বাসস
  ১৯ জুন ২০২৫, ২১:৩৬

ফ্যাসিস্ট শেখ হাসিনাকে হটাতে শহীদ হন কিশোর সোহাগ

ছবি: বাসস

প্রতিবেদন : মো. মামুন ইসলাম

রংপুর, ১৯ জুুন, ২০২৫ (বাসস) : চরম দারিদ্র্েযর কারণে সতেরো বছর বয়সী কিশোর মো. সোহাগ মাদ্রাসায় পড়াশোনা চালিয়ে যেতে পারেনি, আট পারা কোরআন মুখস্থ করলেও পুরো হাফেজ হতে পারেনি।

গত বছরের ১৯ জুলাই জুমার দিন, পছন্দের ভর্তা ও ডাল-ভাত রান্না করেছিলেন মা সালমা বেগম। জুমার নামাজ শেষে ঘরে ফিরে খাবার কথা ছিল সোহাগের, কিন্তু তার আর ফেরা হয়নি।

সেদিন সকালে মা একটি সাদা বালিশের কভার সেলাই করছিলেন, সোহাগ বলেছিল, সাদা রঙ তার পছন্দ, সে ওই বালিশে মাথা রেখে ঘুমাবে। কিন্তু সেদিনই নিষ্ঠুর নিয়তি তাকে নিয়ে যায় চিরনিদ্রার দেশে। মায়ের হাতে সেলাইকরা বালিশে ঘুমাতে আর ফেরেনি সে।

জুমার নামাজ শেষে সোহাগ সাদা পাঞ্জাবি-পায়জামা ও টুপি পরে পবিত্র বেশে অংশ নিয়েছিল বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের মিছিলে। এ সময় পুলিশের গুলি তাকে খুব কাছ থেকে বিদ্ধ করে। শহীদ হয় সোহাগ।

রংপুর জেলার পীরগঞ্জ উপজেলার শনেরহাট ইউনিয়নের দুর্গম বড় পাহাড়পুর গ্রামে সোহাগের বাবা-মা ও বড় ভাই বাসস প্রতিনিধিকে এসব কথা বলেন।

সোহাগের বাবা মো. রেজাউল মিয়া (৫২) ভূমিহীন, অতি দরিদ্র দিনমজুর; মা সালমা বেগম (৪৫) গৃহিণী।

২০০৯ সালে দারিদ্র্েযর কারণে পরিবার নিয়ে ঢাকার আশুলিয়ায় পাড়ি জমান রেজাউল। ছোট্ট সোহাগকে তার দাদির কাছে রেখে যান।

রেজাউল আশুলিয়ায় একটি গার্মেন্টসে লোডার হিসেবে কাজ করতেন এবং তার স্ত্রীও একটি গার্মেন্টসে হেলপার হিসেবে কাজ করতেন।

সোহাগের বড় ভাই সোহেল ১২ বছর বয়সে একটি চায়ের দোকানে ৮০০ টাকা বেতনে কাজ করত শুরু করেন। পরে তিনি সেলাই শিখেন এবং একই গার্মেন্টসে চাকরি পান। তিনি ২০১৫ সালে বিয়ে করেন এবং দুই সন্তানের পিতা হন।

সোহেল পরবর্তীতে নিজস্ব গার্মেন্টস ফ্যাক্টরি খোলেন। ব্যবসা ভালোই চলছিল। কিন্তু এক পর্যায়ে ভারতীয় ব্যবসায়ী চুমুদাস সাহা এবং প্রভাবশালী আওয়ামী লীগপন্থী অংশীদার ও ম্যানেজারের প্রতারণায় পড়ে তিনি সর্বস্বান্ত হন এবং স্ট্রোক করে পক্ষাঘাতে আক্রান্ত হন।

এই ঘটনাগুলোর সাক্ষী ছিল সোহাগ। সে অসহায়ভাবে দেখেছে কিভাবে তার পরিবারের সর্বনাশ করেছে আওয়ামী লীগপন্থীরা। তখন থেকেই সোহাগের মনে আওয়ামী লীগের প্রতি ঘৃণা জন্ম নেয়।

পরে সোহেল উত্তর বাড্ডায় ছোট একটি দোকানে সেলাইয়ের কাজ শুরু করেন। সোহাগ একটি প্রিন্টিং প্রেসে ৭,৫০০ টাকা বেতনে চাকরি পায়। বাবা রিকশা চালায়, মা ছাত্রাবাসে রান্নার কাজ করে। একটু একটু করে তাদের জীবনে স্বচ্ছলতা ফিরতে শুরু করে।

২০২৪ সালের জুনে সোহেল সব ঋণ পরিশোধ করেন। এরপরই শুরু হয় জুলাই আন্দোলন। শহীদ আবু সাঈদের মৃত্যুর পর আন্দোলন আরও তীব্র ও বেগবান হয়।

১৮ জুলাই সোহাগ নাটোরে স্ত্রীর কাছে যায়, সেখানে বড় ভাই ফোনে অনুরোধ করে যেন আন্দোলনে না যায়। জবাবে সোহাগ বলে, ‘কেউ ঘরে বসে থাকলে চলবে না, শেখ হাসিনার ফ্যাসিস্ট সরকার পতন না হওয়া পর্যন্ত আন্দোলন চালিয়ে যেতে হবে।’

১৯ জুলাই শুক্রবার, সোহাগ সকাল ১০টায় ঘুম থেকে উঠে তার পোষা কবুতরদের নিয়ে খেলে, মায়ের দুপুরে ভর্তা ও ডাল-ভাত রান্না করতে বলে। বিকেলে সাদা পাঞ্জাবি, পায়জামা ও টুপি পরে সে জুমার নামাজে যায়। কিন্তু সে আর ফিরে আসেনি।

বিকাল সাড়ে ৩টার দিকে প্রতিবেশীদের কাছ থেকে খবর পেয়ে বাবা রেজাউল বাড্ডার একটি হাসপাতালে যান। সেখানে মৃতদেহের তালিকায় ২৫-৩০টি লাশের মধ্যে সোহাগের নিথর দেহ দেখতে পান। তিনি জ্ঞান হারান।

রিকশায় করে লাশ বাড়িতে নিতে গেলে আওয়ামী লীগ সমর্থকরা বাধা দেয়। তারা লাশ ছিনিয়ে নিতে চায়, পুড়িয়ে দেওয়ার হুমকি দেয়। তখন আশপাশের চালকরা মানুষের কাছে চাঁদা তুলে ৫০ হাজার টাকা সংগ্রহ করেন এবং ৩০ হাজার টাকায় অ্যাম্বুলেন্স ভাড়া করা হয়।

তবুও বাধা পেয়ে পিকআপ ভ্যানে করে গভীর রাতে রওনা দেন রেজাউল। পরদিন সকাল ৬টায় গ্রামে পৌঁছে সকাল ১১টায় ছেলের দাফন সম্পন্ন করেন।

এরপর থেকে তারা ঢাকায় ফেরেননি, গ্রামেই বসবাস করছেন।