শিরোনাম
প্রতিবেদন : সেলিনা শিউলী
ঢাকা, ২৭ মে, ২০২৫ (বাসস) : দিনবদলের স্বপ্নে বৈষম্যের বিরুদ্ধে আন্দোলন করতে গিয়ে শহীদ হলেন মিরপুরের বাসিন্দা মোহাম্মদ বাপ্পী আহমেদ।
মিরপুর এগারো নাম্বারের বি ব্লকের ২০ নম্বর রোডে পরিবারের সাথে বাস করতেন বাপ্পী। ৩৫ বছর বয়সের বাপ্পী দুইবছর আগে স্ত্রীকে হারান। পাঁচ বছরের তাসফিয়া আহমেদ নামে তার একটি সন্তান আছে।
মায়ের নাম সুরাইয়া আহমেদ। বয়স ৫৫ বছর। প্রাইভেট কার চালক শাহেদ আহমেদ ৬০ বছর বয়সে স্ট্রোকের পর অবসরে ছিলেন। বর্তমানে রোগী হয়েও সন্তানের মৃত্যুর পর পরিবারের দায়িত্ব কাঁধে তুলে নিয়েছেন। একমাত্র বোন উমাইমা আহমেদ (২৩) বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় ইন্টারন্যাশনাল ইউনিভার্সিটি অব স্কলার্সে কম্পিউটার ইঞ্জিনিয়ারিংয়ে ফাইনাল ইয়ারে পড়ছেন।
উমাইমা আহমেদ জানান, কোটা আন্দোলন যখন শুরু হয়, তার শুরুর দিকে একদিন আমাকে ডেকে বললো, এবার ছাত্ররা মাঠে নেমেছে, দেখিস একটা দারুণ কিছু হবে। আসলেই দেশটার বদল দরকার। প্রতিদিন আন্দোলনে কী কী হতো তা নিয়ে সব আলাপ করত। আবু সাঈদ ও মুগ্ধ শহীদ হওয়ার পরে বাসায় এসে অনেক উদ্দীপনা নিয়ে আলাপ করেছিল।
জুলাইয়ের শেষের দিকে একদিন রাত দুইটার সময় বাসায় ফিরে এলে আমি অভিমান করে বলেছিলাম, ইউ আর টু লেট। কিছু না বলে রুমে চলে গিয়েছিল। রাত তখন আড়াইটা। আমি শুয়ে ছিলাম হঠাৎ এসে বলে, সাদিয়া চলো, দুজনে আন্দোলনে যাব। ওর কথায় অনুপ্রাণিত হয়ে বললাম যাব।
জুলাইয়ের শেষের দিকে আন্দোলন অনেক তুঙ্গে ও বেশ জোরালো ছিল। সারাদেশে প্রতিদিন গোলাগুলি, হত্যা-এসব তুমুলভাবে চলছিল। ঢাকায়ও চলছিল আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর নির্বিচার গুলি, হত্যা। নানাদিক থেকে খবর আসছিল। বললাম, দেশের অবস্থা ভালো না। বলল, সমস্যা কী? একদিন তো মরতেই হবে। আন্দোলন করে বীরের মতোই মরব। সে মৃত্যু হবে অনেক গৌরবের।
তিনি বলেন, আমি বললাম, তোমার ছোট্ট একটা মেয়ে আছে, যদি কিছু হয় তোমার, ওকে কে দেখবে? ওর মাও তো বেঁচে নাই। তুমি এমন সিদ্ধান্ত নিও না। বাপ্পী বলল, আল্লাহ ভরসা। কোনো সমস্যা হবে না।
পরের দিন সকাল বেলা আমি ঘুম থেকে উঠে দেখি সে বাসায় নেই। আমি ভয় পেয়ে আম্মুকে বললাম, ভাইয়া কই গেছে তুমি জানো? আম্মু বলল, আমাকে বলে যায় নাই। কোথাও হয়তো গেছে। সারাদিনে কোনো খবর নাই। মোবাইলেও কোনো যোগাযোগ হয় নাই। আমিও লেখাপড়া আর সংসারের কাজ নিয়ে ব্যস্ত ছিলাম।
সন্ধ্যার দিকে ভাইয়া বাসায় আসলো। আমি জানতে চাইলাম, তুমি সারাটা দিন কোথায় ছিলে? সে বিব্রত হয়ে বলল, এই তো , বন্ধুবান্ধব অনেকেই ছিল আড্ডা দিচ্ছিলাম। আসলে ঘটনাটা বলেনি।
এর পরের কয়দিন স্বাভাবিক ছিল তার চলাফেরা। কোনো কিছু সন্দেহ হয়নি। এরপরই সে আবার একদিন সারাদিন তার খোঁজ নেই। জানতে চাইলে কিছু বলে না। আগস্ট মাস শুরু হলো। দুই বা তিন তারিখে ভাইয়া আম্মার কাছ থেকে টাকা নিয়ে আন্দোলনরত ছাত্র-জনতাকে পানি পান করিয়ে আসছিল।
উমামা বলেন, ভাইয়া বলল, জানিস না বোন সারাদেশে ভয়াবহ অবস্থা। ছাত্ররা কত কষ্ট যে করছে। না দেখলে বিশ্বাস করতে পারবি না। সবাইকে সাহায্যের জন্য ডাকছিল।
দশ নাম্বারের অবস্থা খুবই খারাপ; অনেক ভয়াবহ। ছাত্রদের অবস্থান অনেক শক্ত ছিল। এরপর থেকে সে নিয়মিত আন্দোলনে যেতে শুরু করে। ৪ আগস্ট পুলিশের ছোঁড়া টিয়ারসেল খেয়ে বাসায় আসছিল। আম্মু বাসায় ছিল না। কী হয়েছে তোমার? বলল, ‘টিয়ারসেল খেয়েছি।' আমি নাপা খাইয়ে ঘুম পাড়িয়ে দিই।
ভোররাতে হঠাৎ জেগে ওঠে আমার রুমে এসে আমাকে জাগিয়ে তোলে। বলে, চল সকালে লংমার্চে যাবো। আশ্বস্ত করে ঘুমালাম। ভোরে নাশতা খেয়ে লংমার্চে গেছে, সেখান থেকে বিজয় মিছিলে। মিরপুর ১০ নম্বর সে বিজয় মিছিলে যাওয়ার ছবিও নিজের ফেসবুক আইডিতে পোস্ট করে।
তিনি আরও বলেন, বিজয় মিছিল থেকে এসে ভাত খেয়েছে। এরপর সন্ধ্যার আগে যে বের হয়ে ফিরে অসেনি। সারারাত আমি আর আম্মু খোঁজ নিয়েছি। ৬ আগস্ট সকালে আমার খালাকে কল দিই, আমরা মিরপুরের ইসলামী মেডিকেল হাসপাতালে যাই, আরও কয়েকটা হাসপাতালেও যাই। শেষে না পেয়ে ঢাকা মেডিকেল হাসপাতালে যাই। অনেক খুঁজলাম, সিদ্ধান্ত নিলাম সোহরাওয়ার্দী হয়ে পঙ্গুতে যাব।
এমনসময় উপস্থিত ছাত্রদের কেউ কেউ বলল মর্গে যেতে। সকালবেলা ভাল ছেলে বের হয়েছে; ভেবেছিলাম হয়তো আহত হয়ে থাকবে। আমরা ধারণাও করিনাই যে মর্গে যেতে হবে। অনেক জোরাজুরির পর গেলাম; সেখানেও নাই।
উমামা বলেন, ভাইয়া ছোটবেলা থেকে সবসময় নানা রোগে ভুগত। বারোমাসে তেরো রোগের মতন- বলছিল উমামা।
বাপ্পীর ছোটবেলা থেকে স্বপ্নের দেশ ছিল লন্ডন। উচ্চশিক্ষা গ্রহণ করবে। আমার আব্বু সৌদিআরবে তখন অবস্থান করছিলেন। আমাদের সবার ভবিষৎতের অনেক কষ্ট করে আব্বু সাভারে এক টুকরো জমি কিনেছিল। ভাইয়া দেশের বাইরে যেহেতু লেখাপড়া করতে যাবে তাই আব্বুকে এক প্রকার জোর করে আম্মু জমি বিক্রির বন্দোবস্ত করে ফেলে।
তিনি বলেন, ‘ও কষ্ট পেয়েছে খুব, তাই আম্মা তার বিষয়ে দুর্বল ছিল। আম্মুর সাধ ও আহ্লাদের সন্তান ছিল বাপ্পী। ওর কোনো কথায় আম্মু ও আব্বু ফেলতে পারত না।
২০১১- ২০১২ সালে ১৭ বছর বয়সে উচ্চমাধ্যমিক পরীক্ষা শেষে সিদ্ধান্ত নেয় উচ্চপর্যায়ের লেখাপড়া করতে পরিবারকে জানায়। তার লন্ডনে যাওয়ার জন্য সব প্রস্তুতি নিতে থাকে। প্রথমবারেই ভিসা হয় না। পরের চেষ্টাতেই আম্মু ধারদেনা করে তাকে লন্ডনে পাঠায়। কিন্তু সে সেখানে সুবিধা করতে পারে নাই। নানা কাজের চাপে সেখানে থাকতে পারছিল না। তাছাড়া আম্মু ছেলে চলে যাওয়ার তার দুশ্চিন্তায় অস্থির থাকত।
লন্ডন থেকে দেশে ফিরে এসেও মনের মতো চাকরি পাচ্ছিলো না। কোথাও থিতু হতে পারছিল না। বেক্সিমকো ফার্মাসিউটিক্যাল লিমিটেডে চাকরি করেছে। কল সেন্টারে কাজ করেছে। সেখানেও থিতু হতে পারে নাই।
ও বলত, বাংলাদেশে কাজের পরিবেশ নেই, শ্রমিক-মালিক সম্পর্ক ভাল নয়, বেতন কম। আফসোস করতো এদেশে ঘুষ ছাড়া কিছু হয় না। যোগ্য মানুষ যোগ্য চাকরি পায় না। দেশ পরিবর্তনের স্বপ্ন দেখত বাপ্পী।’
বাপ্পীর মা সুরাইয়া আহমেদ বলেন, আমাদের সাধারণ পরিবার। রাজনীতির কিচ্ছু বুঝি না। আমাদের সকল স্বপ্ন ছিল ছেলেকে নিয়েই। আমরা ওর প্রতি এতোটাই মনোযোগী ছিলাম যে, মেয়েটাকেও তেমন গুরুত্ব দিয়ে দেখিনি।
তিনি বলেন, সেই অমূল্য রত্নটাই আমরা হারিয়ে ফেলেছি। ছেলেটা কত লড়াই করল জীবনযুদ্ধে। কিছুতেই থিতু হতে পারল না। স্ত্রী হারিয়ে সন্তান আর আমাদের নিয়েই ছিল তার জীবন। বিদেশ থেকে যদি বাপ্পী ফিরে না আসত তাহলে ও অকালে হারিয়ে যেতো না।
সুরাইয়া বলেন, ছেলে ফ্রিল্যান্সার কাজ করত। সে খুব শান্তশিষ্ট ছিল। কারো সাথে কোনো বিরোধ ছিল না। কারো সাথে কখনও জোরে কথা বলেনি। এতাটাই নম্র আর ভদ্র ছিল। সেই মাণিকটা চিরবিদায় নেওয়ার আগে শেষ কথাও বলে যেতে পারল না। আন্দোলনে গেল, অথচ আমাকে একটুও বুঝতে দেয়নি,পাছে আমি দুশ্চিন্তা করি। ওর বন্ধু ছিল উমামা। সব কথা পর সাথে শেয়ার করত।
বাপ্পীর মা সুরাইয়া আহমেদ বলেন, ওকে না গেয়ে আমরা নানা হাসপাতালে খুঁজছিলাম। কেউ কোনো তথ্য দিতে পারল না। কিছু আত্মীয় স্বজন নানা জায়গায় ওকে খুঁজছিল। পরে, দুপুর আড়াইটা তিনটার দিকে বাসায় দুজন সাংবাদিক এসে জানতে চাইল বাপ্পী আহমেদের বাসা কোথায়। ওরা ওপরে উঠে এলো। আমাদের বিল্ডিংয়ের সবাই এলো। জানতে পারলাম হাতিরঝিলে আমার ছেলের লাশ পাওয়া গেছে। পুলিশসহ অন্যান্যরা সেখানে যাবে । কে যেন ফোন দিলো আমি বললাম বাপ্পীরে পাওয়া গেছেরে হাতিরঝিলে; মধুবাগের ব্রীজের নিচে।
আমার ছেলেটা চলে গেছে,ওর দুবছরের মেয়েটা কিচ্ছু বোঝে না। সে জানে, তার পাপা বিদেশে গেছে। ওর জন্য কত কিছু নিয়ে আসবে। আমাকে দিয়ে নানা ছবি আর ফর্দ পাঠায় তার বাবার কাছে। আমি কাঁদি আর বলি, তোমার পাপা দেশে আসার সময় সবকিছু নিয়ে আসবে।’
উমামা বলেন, ‘ভাইয়ার লাশ পাওয়া গেছে শুনে আমরা গিয়ে দেখি অনেক মানুষের ভীড়। মধুবাগ ব্রিজের নিচে ওর ডেডবডি পানি থেকে তুলে মাটির ওপরে তুলে রাখছে। শুনলাম চারটা থেকে পাঁচটা লাশ পাওয়া গেছে বাপ্পীর সাথে। সবাই গুলিবিদ্ধ। পরে আরও দুটো লাশ উত্তোলন করা হয়।
ঢাকা মেডিকেল হাসপাতাল নিয়ে গেলাম পোস্টমর্টেম করার জন্য, হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ কিছুতেই রাজি হচ্ছিল না। পরে একই হাসপাতালের মরচুয়ারিতে রেখে দিলাম। সাত আগস্ট নিয়ে মিরপুরে ১০ নম্বর কবরস্থানে দাফন করেছি।’
আমি যখন হাতিরঝিলে গেলাম, দুজন ছাত্র-ছাত্রীকে দেখতে পেয়েছিলাম। তাদের কাছে জানতে চাই, এসব লাশ তারা কীভাবে দেখতে পেয়েছে। বলল, আরও কয়েকজন স্বেচ্ছাসেবকের সঙ্গে তারা ঝিলের বর্জ্য পরিস্কার অভিযানে কাজ করছিল। তখন তারা লাশগুলোর মাথা দেখতে পায়। ধারণা করা হয়, এসব লাশ অন্য জায়গায় খুন করে গুম করার উদ্দেশ্যেই ঝিলের পানিতে ফেলে দিয়েছিল।’
সুরাইয়া আহমেদ বলেন, দেশের জন্য আমার ছেলে শহীদ হয়েছে। দেশ স্বাধীন হয়েছে। আমাদের চোখে চিরজীবনের জন্য অশ্রুধারা বইতে থাকবে প্রিয়জন হারানোর শোকে।