শিরোনাম
প্রতিবেদন : বরুন কুমার দাশ, সিরাজগঞ্জ থেকে ফিরে
ঢাকা, ২৭ মে, ২০২৫ (বাসস): ‘আমার ব্যাটা মইরা গেছে তো কী হইছে? হাজার হাজার ব্যাটা আমার পাশে আছে। একটা ব্যাটা হারায়া হাজার হাজার ব্যাটা পাছি। এই ব্যাটারাই বারবার স্বৈরাচার ও ফ্যাসিবাদের বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়াবে। জালিমের কালো হাত ভেঙে দেবে, ওরা একেকজন হয়ে উঠবে সুমন সেখ।’
সিরাজগঞ্জ সদর উপজেলার গয়লা ৯ নং ওয়ার্ড এলাকার বাসায় রাষ্ট্রীয় বার্তা সংস্থা বাসস-এর প্রতিবেদকের সাথে আলাপকালে এমন কথা জানান বৈষম্যবিরোধী আন্দোলনে শহীদ মো. সুমন সেখের মা ফিরোজা বেগম (৫০)।
তিনি বলেন, ‘আমার ব্যাটাটা আর ফিরে আসফি না, আমার ব্যাটাক খুব কষ্টে মানুষ করছিলাম। তার ম্যালা স্বপ্ন ছিল। সে তো আর ফিরবি না। কোনো মা যাতে আমার মতো ছেলে হারা না হয়। আমার মতো কষ্ট যেন আর কারো না হয়।'
ফিরোজা বেগম বলেন, 'ছেলেটা আমার যতটুকু কামাই করতো সব আমার কাছে দিতো। তার কথা মনে হইলে আমার হাত-পা ভাইঙ্গা আসে। যেসব ঘাতকরা আমার ছেলেকে মারছে আমি চাই তাদের কঠিন বিচার হোক।’
শহীদ সুমন সেখ সিরাজগঞ্জ শহরের ৯ নং ওয়র্ডের গয়লা মহলস্নার গঞ্জের আলী পুত্র, বীর মুক্তিযোদ্ধা গাজী কাঙাল সেখের নাতি। সুমন ১৯৯৩ সালের ২ ডিসেম্বর জন্ম গ্রহণ করেন। সুমন ছোট থেকেই রাজনীতি সচেতন ছিলেন। বৈষম্যহীন একটি রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠা করতেই ছাত্র-জনতার মিছিলে অংশ নেন তিনি।
বাবা-মা, দুই ভাই, এক বোন নিয়ে সুমনের পরিবার। সংসারে ছিল অভাব। বাবা কালীবাড়ী কাঁচা বাজার এলকায় সাত তলা ভবনের সামনের রাস্তার পাশে একটি চায়ের দোকান করেন, মা গৃহিণী।
পরিবারের সদস্যদের সাথে কথা বলে জানা যায়, অভাব-অনটনের সংসারের বাবার আয় দিয়ে দুই ভাই বোনের লেখাপড়ার খরচ জোগানো সম্ভব ছিল না। আর তাই লেখাপড়ার পাশাপাশি স্থানীয় এক ব্রডব্যান্ডের দোকানে খণ্ডকালীন চাকরি নিয়েছিল সুমন ।
বাবা গঞ্জের আলী (৫৯) জানান, সুমন সিরাজগঞ্জ সরকারি টেকনিক্যাল স্কুল অ্যান্ড কলেজ থেকে এইচএসসি (কারিগরি) পাস করার পর সুনামগঞ্জ পলিটেকনিকে ডিপ্লোমা পড়ার সুযোগ পান।
তিনি বলেন, 'আমার আয় দিয়ে সংসার ও লেখাপড়ার খরচ চলে না বলে স্থানীয় একটি ব্রডব্যান্ড ইন্টারনেট প্রতিষ্ঠানে চাকরি করত। চাকরির ফাঁকে ফাঁকে আমার দোকানে মাঝে মাঝে সহযোগিতা করত।'
সুমনের বড় ভাই রুবেল দোকানে সার্বক্ষণিক কাজ করেন। একমাত্র বোন আদুরী খাতুন সিরাজগঞ্জ পলিটেকনিক ইনস্টিটিউট থেকে ডিপেস্নামা ইন ইলেক্ট্রিক্যালে পাস করেছেন ২০২২ সালে।
সুমন সেখের বাবা জানান, রাজধানী ঢাকাসহ সারা দেশ যখন ছাত্র-জনতার আন্দোলনে উত্তাল, তখন যমুনা তীরের সিরাজগঞ্জও উত্তপ্ত। ২০২৪ সালের ৪ আগস্ট বৈষম্যবিরোধী ছাত্র-জনতা সিরাজগঞ্জ শহরে মিছিল বের করে। সেই মিছিলে ছাত্র-জনতার সঙ্গে যোগ দেন সুমন।
তিনি বলেন, 'আমাকে না জানিয়ে সেই মিছিলে যোগ দিয়ে হাজারো জনতার সঙ্গে স্বৈরাচারের বিরুদ্ধে স্লোগানে কন্ঠ মিলায়। কিছুক্ষণ পরেই স্থানীয় এস এস রোডের ইলিয়ট ব্রিজের কাছে যুবলীগের নেতারা মিছিলে গুলি চালয়। পেটে গুলিবিদ্ধ হয়ে মাটিতে লুটিয়ে পড়ে সমুন।'
শহীদ সুমন সেখের পিতা গঞ্জের আলী আরও বলেন, ‘ঘটনার দিন সকালে সুমন আমার দোকানে আসে। এসে রুটি ও কলা খায়। পরে আমি বাজার করে দিলে বাজারগুলো বাড়িতে নিয়ে যায়। সকাল ১০টায় ছাত্র-জনতার মিছিলে যোগ দেয় আমার অজান্তে।
গঞ্জের আলী বলেন, 'সকাল ১১টায় খবর পাই সুমনের গুলি লেগেছে। নর্থবেঙ্গল হাসপাতালে নিয়ে গেছে তাকে। সঙ্গে সঙ্গে হাসপাতালে ছুটে যাই। গিয়ে শুনি আমার সুমন আর নাই। মুহূর্তেই আমার সব স্বপ্ন ধূলিসাৎ হয়ে যায়।'
সুমন ৪ আগস্ট শহীদ হলেও সেদিন লাশ হিমাগারে রাখা হয়। পরে ৬ আগস্ট শহীদ এম মনসুর আলী মেডিকেল কলেজে ময়নাতদন্ত শেষে সন্ধ্যায় শহরের মলশাপাড়া কবরস্থানে তাকে দাফন করা হয়।
সুমনের বাবা আরও বলেন, তাকে বিয়ে করানোর অনেক চেষ্টা করেছি। অনেক পাত্রীও দেখেছি, কিন্তু সে রাজি হতো না। বলত ভালো চাকরি পেয়ে বাড়ি পাকা করার পর বিয়ে করবো। তার জন্য আর পাত্রী দেখতে হবে না। ছেলে চলে গেছে, তাকে তো আর ফিরে পাবো না। আমি বেঁচে থাকতে যেন ছেলে হত্যার বিচার দেখি।'
সুমনের বড় ভাই রুবেল হাসান বলেন, মানুষ রক্ত দেয়, কিন্তু মুক্তি আসে না। আমার ছোট ভাইকে বিনা কারণে হত্যা করলো, তাদের শাস্তি চাই।
বর্তমান সরকারের কাছে আপনার প্রত্যাশা কী জানতে চাইলে তিনি বলেন, আমার বোন সিরাজগঞ্জ পলিটেকনিক থেকে ডিপ্লোমা পাস করেছে। তার একটি চাকরির ব্যবস্থা করলে আমাদের পরিবারের অভাব ঘুচবে।
শহীদ সুমনের একমাত্র ছোট বোন আদুরী খাতুন বলেন, আমরা দাদা একজন ভাতাপ্রাপ্ত বীর মুক্তিযোদ্ধা। আমরা মুক্তিযোদ্ধা পরিবারের সন্তান। আমার ভাই বৈষম্যবিরোধী আন্দোলনে ছাত্র-জনতার মিছিলে গিয়ে শহীদ হয়েছেন। আমরা এই হত্যার উপযুক্ত বিচার চাই।
তিনি বলেন, আমার ভাইটি খুব শান্ত, খুবই নম্র-ভদ্র ছিল। আমাকে ও মা-বাবাকে খুব ভালোবাসতো। অনেক স্বপ্ন ছিল তার। তার কথা মনে পড়লেই কান্না আসে। তাকে আর কখনও দেখতে পাবো না- এটাই বারবার মনে হয়। আমি ওর বড়ো হলেও পড়াশোনাসহ সবকিছুতে আমাকে পরামর্শ দিতো। পরিবারের সাথে সব কথা শেয়ার করতো। হৃদয়ের এই রক্তক্ষরণ হয়তো থামবে না কখনো, ভাইয়ের সাথে কাটানো স্মৃতিগুলো বারবার ভেসে ওঠে চোখের সামনে।
কারো কাছ থেকে কোনে সহযোগিতা পেয়েছেন কি না জানতে চাইলে সুমনের বাবা বলেন, জুলাই ফাইন্ডেশন থেকে পাঁচ লাখ টাকার চেক ও জামায়াতে ইসলামীর পড়্গ্য থেকে ২ লাখ টাকা পেয়েছি। বিএনপির পড়্গ্য থেকে ১ লাখ টাকা সহযোগীতা পেয়েছি।
তিনি বলেন, এছাড়াও জেলা প্রশাসক ও উপজেলা নির্বাহী অফিসার ঈদের আগে আমাদের সাথে দেখা করে ঈদ সামগ্রী উপহার দিয়েছেন।
বাবার চায়ের দোকানের পাশের ফল বিক্রেতা রতন বলেন, সুমন খুব ভালো ছেলে ছিল। দেখা হলে একটা সালাম দিত, হাসি মুখে কথা বলত। ছেলেটা সময়ে চলে যাওয়াতে আমরা সবাই কষ্ট পেয়েছি।