বাসস
  ২৫ জুন ২০২৫, ২১:০৭
আপডেট : ২৫ জুন ২০২৫, ২২:৩৪

দেখবে, মানুষ তোমাদের আমার নামেই চিনবে : বাবা-মা ও বোনদের বলতো শহীদ নূর

শহীদ সামিউ আমান নূর। ছবি : বাসস

প্রতিবেদক : মুহাম্মদ হেদায়েত উল্লাহ

গাজীপুর, ২৫ জুন, ২০২৫ (বাসস): ‘তেরো বছরের কিশোর শহীদ সামিউ আমান নূর মা, বাবা ও বোনদের বলত: আমি বড় হয়ে বিজ্ঞানী হব। আমি অনেক নাম করব। দেখবে, মানুষ তোমাদের নূরের বাবা-মা, নূরের বোন বলে ডাকবে। কে জানতেন, নূরের সেই কথাই সত্য হবে। সবাই এখন আমাদের শহীদ নূরের বাবা-মা বলেই চিনছে।’

গত পাঁচ আগস্ট ছাত্র-জনতার গণ-অভ্যুত্থানের মুখে শেখ হাসিনা পালিয়ে যাওয়ার পর লাখো মানুষের বিজয় মিছিল চলাকালে উত্তরার বিএনএস সেন্টারের সামনে ফ্লাইওভারের ওপর ঘাতকদের গুলিতে প্রাণ হারান সামিউ আমান নূর (১৩)। তার বাবা মো. আমান উল্লাহ (৫৮) ও মা শাহানুর আমান (৪২) বাসসকে কান্নাজড়িত কণ্ঠে কথাগুলো বলেন।

টঙ্গীর পূর্ব আরিচপুর গাজীবাড়ি এলাকার বাসিন্দা এই দম্পতি দুই কন্যা সন্তানের পর আল্লাহর কাছে অনেক চেয়ে একমাত্র পুত্র সন্তান সামিউ আমান নূরকে (১৩) পেয়েছিলেন। 

শহীদ নূরের মা শাহানুর আমান বাসসকে বলেন, ‘দুই মেয়ে জন্মের অনেক পর আমাদের কোল আলোকিত করে এই ছেলেটি আসে। ছেলের নামও আদর করে রেখেছিলাম নূর (আলো)। দেখতে অনেক সুন্দর ও মায়াবী চেহারার নূরকে দেখে আত্মীয়-স্বজন ও পাড়া প্রতিবেশীরাও বলতেন, ‘নূর নামটা ওর জন্য একদম ঠিক আছে। আপনার ছেলে নূরের মতই সুন্দর।’ 

বড় দুই বোনও তাদের একমাত্র ছোট ভাইকে অসম্ভব আদর করত। সুন্দর আচার-ব্যবহারের জন্য এলাকার লোকজনও তাকে ভালো ছেলে হিসেবে জানত। সামিউ আমান নূর টঙ্গীর সিরাজউদ্দিন সরকার বিদ্যানিকেতনে সপ্তম শ্রেণিতে পড়ত। খেলাধুলা ও লেখাপড়ায় নূর অনেক ভালো হওয়ায় শিক্ষকরাও নূরকে খুব আদর করতেন।

তিনি বলেন, ‘৫ আগস্টের আগেও নূর ছাত্রদের সাথে আন্দোলনে যেতো কিন্তু আমাদের সে কখনও জানায়নি। আমার ছেলের মৃত্যুর পর তার বন্ধুদের কাছ থেকে জানতে পারি, ১৯ জুলাই উত্তরার ঘটনায় নূরের পায়ে পুলিশের রাবার বুলেট লেগেছিল। তারপরও আমার ছেলে আমাদের কিছুই জানায়নি। কিছুটা খুঁড়িয়ে হাঁটতে দেখেছি। ভেবেছিলাম, খেলতে গিয়ে হয়তো ব্যথা পেয়েছে।’

তিনি জানান, ৫ আগস্ট সকাল থেকে নূর ঘরে ছিল। দুপুরের পর আমরা টিভির খবরে জানতে পারি, শেখ হাসিনা পদত্যাগ করে পালিয়ে গেছে। এই খবর শুনে নূর খুশিতে চিৎকার করে ওঠে। গ্রামের বড়িতে তার বাবাকে ফোন দিয়ে জানায়, শেখ হাসিনা পালিয়ে গেছে। তুমি তাড়াতাড়ি চলে আসো। এরপর তার বন্ধুরা বিজয় মিছিলে যাচ্ছে শুনে নূরও দৌড়ে তাদের সঙ্গে বিজয় মিছিলে চলে যায়। 

শহীদ নূরের মা শাহানুর আমান বলেন, ‘আমার নূরের সেই যাওয়া যে শেষ যাওয়া হবে তা তো জানতাম না। ঘাতকরা আমার ছেলেরে মেরে ফেলবে জানলে তো ঘর থেকে বের হতে দিতাম না।’

শহীদ নূরের মা শাহনা আমান আরো বলেন, ‘আমার ছেলে নামাজ পড়ত, রোজা রাখত, কোরআন পড়ত। কারো সাথে ঝগড়া করত না, কারো মনে কষ্ট দিত না। আমি তো ভাবতেই পারছি না, আমার নূর আর নাই। আল্লাহ যেন ওরে শহীদ হিসেবে কবুল কইরা লয়। আমি আর কিচ্ছু চাই না। আমি চাই, আমার ছেলের রক্ত যেন বৃথা না যায়।’ 

কথাগুলো যখন নূরের মা বলছিলেন তখন বারবার কান্নায় তার কণ্ঠ রুদ্ধ হয়ে আসছিল। পাশে বসা নূরের বাবা ও বড় দুই বোন আফরিন আমান (২১) ও আফসানা আমানের (১৯) বুক ফাটা কান্নায় প্রতিবেদকের সামনেই এক হৃদয়বিদারক পরিবেশ তৈরি হয়।

নূরের বাবা মো. আমান উল্লাহ নিজেকে কিছুটা সংবরণ করে কথা বলার চেষ্টা করেন। তিনি বাসসকে জানান, ১৯৯১ সাল থেকে তিনি দীর্ঘদিন প্রবাসে ছিলেন। প্রবাসের কষ্টের আয়ে টঙ্গীর পূর্ব আরিচপুরে একটি ছোট দুই তলার বাড়ি করেন তিনি। এখানেই নূরের জন্ম হয়।

২০১১ সালে নূরের জন্মের পর তিনি আর প্রবাসে যাননি। এরপর থেকে বাড়ি ভাড়া দিয়েই সংসার চালান। গত ৫ আগস্ট পারিবারিক প্রয়োজনে তিনি চাঁদপুর গ্রামের বাড়িতে ছিলেন। ওইদিন বিকাল ৩টার দিকে ছেলে নূর ফোন করে সর্বপ্রথম শেখ হাসিনা পালিয়ে যাওয়ার খবর দেন।

তিনি বলেন, ‘এরপর বিকাল ৫টার দিকে ফোনে জানতে পারি, আমার ছেলে নূর উত্তরা বিএনএস সেন্টারের সামনে ফ্লাইওভারের ওপর গুলিবিদ্ধ হয়েছে। সন্ধ্যা ৭টার সময় আমাকে জানানো হয় আমার ছেলে নূর শাহাদাত বরণ করেছে।’ কান্নাজড়িত কণ্ঠে তিনি বলেন, ‘আমার ছেলেকে আমি খুব ভালোবাসতাম।’

আমান উল্লাহ  বলেন, ‘আমার নূর বলতো: বাবা, আমি বড় হয়ে বিজ্ঞানী হতে চাই। দেখবে আমি অনেক নাম করব। তোমাদের আমার নামেই সবাই  চিনবে। শহীদ নূরের বাবা বলেন, ‘আমি আমার ছেলেসহ সকল হত্যার বিচার চাই। আমি আর কিছু চাই না।’

শহীদ নূরের গৃহশিক্ষক শাহাদাত হোসেন বাসসকে জানান, ‘গুলিবিদ্ধ অবস্থায় নূরকে প্রথমে টঙ্গী আহসান উল্লাহ মাস্টার জেনারেল হাসপাতালে নেয়া হয়। আমরা গিয়ে দেখি একটি গুলি নূরের কপালে ঢুকে মাথার পেছন দিয়ে বের হয়ে গেছে। হাসপাতালে নূর আমাকে দেখে কী যেন বলতে চেয়েছিল। কিন্তু বলতে পারেনি।’

তিনি বলেন, ‘তখনও প্রচুর রক্তক্ষরণ হচ্ছিল। অবস্থা আশঙ্কাজনক হওয়ায় প্রাথমিক চিকিৎসা দিয়ে ডাক্তার তাকে দ্রুত ঢাকা মেডিকেলে নিয়ে যেতে বলেন। আমরা ঢাকা মেডিকেলের উদ্দেশে উত্তরা জসিম উদ্দিন রোড পর্যন্ত যেতে পারি। এরপর রাস্তায় ব্যাপক সংঘাতময় পরিস্থিতির কারণে আর যেতে পারিনি। অ্যাম্বুলেন্স ঘুরিয়ে তাকে উত্তরা আধুনিক মেডিকেলে আনার পর ডাক্তার দ্রুত আইসিউতে ভর্তি করেন। প্রচুর রক্তক্ষরণ হওয়ায় ডাক্তারের পরামর্শে আমরা হাসপাতাল থেকেই রক্তের ব্যবস্থা করি। কিন্তু প্রথম ব্যাগ রক্ত শেষ হওয়ার আগেই নূর শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করে।’

তিনি বলেন, নূরের লাশ টঙ্গীতে আনার পর এলাকায় শোকের ছায়া নেমে এসেছিল। এলাকার কোনো মানুষ নূরের এমন মর্মান্তিক মৃত্যু মেনে নিতে পারছিল না। ওইদিন নূরের প্রথম জানাজা অনুষ্ঠিত হয় টঙ্গীর পূর্ব আরিচপুর গাজীবাড়ি ঈদগাহ মসজিদে। এরপর রাতেই তার স্থায়ী ঠিকানা চাঁপুরের কচুয়া উপজেলার বাঘমারা গ্রামে লাশ পৌঁছে। পরদিন ৬ আগস্ট সকালে দ্বিতীয় জানাজা শেষে তাকে দাদার কবরের পাশে দাফন করা হয়।

নূরের শিক্ষক মো. শাহাদাত হোসেন বলেন, ‘নূর অনেক ভালো ছাত্র ছিল। সবচেয়ে ভালো ছিল ইংরেজি ও বিজ্ঞানে। আমি তাকে ছোট থেকেই পড়াতাম। তার একটা সুন্দর মন ছিল। আমার বাসা তাদের বিল্ডিংয়ের নিচতলায়। তার বাসায় ভালো কিছু রান্না করলেও সে আমার জন্য নিয়ে আসত। রমজান মাস আসলে আমাকে ডেকে নিয়ে মসজিদে যেত। রমজানে সব রোজা রাখত।’

বাংলাদেশ জামায়াতে ইসলামী, জুলাই শহীদ স্মৃতি ফাউন্ডেশন ও সরকারের পক্ষ থেকে দেওয়া সব অনুদান পেয়েছেন বলে নূরের বাবা আমান উল্লাহ বাসসকে জানিয়েছেন।