বাসস
  ২৪ ডিসেম্বর ২০২৫, ১৪:৫২

মাইকেল মধুসূদন দত্ত ও কপোতাক্ষ নদ: প্রকৃতি, সাহিত্য আর ইতিহাস মিলেমিশে একাকার

কপোতাক্ষ নদের ঘাট। ছবি : বাসস

মো. সাইফুল ইসলাম

যশোর, ২৪ ডিসেম্বর ২০২৫ (বাসস):‘সতত, হে নদ, তুমি পড় মোর মনে/ সতত তোমার কথা ভাবি এ বিরলে।’ সুদূর ফ্রান্সের ভার্সাই নগরীতে বসে কপোতাক্ষ নদের কথা মনে করে এভাবে নিজের জন্মভূমি ও নদের প্রতি আজন্ম তৃষ্ণার কথা জানিয়েছিলেন মহাকবি মাইকেল মধুসূদন দত্ত। 

বাংলার প্রথম আধুনিক কবি, বাংলায় অমিত্রাক্ষর ছন্দের প্রবর্তক মহাকবি মাইকেল মধুসূদন দত্তের শৈশবের স্মৃতিবিজড়িত যশোরের সেই সাগরদাঁড়ি গ্রাম আজ আর কেবল শুধু একটি গ্রামই নয়, আজ তা বাংলা সাহিত্যের এক পবিত্র তীর্থস্থানে পরিণত হয়েছে। ইতিহাস, সাহিত্য আর প্রকৃতির অনন্য মিশেলে এ জনপদটি পর্যটকদের কাছে আকর্ষণীয় হয়ে উঠেছে।

যশোর শহর থেকে প্রায় ৪৫ কিলোমিটার দূরে কেশবপুর উপজেলার সাগরদাঁড়ি গ্রামে কপোতাক্ষ নদের তীরে কবির পৈত্রিক বাড়িটি এখন প্রত্নতত্ত্ব অধিদপ্তরের অধীনে একটি সংরক্ষিত জাদুঘর। 

সাড়ে সাত একর জমির ওপর নির্মিত বিশালাকার এ জমিদার বাড়িটি উনবিংশ শতাব্দীর আভিজাত্যের প্রতীক হয়ে আছে। লাল ইটের চওড়া দেয়াল, চুন-সুড়কির কারুকাজ আবার বিশালাকৃতির খিলানগুলো দেখে আজও দর্শনার্থীরা বিমোহিত হন।  

ঐতিহাসিক এই জমিদার বাড়ির প্রায় প্রতিটি অংশই সাহিত্যপ্রেমীদের নষ্টালজিক করে তোলে। বাড়ির এক কোনে থাকা মহাকবির ‘আঁতুড় ঘর’- যেখানে ১৮২৪ সালের ২৫ জানুয়ারি জন্ম নিয়েছিলেন বাংলা সাহিত্যের এই দিকপাল। আঁতুড় ঘরের স্থানটি আজও সযত্নে সংরক্ষণ করে রাখা হয়েছে। প্রকৃত সাহিত্যপ্রেমীরা নিস্তব্ধ এই স্থানটিতে গিয়ে আজও যেন শুনতে পান মহাকবির প্রথম কান্নার সুর। এই কক্ষের আলোতেই প্রথম চোখ মেলেছিলেন বাংলার প্রথম আধুনিক কাব্যকার। 

মূল বাড়িতে প্রবেশ করতেই প্রথমেই চোখে পড়ে শান বাঁধানো আঙিনা ও ঠাকুর ঘর। বাড়ির অন্দরমহলে আছে মোট ১২টি কামরা। কবির শোবার ঘর, পড়ার ঘরসহ পুরো অন্দরমহলই দর্শনার্থীদের জন্য উন্মুক্ত। স্থাপত্যশৈলীতে রাজনারায়ণ দত্তের জমিদারির প্রতিচ্ছবি ফুটে উঠলেও সাহিত্যপ্রেমীরা বাড়িটির প্রতিটি কোনায় কোনায় খুঁজে ফেরেন মহাকবির শৈশব। বাড়ির সামনের দিকটাই রয়েছে দুর্গা মণ্ডপ, যেখানে একসময় সাড়ম্বরে পূজা উদযাপন করা হতো। 

সাগরদাঁড়িতে ঘুরতে যাওয়া পর্যটককে সবচে’ আবেগাপ্লুত করে তা হলো কপোতাক্ষ নদ ও বিদায় ঘাট। কবির বাড়ির পাশ দিয়েই বয়ে চলা এই কপোতাক্ষ নদে আজও নিয়ম করে হয় জোয়ার-ভাটা। কপোতাক্ষের সাথে শৈশবের স্মৃতি মিলিয়ে লেখা তাঁর অবিস্মরণীয় সনেট ‘কপোতাক্ষ নদ’। শুধু এজন্যই জন্য। কথিত আছে, ১৮৬২ সালে ইউরোপ থেকে দেশে ফেরার পর বজরায় চড়ে সাগরদাঁড়িতে এসেছিলেন তিনি। তার তিনি ধর্ম ত্যাগ করেছিলেন। যে কারণে পারিবারিক বিরোধ ও তখনকার সমাজপতিদের বাঁধার কারণে পৈত্রিক ভিটায় প্রবেশ করতে পারেননি। বাড়ির পাশে কপোতাক্ষের তীরে তাবু কাটিয়ে কয়েকদিন অপেক্ষা করেছিলেন। এরপর ফিরে যান।

কপোতাক্ষের তীরে যে স্থানটিতে তিনি অপেক্ষা করেছিলেন, সেটি আজও ‘বিদায় ঘাট’ নামে পরিচিতি। দর্শনার্থীরা এক ফাঁকে ঘুরে যান বিদায় ঘাটটিতেও। কপোতাক্ষের স্নিগ্ধ হাওয়া আর প্রকৃতির শান্ত পরিবেশে মহাকবির সেই স্মৃতি সাহিত্যপ্রেমীদের মাঝে আজও বিষাদময় অনুভূতির সৃষ্টি করে। 

কবির পৈত্রিক বাড়ির একটি অংশকে মিউজিয়াম বা জাদুঘরে রূপান্তর করা হয়েছে। এখানে কবির পরিবারের সদস্যদের ব্যবহৃত চেয়ার, খাট, আলমারিসহ বিভিন্ন দুর্লভ সামগ্রী সাজিয়ে রাখা আছে। এছাড়া কবির লেখা বহু চিঠি, পাণ্ডুলিপির অনুলিপিও এখানে প্রদর্শিত আছে। 

প্রতিবছর শীত মৌসুমে হাজার হাজার মানুষ কবির জন্মভিটায় পিকনিক করতে যান। এছাড়া সারাবছরই পারিবারিকভাবে বা ছোট ছোট দলে সাগরদাঁড়িতে ভিড় জমান পর্যটকরা। কবির জন্মদিন উপলক্ষে প্রতিবছর ২৫ জানুয়ারি সরকারিভাবে সাতদিন বা দশদিনের ‘মধুমেলা’র আয়োজন করা হয়। মেলা চলাকালীন প্রতিদিনই মেলা প্রাঙ্গনে মহাকবির জীবন ও সৃষ্টি নিয়ে আলোচনা অনুষ্ঠান হয়। যেখানে দেশ-বিদেশের প্রখ্যাত কবি-সাহিত্যিকরা আলোচনায় অংশ নেন। পুরো মেলায় লাখো মানুষের সমাগম হয়। পুরো সাগরদাঁড়ি উৎসবমুখর হয়ে ওঠে।

পর্যটক বৃদ্ধির সঙ্গে সাগরদাঁড়িতে ধীরে ধীরে পর্যটন সুবিধাও গড়ে উঠছে। মিউজিয়াম কমপ্লেক্সের বাইরে বিশাল বাগান ও পার্কিং সুবিধা করা হয়েছে। পিকনিক করতে আসা দর্শনার্থীদের জন্য আছে রান্নাবান্নার আলাদা জায়গা, আছে গণ শৌচাগারও। দূর-দূরান্ত থেকে আসা পর্যটকদের রাত্রিযাপনের জন্য আধুনিক সুযোগ সুবিধা সম্বলিত রেস্ট হাউজ নির্মাণ করেছে পর্যটন কর্পোরেশন। এছাড়াও আছে জেলা পরিষদের ডাকবাংলো। 

কপোতাক্ষে আজও জোয়ার-ভাটা হয়। তবে কালের পরিক্রমায় তার সেই প্রমত্তা যৌবন এখন আর নেই। দত্তবাড়ির সেই জৌলুসও ফিকে হয়ে গেছে। তারপরও মহাকবির শৈশবের স্মৃতিময় সেই পৈত্রিক ভিটা আর কপোতাক্ষ নদের টানে আজও সাহিত্যপ্রেমীরা আজও দলে দলে ভীড় জমান সাগরদাঁড়িতে। আজও যেন তাদের কানে প্রতিধ্বনিত হয় কবির সেই আকুতি, ‘দাঁড়াও, পথিক-বর, জন্ম যদি তব বঙ্গে! / তিষ্ঠ ক্ষণকাল ...