বাসস
  ২৭ ডিসেম্বর ২০২৫, ০৯:৫৮

বৃষ্টির পানি সংরক্ষণ ও ঘরোয়া ব্যবহারে গ্রামীণ নারীর অংশগ্রহণ

ফাইল ছবি

ঢাকা, ২৭ ডিসেম্বর, ২০২৫ (বাসস) : নবাবগঞ্জ থানার যন্ত্রাইল ইউনিয়নের জালালচর গ্রামনিবাসী আলিজা বেগম। তার বয়স ৩৮ বছর। পেশায় তিনি গৃহিণী। পাশাপাশি পরিবারের প্রয়োজন মেটানোর মতো সবজির চাষও করেন তিনি। তাঁর গ্রামে অনেক নারীই নিরাপদ পানির ব্যবহার নিশ্চিত করতে বৃষ্টির পানি ব্যবহার করেন। আলিজা তাদেরই একজন। 

টিনের চালে পাইপ লাগিয়ে ড্রামে সেট করে পানি সংরক্ষণ করেন আলিজা। আলিজা বৃষ্টির পানি দিয়ে মূলত ভাত-ডাল রান্না করেন বেশি। কারণ বৃষ্টির পানিতে রান্না করা ভাত খেতে খুব ভালো হয় এবং সাধারণত দ্রুত নষ্ট হয় না। ডালও খুব তাড়াতাড়ি গলে যায় এই পানিতে। 

রান্নার জন্যে এখন পুকুর বা নদীর পরিষ্কার পানি দুর্লভ। কুয়া বা ইদারার প্রচলন এখন একেবারেই নেই। আর আর্সেনিকমুক্ত টিউবওয়েলের পানি পাওয়াও কখনও-কখনও বেশ মুশকিল হয়ে ওঠে। এছাড়া টিউবওয়েলের পানিতে ভাত-ডাল রাঁধলে কালো হয়ে যায়, খেতে স্বাদ লাগে না। 

গ্রামে একবার ভাত রেঁধে দিনের অনেকটা সময় রেখে খাওয়ার চল আছে। বৃষ্টির পানিতে রাঁধা ভাত বেশি সময় রেখে খাওয়া যায়। আলিজা বলেন, এলাকায় অনেকেই হাউস বানিয়ে বৃষ্টির পানি জমিয়ে রাখে। ঠিকঠাক নিয়ম মেনে বৃষ্টির পানি সংরক্ষণ করা হলে সারা বছরের ব্যবহারের জন্যে পানি সংরক্ষণ করা সম্ভব বলে তিনি জানান। 

বৃষ্টির পানি তখনই সংরক্ষণ করা হয়, যখন প্রচুর বৃষ্টি হয়। আলিজা বলেন, অনেক বৃষ্টি হলে চাল ধুয়ে যাওয়ার পর চালের কোণায় সেট করে রাখা পাইপের মুখ খুলে দেয়া হয়। পানির তোড়ে ঘরের চাল এবং পাইপের ভেতরটা ভালো করে ধুয়ে গেলে প্রস্তুত করে রাখা পরিষ্কার কাপড় বাঁধা ড্রামে পানি ভরা হয়। ৫০ লিটারের দুটো ড্রাম ভরতে পারলে সারা বছর রান্নার জন্যে নিরাপদ পানি সংরক্ষণ করা যায় বলে জানান আলিজা।

বৃষ্টির পানি সংরক্ষণ করা নিয়ে একটি কথা প্রচলিত আছে- দীর্ঘদিন ধরে রাখলে এই পানিতে পোকা হয়। আলিজা বলেন, ওনার সংরক্ষণ করা পানিতে পোকা হয় না। উনি পানি ছেঁকে রাখেন। শুরুর দিকে সাত আট দিন পর পর পানি বদলে রাখেন। তারপর আর অসুবিধা হয় না। 

গ্রামে যাদের পাকা দালান আছে তারা ছাদে ট্যাংক বসিয়ে পাইপ দিয়ে বৃষ্টির পানি ধরে রাখেন। এই গ্রামে নিরাপদ পানি ব্যবহারের জন্যে অনেক নারীই আলিজার মতো বৃষ্টির পানি সংরক্ষণ করে আসছেন।

পৃথিবীতে নিরাপদ পানির পরিমাণ দিন দিন কমছে। এর অন্যতম কারণ মানবসৃষ্ট দূষণ, যার সিংহভাগ দায় নিঃসন্দেহে উন্নতবিশ্বের দেশগুলোর ওপর বর্তায়। পরিবেশবাদীদের পরিসংখ্যানও তা-ই বলে। কিন্তু জলবায়ু পরিবর্তনের মতো ভয়ংকর বিপর্যয়ের মুখোমুখি হতে হয় উন্নয়নশীল ও সুবিধাবঞ্চিত দেশগুলোর মানুষদের। নানা রকম দুর্যোগ মোকাবেলার জন্যে যথেষ্ট প্রস্তুত থাকে না ক্ষতিগ্রস্ত দেশগুলো। তবু স্থানীয় জ্ঞানলব্ধ প্রক্রিয়ায় প্রতিরোধ জারি থাকে মানুষের। 

বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার মতে, পৃথিবীতে প্রতি ৪ জন মানুষের মধ্যে ১ জন নিরাপদ পানির সংকটে ভোগে। ২০২৪ সালের জরিপ অনুযায়ী পৃথিবীর মোট জনসংখ্যার ৭৪ % মানুষ নিরাপদ পানি ব্যবহার করতে পারে। সহজেই অনুমেয়, এই সংকট দিন দিন বেড়েই চলেছে।

জলবায়ু পরিবর্তনের ফলে ঝুঁকিপূর্ণ দেশগুলোর ভেতর বাংলাদেশের অবস্থান বিপদ জনকভাবে এগিয়ে আছে। ক্রমবর্ধমান নিরাপদ পানির সংকট এর সাথে পরোক্ষভাবে যুক্ত। নানা আভ্যন্তরীণ কারণের সাথে এই বিশেষ কারণকে চিহ্নিত করে সমাধানের উপায় খোঁজা জরুরি হয়ে পড়েছে। 

গ্রামের চেয়ে শহরে নিরাপদ পানির সংকট তুলনামূলকভাবে বেশি। তবে উপকূলীয় অঞ্চলে প্রাকৃতিক দুর্যোগের পর নিরাপদ পানির তীব্র সংকট তৈরি হওয়ার বাস্তবতা বাংলাদেশের রয়েছে। তাই বৃষ্টির পানি ব্যবহার করে নিরাপদ পানির পরিমাণ বাড়ানোর কথা বেশ কয়েক বছর ধরেই ভাবা হচ্ছে। এই বিষয়টিকে নিয়ে কিছু প্রকল্পের পরিকল্পনা করাও হয়েছে। কিন্তু তারপরও বৃষ্টির পানি যথাযথভাবে সংরক্ষণ করে ব্যবহারের বিষয়টি ব্যাপকহারে ছড়িয়ে পড়েনি।

উপকূলীয় অঞ্চলে বেশকিছু শিল্পকারখানায় সংরক্ষিত বৃষ্টির পানি ব্যবহার করার কথা ভাবা হয়েছে। সরকারি উদ্যোগের অভাব, প্রযুক্তির অভাব ও প্রকল্প বাস্তবায়নে অনিয়মের কারণে বাস্তবায়ন ক্রমশ অসম্ভব হয়ে পড়েছে। অন্যদিকে বাংলাদেশের গ্রামাঞ্চলে নারীরা ঘরোয়া কাজে নিরাপদ পানি হিসেবে দীর্ঘদিন ধরে ব্যবহার করে আসছে বৃষ্টির পানি। সেখানে আলাদা করে কোনো পঞ্চবার্ষিক পরিকল্পনা কিংবা প্রকল্পের প্রয়োজন পড়ে না। এটি পারিবারিক ও সামাজিকভাবে চর্চিত বিষয় বলেই নারীরা স্বাভাবিকভাবে আত্মস্থ করে নিয়েছে।

বিশেষজ্ঞদের মতে চার থেকে পাঁচ মিনিট বৃষ্টির পর আমরা পরিষ্কার পরিচ্ছন্ন পানি পাই যেটা পান করা সম্ভব হবে। গ্রামীণ নারীরা তাদের ব্যবহারিক জ্ঞান থেকেই জানে বৃষ্টি পড়ার সাথে সাথেই পানি পাত্রে ধরে রাখতে নেই। তারা এভাবেই বিজ্ঞান-সম্মত উপায়ে পানি সংরক্ষণ করে আসছে দীর্ঘদিন ধরে।

বৃষ্টির পানি পান করা ও ঘরোয়া কাজে ব্যবহারের বিষয়ে শহুরে নাগরিকরা যথেষ্ট সচেতন ও উদ্যমী নয় বলে এ বিষয়ে তেমন কোনো কার্যকরী পদক্ষেপ গ্রহণ করা হয়ে উঠছে না। তবে অপরিকল্পিত শহরের অবকাঠামোয় পানি সংরক্ষণ করার কোনো উপায় বাতলে নেয়াও সহজ নয়। 

ঢাকা শহরে বৃষ্টির পানি সংরক্ষণ করার যথাযোগ্য ব্যবস্থা না থাকায় পানি সরাসরি রাস্তা ও নর্দমায় গিয়ে পড়ে। বলা যায় বৃষ্টির পানির অপচয় হয় এতে। এই পানি ধারণ ও সংরক্ষণ করা গেলে শতকরা ৪০% পানির অপচয় রোধ হতো বলে বিশেষজ্ঞরা জানিয়েছেন। 

গ্রামে বা মফস্বল শহরে পানি সংরক্ষণের উপায় তুলনামূলকভাবে সহজ। তবে একান্ত বাধ্য না হলে বাংলাদেশের নাগরিকেরা বৃষ্টির পানি সংরক্ষণ ও ব্যবহারের কথা ভাবেন না। মূলত এ বিষয়ে সচেতনতার অভাব রয়েছে বলা যায়। 

সরকারি ও বেসরকারি পর্যায়ে নিরাপদ পানি ব্যবহারের ক্ষেত্রে বৃষ্টির পানি সংরক্ষণের বিষয়টিকে অধিকতর গুরুত্ব দেয়া জরুরি হয়ে পড়েছে। নানা কার্যকরী উদ্যোগ নেয়া সম্ভব হলে দেশে বৃষ্টির পানি যথাযথ উপায়ে সংরক্ষণ করায় সকলে আগ্রহী হয়ে উঠবে।