শিরোনাম
প্রতিবেদন : মো. মামুন ইসলাম
রংপুর, ১৭ মে, ২০২৫ (বাসস) : চোখে ছিল একটি মানবিক বাংলাদেশের স্বপ্ন—যেখানে থাকবে না ফ্যাসিবাদ, বৈষম্য ও নিপীড়ন। স্ত্রী তানজিমা আখতার ও ছয় বছর বয়সী ছেলে আব্দুল্লাহ আল-জাইনকে নিয়ে ছিল ৩৬ বছর বয়সী মুক্তচিন্তার তরুণ ফ্রিল্যান্সার মোর্শেদ আলমের ছোট সংসার। ছেলেকে সুশিক্ষিত করার স্বপ্ন, স্ত্রীর বিসিএস প্রস্তুতির ব্যস্ততা- এই নিয়ে একটি সুন্দর ভবিষ্যতের দিকে এগোচ্ছিল তার দিনগুলো।
কিন্তু গত বছরের ৪ আগস্ট, শেখ হাসিনার ফ্যাসিবাদী সরকারের পতনের দিন ও এর ঠিক একদিন আগে ঢাকায় পুলিশের নৃশংস নির্যাতনে তার সেই স্বপ্ন ভেঙে যায়। পুলিশ এবং আওয়ামী লীগ ও এর সহযোগী সংগঠনের হামলায় গুলিবিদ্ধ ও মারাত্মক আহত হন মোর্শেদ। আজও তার ডান পায়ের হাড় বাঁকা হয়ে আছে, হাঁটুর নিচের অংশের পেশিগুলো অবশ হয়ে গেছে।
৩৬ বছর বয়সী মোর্শেদ রংপুরের একটি মধ্যবিত্ত পরিবারে জন্মগ্রহণ করেন। বাবা মরহুম মো. আবদুল মান্নান ছিলেন প্রবাসী শ্রমিক, ২০১৮ সালে মারা তিনি। মা আমেনা বেগম (৫৬)। তিন ভাইবোনের মধ্যে তিনি সবার বড়। তার দুই বোন, দিলরুবা জাহান ও মেহেরিন পারভীন। দুজনেই বিবাহিত।
শিক্ষা, প্রেম ও সংগ্রামের গল্প
মোর্শেদ ২০০৪ সালে রংপুর হাইস্কুল থেকে এসএসসি এবং ২০০৬ সালে রংপুর সরকারি কলেজ থেকে এইচএসসি পাস করেন। পরে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষা ও গবেষণা ইনস্টিটিউটের (আইইআর) বিশেষ শিক্ষা বিভাগে ভর্তি হন।
২০১১ সালে এসএসএল ওয়্যারলেসে খণ্ডকালীন ফ্রিল্যান্সার হিসেবে কর্মজীবন শুরু করেন। ২০১৩ সালে নীলফামারীর কিশোরগঞ্জের মেয়ে তানজিমা আখতারের সঙ্গে তার ভালোবাসার সম্পর্ক বিয়েতে পরিপূর্ণতা পায়। রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ফোকলোরে অনার্স এবং বেগম রোকেয়া বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ইংরেজিতে মাস্টার্স করেন তানজিমা।
স্ত্রী ও একমাত্র সন্তানকে নিয়ে ঢাকার বসিলায় ভাড়া বাসায় থেকে ফ্রিল্যান্সিং করতেন মোর্শেদ। পেশাগত জীবনে বিভিন্ন আইটি প্রতিষ্ঠানে কাজ করেছেন তিনি। ভিউ মোবাইলে কাজ করেন ২০১৮ সাল পর্যন্ত। এরপর একই বছর থেকে লুক্সেমবার্গভিত্তিক ‘বিলিভ ইন্টারন্যাশনাল’-এ ফ্রিল্যান্সার হিসেবে কাজ করেন তিনি।
লাল জুলাই বদলে দেয় জীবন
ছেলেকে শিক্ষিত করে গড়ে তোলার স্বপ্ন নিয়ে অগ্রসর হচ্ছিলেন। স্ত্রী তানজিমাও বিসিএস পরীক্ষার প্রস্তুতি নিচ্ছিলেন। সবকিছু ভালোই চলছিল। কিন্তু ২০২৪ সালের আগুনঝরা লাল জুলাই এসে সব বদলে দেয়। পাল্টে যায় মোর্শেদের সহজ, স্বভাবিক জীবন। একজন আটপৌরে সাধারণ নাাগরিক থেকে দেশপ্রেম এবং অন্যায় ও বৈষম্যমুক্তির দু্র্বার চেতনা তাকে রাজপথের যোদ্ধা বানিয়ে দেয়।
কেবল নিজের কথা নয়, দেশের কথা দশের কথা ভেবে বিবেকের তাড়নায় জুলাই মাসে কোটা সংস্কার আন্দোলন ও বৈষম্যবিরোধী ছাত্রআন্দোলনে সক্রিয়ভাবে অংশ নিতে শুরু করেন মোর্শেদ। প্রায় প্রতিদিনই তিনি মোহাম্মদপুর বাসস্ট্যান্ড এলাকায় মিছিল-মিটিংয়ে অংশ নিতেন।
ফ্যাসিবাদের বিরুদ্ধে গর্জে ওঠা
রংপুর শহরের কেরানিপাড়ায় বাসসের সঙ্গে কথা বলেন মোর্শেদ। বলেন, 'আমি শুধু নিজের ছেলের ভবিষ্যৎ নয়, দেশের সব সন্তানের ভবিষ্যৎ নিয়েই চিন্তিত ছিলাম গত ১৬ বছর ধরে। হাসিনার ফ্যাসিস্ট শাসনে দুশ্চিন্তায় ঠিকমতো ঘুমাতে পারতাম না। গুম, খুন, দুর্নীতি, লুটপাট, অর্থ পাচার, দমন-পীড়ন—সীমা ছাড়িয়ে গিয়েছিল।'
একজন সচেতন নাগরিক হিসেবে মনে জমে ওঠা রাগ-ক্ষোভ থেকে প্রতিবাদ -প্রতিরোধে উদ্বুদ্ধ হন মোর্শেদ। ফলে জুলাই মাসের শুরু থেকে কোটা সংস্কারবিরোধী আন্দোলন এবং পরে বৈষম্যবিরোধী ছাত্র-জনতার আন্দোলনে সক্রিয় ও সোচ্চার হন মোর্শেদ। প্রতিদিন মোহাম্মদপুর বাসস্ট্যান্ড এলাকায় মিটিং-মিছিলে যোগ দেন তিনি।
মিছিলে নির্বিচারে গুলি
৪ আগস্ট দুপুর দুইটার দিকে মোহাম্মদপুর তিন রাস্তার মোড়ে হাজারো শিক্ষার্থী ও সাধারণ মানুষের একটি মিছিলে অংশ নেন তিনি। হঠাৎ পুলিশ ও আওয়ামী লীগের সন্ত্রাসীরা মিছিলে হামলা চালিয়ে নির্বিচারে গুলি করে। ছাত্রসহ বহু মানুষ হতাহত হন।
মোর্শেদ বলেন, 'চারপাশে লাশ, রক্ত, আর কান্না- কিন্তু আমরা কেউ পিছু হটিনি।' একপর্যায়ে তিনিও গুলিবিদ্ধ হন, পড়ে যান মাটিতে। পরে পুলিশ রাইফেলের বাট দিয়ে নির্মমভাবে পেটায় তাকে। তিনি রক্তাক্ত অবস্থায় নিস্তেজ হয়ে পড়েন থাকেন রাস্তায়।
'গুলিবিদ্ধ হয়ে লুটিয়ে পড়ি'
পরদিন, ৫ আগস্ট, জোহরের নামাজের পর খবর পান- শেখ হাসিনা পদত্যাগ করে দেশ ছেড়ে পালিয়ে গেছেন। সেই খবর পেয়ে প্রচণ্ড যন্ত্রণার মাঝেও তিনি রাস্তায় বেরিয়ে আসেন এবং গণভবনের দিকে জনতার বিজয় মিছিলে অংশ নেন। কিন্তু সেখানে দুর্বল হয়ে পড়ে যান তিনি।
'আগেরদিন আমি গুলিবিদ্ধ হয়ে মাটিতে লুটিয়ে পড়ি। পুলিশ আমার শরীরের বিভিন্ন স্থানে রাইফেলের বাট দিয়ে পেটাতে থাকে। আমি আর দাঁড়াতে পারছিলাম না,' বলেন মোর্শেদ।
এক সময় কিছু দেশপ্রেমিক ছাত্র ও সাধারণ মানুষ জীবনের ঝুঁকি নিয়ে তাকে উদ্ধার করে একটি বাড়ির ভেতরে আশ্রয় দেন। অপরিচিত সেই বাড়ির মালিক তাকে প্রাথমিক চিকিৎসা দেন।
তীব্র যন্ত্রণায় হাসপাতালেও যেতে পারেননি মোর্শেদ। রাতে একটি ফার্মেসি থেকে ওষুধ কিনে বাসায় ফিরে আসেন। সারারাত ঘুমাতে পারেননি যন্ত্রণায়।
চিকিৎসা, সংগঠন ও প্রত্যয়ের পথে
পরবর্তীতে বাংলাদেশ সেনাবাহিনী আহতদের বিনামূল্যে চিকিৎসা দেওয়ার ঘোষণা দেয়। ৯ আগস্ট ঢাকা সিএমএইচ-এ যান মোর্শেদ। পরীক্ষা-নিরীক্ষার পর ১২ সেপ্টেম্বর ডান পায়ের অপারেশন হয়, ২৯ সেপ্টেম্বর তিনি ছাড়া পান।
শরীরজুড়ে আঘাত নিয়ে তিনি রংপুরে ফিরে আসতে বাধ্য হয়েছেন। ছেলের লেখাপড়া ও স্ত্রীর বিসিএস প্রস্তুতির কথা চিন্তা করে তিনি তাদের গাইবান্ধার মহিমাগঞ্জে শ্বশুরবাড়িতে পাঠিয়ে দিয়েছেন।
বর্তমানে তিনি রংপুর ক্যান্টনমেন্টের সিএমএইচ ও পিজি হাসপাতালে নিয়মিত চিকিৎসা নিচ্ছেন। দিনে ৯টি ওষুধ খেতে হয় তাকে। হাঁটুর নিচে পেশিগুলো এখনও অবশ। চিকিৎসকরা আশা করছেন, নিয়মিত চিকিৎসা ও ব্যায়ামের মাধ্যমে ধীরে ধীরে সুস্থ হয়ে উঠতে পারেন তিনি।
জুলাই যোদ্ধা
মোর্শেদ এখন ‘জুলাই যোদ্ধা’ নামক একটি সংগঠন গঠন করেছেন- জুলাই বিপ্লবে আহতদের সংগঠিত করতে। রংপুর জেলার কমিটির আহ্বায়ক হয়েছেন তিনি।
মোর্শেদ বলেন, 'এই সংগঠনের মূল লক্ষ্য- জুলাই যোদ্ধাদের কথা শোনা, তাদের অধিকার সম্পর্কে সচেতন করা এবং সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের সঙ্গে যোগাযোগ স্থাপন করা।'
বিচারের দাবি
মোর্শেদের মতো তার মা আমেনা বেগম ও স্ত্রী তানজিমাও নিরীহ ছাত্র-জনতার ওপর হামলাকারীদের দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি দাবি করেন, যাতে আর কখনও এই মাটিতে ফ্যাসিবাদ মাথাচাড়া দিয়ে উঠতে না পারে।