শিরোনাম
চট্টগ্রাম, ১৩ মে, ২০২৫ (বাসস) : কিছু নাম সংবাদ শিরোনামে আসে, মানুষের সহমর্মিতা পায়, সমবেদনা পায়। হয়তো ভাগ্য প্রসন্ন হলে সহায়তাও মিলে যায়। কিন্তু কিছু হতভাগ্য আহতের আর্তনাদ সংবাদপত্রেও ঠাঁই পায় না। থেকে যায় আড়ালে, মানুষের মনোযোগের কেন্দ্র থেকে দূরে। তেমনি এক তরুণ—ইমরানুল হক রিয়াদ।
বাম চোখে আংশিক দেখতে পেলেও ডান চোখ খুলতেই পারছেন না। ডান চোখটি হারানোর আশঙ্কায় আছেন তিনি। এই চোখে বয়ে বেড়াচ্ছেন চারটি ছররা গুলি। তীব্র যন্ত্রণা নিয়ে পার করছেন প্রতিটি দিন। ঠিক মতো চিকিৎসা না পেলে চিরতরে ডান চোখের দৃষ্টি হারিয়ে ফেলতে পারেন এমন আশঙ্কায় ভুগছেন এই সাহসী জুলাই যোদ্ধা।
আর্থিক অনটন, অপ্রতুল চিকিৎসা, আলোহীন অনিশ্চিত ভবিয়ষ্যতের বিভীষিকার মুখোমুখি দাঁড়িয়েও রিয়াদের কণ্ঠে নেই কোনো অভিযোগ-অনুযোগ —আছে এক অদ্ভুত রকমের স্থিরতা, এক অনড় প্রত্যয়। বুকভরা সাহস নিয়ে তিনি এখনও প্রত্যয়দীপ্ত কণ্ঠে বলেন, 'প্রয়োজনে দেশের জন্য বাকি চোখটিও দিতে প্রস্তুত।’
বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনে গুলিবিদ্ধ হয়ে মারাত্মকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হন চট্টগ্রামের পটিয়ার ইমরানুল হক রিয়াদ (২৪)। প্রয়োজনীয় অর্থের অভাবে থমকে আছে তার চিকিৎসা। রিয়াদের পরিবার জানায়, দীর্ঘ নয় মাস ধরে প্রায় সাত-আট লাখ টাকা খরচ করেও চোখের অবস্থার উন্নতি হয়নি তার।
চিকিৎসকরা জানান, একটি জটিল অস্ত্রোপচার না করালে ডান চোখটি আর রক্ষা পাবে না। এতে আনুমানিক প্রায় ১০ লাখ টাকা লাগবে। কিন্তু পরিবারের পক্ষে এই ব্যয় বহন করা সম্ভব নয়।
রিয়াদের বাড়ি চট্টগ্রামের পটিয়া উপজেলার কুসুমপুরা ইউনিয়নের উত্তর হরিণখাইন গ্রামে। তিনি আলী হোসেন চৌকিদার বাড়ির প্রবাসফেরত আহমদ নবী (৫৫) ও গৃহিণী শাহনাজ বেগমের বড় ছেলে।
রিয়াদ বর্তমানে চট্টগ্রাম নগরীর শহীদ এমএনজে কলেজের স্নাতক ৪র্থ বর্ষের শিক্ষার্থী। ছোট ভাই রিজওয়ানুল হক বিজিসি ট্রাস্ট বিশ্ববিদ্যালয়ে বিবিএ ২য় বর্ষে অধ্যয়নরত।
আগে প্রবাসী বাবার পাঠানো অর্থ ও দুই ভাইয়ের টিউশন ফি দিয়ে সংসার চললেও বর্তমানে সেই উৎস বন্ধ। বাবা দেশে ফিরে এসেছেন, আর রিয়াদ চোখ হারানোর পর আর টিউশন করতেও পারছেন না। ফলে পরিবার মারাত্মক আর্থিক সংকটে পড়েছে।
২০২৪ সালেরর ৫ আগস্ট চট্টগ্রামের বহদ্দারহাটে কোটা সংস্কার আন্দোলনের সময় পুলিশ এবং ছাত্রলীগ-যুবলীগের সশস্ত্র হামলায় গুরুতর আহত হন রিয়াদ। তিনি বলেন, ‘১৩ জুলাই রংপুরে আবু সাঈদ হত্যার পর থেকেই আমরা সক্রিয়ভাবে আন্দোলনে ছিলাম।'
২০২৪ সালের ৫ আগস্ট—ফ্যাসিস্ট শেখ হাসিনা সরকার পতনের দিন—নিজের আহত হওয়ার বিভীষিকাময় ও উত্তাল সেই দিনটির কথা স্মরণ করে রিয়াদ বাসসকে বলেন, সেদিন চট্টগ্রামের বহদ্দারহাট মোড়ে বিপুল সংখ্যক ছাত্র ও সাধারণ মানুষ জড়ো হয়। এ সময় পুলিশ ছাত্রলীগ ও যুবলীগের অস্ত্রধারী ক্যাডারদের নিয়ে বেপরোয়া গুলিবর্ষণ শুরু করে, যার ফলে বহু আন্দোলনকারী আহত হন।
রিয়াদ বাসসকে বলেন, ‘সকালবেলা বহদ্দারহাট মোড়ে আমরা অবস্থান করছিলাম। হঠাৎ চারদিক থেকে পুলিশ ও সন্ত্রাসীরা অতর্কিতে গুলি চালায়। আমি ছিলাম মিছিলের সামনের সারিতে। কিছু বুঝে ওঠার আগেই চোখ, মুখ, মাথা ও শরীরের নানা জায়গায় অসংখ্য স্প্লিন্টার বিঁধে যায়। এক পর্যায়ে আমি মাটিতে লুটিয়ে পড়ি, এরপর বেহুঁশ হয়ে যাই।'
পরে তিনি জানতে পারেন, তার দুই বন্ধু শুভ ও সোহরাব জীবনের ঝুঁকি নিয়ে তাঁকে চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে নিয়ে যান। সেখানকার চিকিৎসকেরা জরুরি অস্ত্রোপচারের মাধ্যমে তাঁর শরীরের বিভিন্ন অংশ থেকে ৩৩টি স্প্লিন্টার বের করতে সক্ষম হলেও ডান চোখে আরও ৬টি স্প্লিন্টার তখনও রয়ে যায়। চিকিৎসকেরা জানান, চোখে বড় ধরনের অস্ত্রোপচার প্রয়োজন।
সেদিন রাতেই তার আত্মীয়-স্বজনরা তাকে পাহাড়তলীর চক্ষু হাসপাতালে নিয়ে যান। সেখানে ৬ ও ২৮ আগস্ট তার ডান চোখে দুই দফা অস্ত্রোপচার হয়। কিন্তু চিকিৎসকেরা ভেতরে বিঁধে থাকা ছয়টি স্প্লিন্টারের মধ্য থেকে মাত্র দুটি বের করতে সক্ষম হন।
এরপর তিনি ঢাকার সম্মিলিত সামরিক হাসপাতালে (সিএমএইচ) যান, যেখানে তিনি এক মাস ধরে চিকিৎসাধীন ছিলেন। সেখানেও চোখে বিঁধে থাকা স্প্লিন্টারগুলো বের করা সম্ভব হয়নি। এখন নিয়মিত ফলোআপের জন্য তাকে সিএমএইচ-এ যেতে হয়। চিকিৎসকেরা তাকে জানিয়েছেন, তার চোখে একটি বড় ধরনের অস্ত্রোপচারের জন্য অন্তত ১০ লাখ টাকা প্রয়োজন হবে।
চট্টগ্রামে জুলাই আন্দোলনের অন্যতম সম্মুখযোদ্ধা ইমরানুল হক রিয়াদ নিয়মিত বহদ্দারহাট ও মুরাদপুরে আন্দোলনে অংশ নিতেন—যা মাসব্যাপী কোটা-বিরোধী আন্দোলনের গুরুত্বপূর্ণ কেন্দ্র ছিল। কিন্তু এখন চোখের উন্নত চিকিৎসার অভাবে ও অর্থের অভাবে হতাশ হয়ে পড়েছেন তিনি।
রিয়াদ বলেন, ‘জুলাই শহীদ স্মৃতি ফাউন্ডেশন থেকে আমি ১ লাখ টাকা সহায়তা পেয়েছি, কিন্তু তা এখন পর্যন্ত পরিবারের ব্যয়ের তুলনায় অতি সামান্য। সামনে উন্নত চিকিৎসার জন্য আরও অর্থ প্রয়োজন,’ বলেন রিয়াদ।
তিনি আরও জানান, ‘তবে এখন চিকিৎসা সেবা আগের চেয়ে কিছুটা সহজলভ্য হয়েছে, যদিও নিয়মিত চট্টগ্রাম-ঢাকা যাতায়াত করতে হচ্ছে।’
ব্যথার কথা জানিয়ে রিয়াদ বাসস-কে বলেন, ‘চোখের অসহনীয় যন্ত্রণায় অনেক সময় রাতজেগে কাটাতে হয়। সেই ব্যথা মাথায় ছড়িয়ে পড়ে। এখন চোখে ঝাপসা ঝাপসা দেখতে পাই। তবে প্রচণ্ড ব্যথা হয়, মাঝে মাঝে বমি হয়, ঘুমাতে পারি না, চোখ দিয়ে অবিরাম পানি ঝরে।’
‘আহতের প্রথমদিকে অনেক আত্মীয়-স্বজন, বন্ধু-বান্ধব পাশে এসেছিলেন, সান্ত্বনা দিয়েছিলেন। কিন্তু এখন পরিবার ছাড়া কেউই আর কাছে আসে না,’ বলার সময় রিয়াদের চোখেমুখে এক বিষণ্ন ছায়া নেমে আসে।
‘আমার স্বপ্ন ছিল, লেখাপড়া শেষ করে দরিদ্র মা-বাবা ও ছোট ভাইয়ের পাশে দাঁড়াব। সেই স্বপ্নটা ধীরে ধীরে নিভে যাচ্ছে,’ বলেন তিনি।
তবুও তিনি হার মানেননি—‘আমি এখনও বাম চোখে দেখতে পারি। যদি দরকার হয়, আবারও অন্যায়ের বিরুদ্ধে দেশের মুক্তির লড়াইয়ে নামব। আমার কাছে সবচেয়ে বড় প্রাপ্তি হলো—অনেক ত্যাগ ও রক্তের বিনিময়ে আমরা দেশকে ফ্যাসিবাদের হাত থেকে মুক্ত করতে পেরেছি।’
তিনি দৃঢ় কণ্ঠে বলেন, ‘এই চোখ হারিয়েছি হয়তো, কিন্তু নতুন বাংলাদেশ গড়ার আশাবাদ পেয়েছি।'
রিয়াদের মা শাহনাজ বেগম বলেন, ‘ছেলের পুরো শরীরেই ছররা গুলির চিহ্ন ছিল। এখনও চোখের ভেতরে চারটি স্প্লিন্টার রয়ে গেছে। এগুলো অপসারণে ৮-১০ লাখ টাকা প্রয়োজন। এরই মধ্যে অনেক খরচ করেছি, এখন আর কোনো উপায় নেই।’
তিনি অভিযোগ করেন, ‘বৈষম্যবিরোধী আন্দোলনে আহত অন্যদের চিকিৎসার ব্যয় সরকার বহন করলেও আমাদের সন্তানের চিকিৎসা পুরোপুরি হয়নি। আমরা তার সুস্থতা ও ভবিষ্যতের জন্য সরকারের সহানুভূতিশীল হস্তক্ষেপ কামনা করছি।’