বাসস
  ১২ মে ২০২৫, ১৫:৩৫
আপডেট : ১২ মে ২০২৫, ১৭:১১

মাওলানা হওয়ার স্বপ্ন পূরণে ঢাকা গিয়ে শহীদ হলেন হাফেজ সাদিক

শহীদ হাফেজ সাদিক- ছবি : বাসস

প্রতিবেদন : মহিউদ্দিন সুমন

টাঙ্গাইল, ১২ মে, ২০২৫ (বাসস) : স্বপ্ন ছিল বড় হয়ে মাওলানা হবে, মায়ের দুঃখ-কষ্ট দূর করবে,  তার পরিশ্রম লাঘব করবে, পরিবারের আর্থিক স্বচ্ছলতা আনবে, টিনের চালা পৈতৃক ঘরটা পাকা করবে। সে স্বপ্ন বুকে নিয়ে টাঙ্গাইলের প্রত্যন্ত পাহাড়ি জনপদের তরুণ সাদিক পাড়ি জমিয়েছিল ঢাকা শহরে, কেবল পড়াশোনা করতে নয়, একজন আলোকিত মানুষ হয়ে ফিরে আসার প্রত্যয়ে।

কিন্তু স্বপ্ন পূরণের পথে বুকভরা আশা নিয়ে তার এই পথচলা থেমে গেল অকালেই, ঢাকা শহরে পা রাখার কয়েক বছরের মধ্যেই ইতি ঘটল তার যাবতীয় আশা-আকাঙ্ক্ষা ও চাওয়া-পাওয়ার। জীবনের সমস্ত স্বপ্ন-সাধ, সম্ভাবনা আর মায়ের মুখে হাসি ফোটানোর অপত্য বাসনা পেছনে ফেলে সে এখন শুধুই একটি স্মৃতি। ‘শহীদ’ নামের এক ভারী পরিচয়ে ঢাকা পড়েছে হাফেজ সাদিকের, সমস্ত অপূর্ণ স্বপ্ন, অপরিমেয় সম্ভাবনা আর লালিত বাসনা।

উচ্চশিক্ষা নিয়ে স্বপ্ন পূরণের আগেই মাত্র ২২ বছর বয়সে বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের উত্তাল সময়ে পুলিশের  গুলিতে নিহত হয়ে শহীদের তালিকায় নাম লিখিয়েছে মাদ্রাসার ছাত্র হাফেজ সাদিক।

পারিবারিক সূত্রে জানা যায়, গণঅভ্যুত্থানের সেই উত্তাল সময়—১৯ জুলাই শুক্রবার, ২০২৪—ঢাকায় বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলন ব্যাপকভাবে রাজপথে পালিত হচ্ছিল। সেদিন জুমার নামাজ শেষে সহপাঠী বন্ধুদের সঙ্গে রাজপথে বিক্ষোভ মিছিলে যোগ দেন সাদিক। এ সময় পুলিশ মিছিলে গুলিবর্ষণ করলে একটি গুলি সাদিকের পিঠ ভেদ করে নাভির পাশে আটকে যায়।

পরিবারের লোকজন সেদিন অনেক খোঁজখবর নিয়েও তাকে পাননি। পরের দিন, ২০ জুলাই শনিবার, উত্তরা আধুনিক মেডিকেল হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ একটি গুলিবিদ্ধ লাশের পরিচয় না পেয়ে বেওয়ারিশ হিসেবে দাফনের প্রস্তুতি নিচ্ছিল।

লাশের শরীরে ইসলামী পোশাক ও চেহারা-সুরত দেখে হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ আশপাশের মাদ্রাসাগুলোতে খবর দেয়। খবর পেয়ে আবদুল্লাহপুর উত্তরা জামিআ দীনিয়া ইসলামিয়া মাদ্রাসার সুপার গিয়ে সাদিকের লাশ শনাক্ত করেন। পরে উত্তরা আধুনিক মেডিকেল হাসপাতাল থেকে সাদিকের লাশ টাঙ্গাইলের ঘাটাইল উপজেলার ফুলবাড়িয়া করিমগঞ্জ ঘোনা পাড়া গোরস্থানে দাফন করা হয়।

সরেজমিনে টাঙ্গাইলের ঘাটাইল উপজেলা থেকে ৪৫ কিলোমিটার পূর্বে সাগরদীঘি ইউনিয়নের নীরব পাহাড়ি পল্লী ফুলবাড়িয়া করিমগঞ্জ ঘোনা পাড়া গ্রামে গিয়ে সাদিকের বাড়ি কোনটি জিজ্ঞেস করলে এলাকাবাসী সরাসরি তার বাড়িতে নিয়ে যায়। মুহূর্তেই লোকজন সেখানে ভিড় জমান। ঘর থেকে বেরিয়ে আসেন সাদিকের মা শাহনাজ বেগম। তার মুখে ছড়িয়ে রয়েছে বিষণ্নতার ছাপ। সাংবাদিক এসেছেন শুনে তিনি আবেগাপ্লুত হয়ে পড়েন। দীর্ঘ সময় কথা বলেন বাসস-এর প্রতিবেদকের সঙ্গে।

সাদিকের মা শাহনাজ বেগম (৫৫) জানান, সাদিকের বাবা লুৎফর রহমান লেবু একজন কুয়েতপ্রবাসী। তিন ছেলের মধ্যে সাদিক ছিল দ্বিতীয়। বড় ছেলে শামীম সিঙ্গাপুরপ্রবাসী এবং ছোট ছেলে শাহেদ ষষ্ঠ শ্রেণিতে পড়াশোনা করে।

প্রথমে করিমগঞ্জ সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে সাদিকের লেখাপড়ার হাতেখড়ি হয়। পরে তাদের ইচ্ছায় গ্রামের পার্শ্ববর্তী সখিপুরের আড়াইপাড়া মাদ্রাসায় হিফজ বিভাগে ভর্তি করানো হয়। সেখান থেকে হাফেজ পড়া শেষে মাথায় পাগড়ি পড়েন সাদিক। সর্বশেষ ঢাকার আবদুল্লাহপুর জামিআ দীনিয়া ইসলামিয়া মাদ্রাসায় হাদিস বিষয়ে ভর্তি হয়ে পড়াশোনা করছিল সে।

সাদিকের মা বাসস-কে বলেন, ‘সাদিক প্রায়ই বলত, “মা, তুমি সংসারের জন্য এত কষ্ট করো, সেটা দেখতে আমার আর ভালো লাগে না। আমি বড় মাওলানা হলে তখন আর তোমাকে কোনো পরিশ্রম করতে দেব না। বাড়িতে টিনের ঘরটা আমি বিল্ডিং বানিয়ে দেব। সংসারে তোমার কোনো কাজ করতে হবে না। তুমি শুধু নামাজ পড়বে আর ঠিকমতো খাওয়া-দাওয়া করবে। এটাই ছিল সাদিকের সঙ্গে আমার শেষ কথা। সাদিক দেশের জন্য প্রাণ দিয়েছে। আমার ছেলেকে আমি আর ফিরে পাব না।’ এ কথা বলে হাউমাউ করে কেঁদে ওঠেন তিনি।

তিনি আরও বলেন, ‘আমার শহীদ পুত্র সাদিক পবিত্র কোরআনের হাফেজ। সে জীবনের শেষ দিন পর্যন্ত ইসলামের জন্য পড়াশোনা ও কাজ করেছে। আল্লাহ তা'আলা তাকে শহীদের মর্যাদা দেবেন বলে আমি বিশ্বাস করি।'

তিনি আরও বলেন, শেখ হাসিনার নির্দেশেই পুলিশ আমার ছেলেকে হত্যা করেছে। আমি চাই, সরকার দোষীদের বিচারের আওতায় আনুক। আমি আমার জীবদ্দশায় হত্যাকারীদের মৃত্যুদণ্ড দেখে যেতে চাই। এটাই আমার একমাত্র চাওয়া।’

জুলাই ফাউন্ডেশন থেকে পাঁচ লাখ টাকা ও বাংলাদেশ জামায়াতে ইসলামী থেকে দুই লাখ টাকা আর্থিক সহযোগিতা পেয়েছেন বলে জানান তিনি।

সাদিকের ছোট ভাই শাহেদ বাসসকে বলেন, ‘ভাইয়া খুব ভালো মানুষ ছিল। মাওলানা হয়ে বিদেশে যাওয়ার ইচ্ছে ছিল ভাইয়ার। সেটি পূরণ হলো না। যারা আমার নিরপরাধ ভাইকে নির্মমভাবে গুলি চালিয়ে হত্যা করেছে, তাদের যেন এ দেশের মাটিতেই বিচারের আওতায় আনা হয়। তাহলেই আমার ভাইয়ের আত্মা শান্তি পাবে।’

সাদিকের চাচা মো. মাসুদ জানান, ‘সাদিকের মৃত্যুর পর ওর মা শাহনাজ বেগম মানসিকভাবে ভেঙে পড়েছেন। ছেলে সাদিককে খুব ভালোবাসতেন তিনি। মানসিকভাবে পুরোপুরি নির্ভরশীল ছিলেন তার ওপর।

তিনি বলেন, 'ভাতিজাকে হারিয়ে আমরা যে কী কষ্টে আছি, তা কাউকে বলে বোঝানো যাবে না। সে আর ফিরে আসবে না। তাই পরিবারের পক্ষ থেকে আমাদের দাবি, সাদিকের হত্যাকারীদের দ্রুত গ্রেপ্তার করে ফাঁসিতে ঝুলিয়ে মৃত্যুদণ্ড কার্যকর করা হোক।’

বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের ঘাটাইলের অন্যতম সমন্বয়ক রাকিবুল হাসান রাকিব বাসসকে জানান, ‘খুনি হাসিনা দেশটাকে শেষ করে দিয়েছে। শত শত শিক্ষার্থী শহীদ হয়েছে এই আন্দোলনে। তাদের মধ্যে আমাদের ঘাটাইল উপজেলার হাফেজ সাদিক অন্যতম। আমাদের চাওয়া, শহীদ হাফেজ সাদিকের রাষ্ট্রীয় মর্যাদার পাশাপাশি হত্যাকারীদের দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি।’

ঘাটাইল উপজেলার নির্বাহী অফিসার মো. আবু সাঈদ বলেন, ‘বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনে ঘাটাইল উপজেলার হাফেজ সাদিক নিহত হয়েছেন। তিনি ঘাটাইলের গর্ব। দেশের জন্য প্রাণ দিয়েছেন। তিনি আমাদের অকুতোভয় বীর।’