামী-সন্তান নিয়ে থাকেন টঙ্গীতেই। দুই ছোট ভাইও আবু বকর সিদ্দিক (রহ.) হাফিজিয়া মাদ্রাসায় কোরআন হিফজ করছেন।

২০২৩ সালে গোপালগঞ্জ সদরের ভূমিহীন কুব্বত শেখের কন্যা রোকাইয়ার (১৯) সঙ্গে রেদওয়ানের বিয়ে হয়। তাদের একমাত্র ছেলে বায়েজিদ এখন ১৬ মাস বয়সী।

৪ আগস্ট রাতে মা মল্লিকা খাতুন পোলাও আর মুরগি রান্না করেছিলেন। রেদওয়ান স্ত্রী রোকাইয়াকে নিয়ে খেয়েছিলেন। পরদিন সকালেও মা রুই মাছ ও লাউয়ের তরকারি রান্না করেন। রেদওয়ান বলেন, ‘মা, আমি তো লাউ খাই না, কিন্তু আজ এত মজা হইছে!’

জোহরের নামাজ শেষে বলেন, ‘ফ্যাসিস্ট হাসিনার পতনের বিজয় উদ্যাপন করতে যাচ্ছি।’ এরপর আর ফেরেননি। বিদায়ের সময় মাকে বলেছিলেন, ‘মা, আমি যদি শহীদ হই, রোকাইয়াকে সান্ত্বনা দিও।’

বড় ভাই বলেন, উত্তরা পূর্ব থানার সামনে মিছিল চলার সময় বিকেল সাড়ে পাঁচটায় রেদওয়ান গুলিবিদ্ধ হন। সাড়ে সাতটার দিকে অচেনা একজন রেদওয়ানের ফোনে জানায়, তিনি হাসপাতালে।

ভাই হাসপাতালে গিয়ে দেখেন, চিকিৎসাহীন অবস্থায় রেদওয়ানের রক্তাক্ত দেহ কুয়েত-বাংলাদেশ মৈত্রী হাসপাতালের বারান্দায় পড়ে আছে। কাঁদতে কাঁদতে ডাক্তারদের পায়ে ধরেও কাজ হয়নি। চারটি গুলি তার শরীরে ঢুকেছিল, হাড় ভেঙে যায়, কিডনি, মূত্রথলি নষ্ট হয়ে যায়, একটি গুলি কাঁধে আটকে যায়।

৬ আগস্ট ভোর সাড়ে পাঁচটায় তাকে ঢামেকে নেওয়া হয়, কিন্তু চিকিৎসা না পেয়ে রাত নয়টার দিকে তার মৃত্যু হয়।

৭ আগস্ট রাত দেড়টায় লাশ নিয়ে রওনা দেন টঙ্গী থেকে। গোসল করিয়ে সকাল ৭:৩০ুএ পৌঁছেন শিমুলতলী গ্রামে। সকাল ১১টায় সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় মাঠে জানাজা শেষে পারিবারিক কবরস্থানে দাফন করা হয়।

রেদওয়ানের বাবা সাইদুল ইসলাম আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালে ক্ষমতাচ্যুত প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাসহ ৪৮ জনের বিরুদ্ধে মামলা করেছেন।

তিনি বলেন, ‘রেদওয়ান শহীদ হতে চাইত। আল্লাহ তার ইচ্ছা পূরণ করেছেন। আমি গর্বিত এক শহীদের পিতা হিসেবে।’

মা মল্লিকা খাতুন কাঁদতে কাঁদতে বলেন, ‘আমার নিষ্পাপ ছেলেকে যারা মেরেছে, আমি তাদের ফাঁসি চাই।’