শিরোনাম

ঢাকা, ২৭ অক্টোবর, ২০২৫ (বাসস): ঢাকা চেম্বার অব কমার্স অ্যান্ড ইন্ডাস্ট্রি (ডিসিসিআই) আয়োজিত এক গোলটেবিল আলোচনায় বক্তারা বলেছেন, পরিবর্তনশীল তথ্যপ্রযুক্তির বর্তমান সময়ের অর্থনৈতিক কার্যক্রমে ক্রমশ পরিবর্তন পরিলক্ষিত হচ্ছে। যা মোকাবেলায় বাংলাদেশকে দক্ষ মানবসম্পদ তৈরিতে অধিক হারে মনোনিবেশ করা জরুরি।
এছাড়াও দেশের সামগ্রিক শিক্ষা ব্যবস্থার আধুনিকায়ন, কারিগরি ও ভোকেশনাল শিক্ষা কার্যক্রম সম্প্রসারণ, বাজেট বরাদ্দ নিশ্চিতকরণ, চতুর্থ শিল্প বিপ্লবের চ্যালেঞ্জ মোকাবেলায় প্রয়োজনীয় প্রশিক্ষণ প্রদান, সংশ্লিষ্ট সরকারি সংস্থাগুলোর মধ্যকার সমন্বয় সাধনের পাশাপাশি শিক্ষা ও শিল্পখাতের সম্পর্ক উন্নয়নের ওপর সভায় গুরুত্বারোপ করা হয়।
আজ রাজধানীর মতিঝিলে ডিসিসিআই মিলনায়তনে অনুষ্ঠিত ‘চতুর্থ শিল্প বিপ্লবের প্রেক্ষাপটে স্মার্ট মানবসম্পদ উন্নয়ন’ শীর্ষক গোলটেবিল আলোচনায় বক্তারা এসব কথা বলেন।
গোলটেবিল আলোচনা সভায় প্রধান অতিথি হিসেবে উপস্থিত ছিলেন জাতীয় দক্ষতা উন্নয়ন কর্তৃপক্ষের (এনএসডিএ) নির্বাহী চেয়ারম্যান ড. নাজনীন কাউসার চৌধুরী।
ড. নাজনীন কাউসার চৌধুরী বলেন, প্রশিক্ষণ প্রদানে নিয়োজিত সরকারি সংস্থাগুলোর সমন্বয়হীনতা রয়েছে।
সেই সঙ্গে মানবসম্পদের দক্ষতা উন্নয়নে সকল স্তরের সচেতনতার অভাবের বিষয়টিও পরিলক্ষিত হচ্ছে।
প্রতিষ্ঠার পর থেকে এনএসডিএ নিজের আইনগত কাঠামো, ভৌত ও প্রশাসনিক অবকাঠামোর ওপর নজর দিলেও বর্তমানে দক্ষ মানবসম্পদ তৈরিতে প্রশিক্ষণের ওপর বেশি মনোযোগী হয়েছে।
নির্বাহী চেয়ারম্যান জানান, জাপানে ১ লাখ দক্ষ বাংলাদেশি প্রেরণের লক্ষ্যে সরকারি ও শিক্ষাখাতের সহায়তায় জাপানি ভাষা শেখানোর উদ্যোগ গ্রহণ করা হয়েছে। এছাড়াও বিশেষ করে নারীদের দক্ষতা উন্নয়নে প্রশিক্ষণ প্রদানের ওপর তিনি জোরারোপ করেন। তিনি চতুর্থ শিল্প বিপ্লবের সঙ্গে মানবসম্পদের দক্ষতা উন্নয়নের বিষয়টি সম্পৃক্ত করার পাশাপাশি সরকারি-বেসরকারি খাতের সমন্বয় বাড়ানোর প্রস্তাব করেন।
অনুষ্ঠানে স্বাগত বক্তব্যে ডিসিসিআই সভাপতি তাসকীন আহমেদ বলেন, চতুর্থ শিল্প বিপ্লব কেবল প্রযুক্তিগত পরিবর্তন নয় বরং উৎপাদন ব্যবস্থা, ব্যবসা-বাণিজ্য এবং শ্রমবাজারে গভীর ও মৌলিক রূপান্তর এনেছে, বিশেষ করে কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা (এআই) আমাদের শিল্প ও সেবাখাতে ব্যাপক প্রভাব ফেলছে।
তিনি জানান, ওয়ার্ল্ড ইকোনোমিক ফোরামের তথ্য মতে আগামী পাঁচ বছরে বর্তমান চাকরির বাজার প্রায় এক-চতুর্থাংশ বদলে যাবে। ২০৩০ সালের মধ্যে বিশ্বব্যাপী প্রায় ১৭ কোটি নতুন কর্মসংস্থানের সুযোগ তৈরি হলেও একই সময়ে ৯ কোটি ২০ লাখ মানুষ চাকরি হারানোর ঝুঁকিতে পড়তে পারেন।
ডিসিসিআই সভাপতি আরও বলেন, এলডিসি পরবর্তী সময়ের প্রতিযোগিতায় টিকে থাকতে স্মার্ট মানবসম্পদই হবে বাংলাদেশের একমাত্র হাতিয়ার। তবে তাদেরকে প্রযুক্তিনির্ভর নতুন যুগের কর্মসংস্থানে নিজেদের উপযুক্ত করে তুলতে হবে। বিদ্যমান পরিস্থিতি মোকাবেলায় দেশের শিক্ষা ব্যবস্থার আমূল পরিবর্তন, কারিগরি শিক্ষার ওপর অধিক হারে গুরুত্বারোপ এবং শিক্ষা ও শিল্পখাতের সমন্বয় বাড়ানোর কোনো বিকল্প নেই বলে মনে করেন ডিসিসিআই সভাপতি।
আলোচনা সভায় মূল প্রবন্ধ উপস্থাপনকালে যুক্তরাজ্যের রিডিং বিশ্ববিদ্যালয়ের অর্থনীতি বিভাগের ভিজিটিং অধ্যাপক ড. এম নিয়াজ আসাদুল্লাহ বলেন, এটুআই ও ইউএনডিপি’র ২০১৯ সালের গবেষণায় দেখা যাচ্ছে তথ্যপ্রযুক্তি ব্যবহারের ফলে ২০৩০ সালের মধ্যে বাংলাদেশের তৈরি পোশাক, খাদ্য ও কৃষি, ফার্নিচার, পর্যটন ও হসপিটালিটি খাতে প্রায় ৫৩ লাখ ৮ হাজার লোকের কর্মসংস্থান হারানোর সম্ভাবনা রয়েছে। এমতাবস্থায় দেশের কর্মরত মানবসম্পদকে প্রযুক্তি ব্যবহারে প্রশিক্ষণের মাধ্যমে দক্ষতা উন্নয়নের ওপর অধিক হারে গুরুত্বারোপ করতে হবে।
তিনি সামগ্রিক শিক্ষা কার্যক্রমের যুগোপযোগীকরণের পাশাপাশি কারিগরি শিক্ষায় আধুনিক প্রযুক্তির ব্যবহার বাড়ানোর প্রস্তাব করেন। এছাড়াও দক্ষতা উন্নয়ন কর্মসূচি বাস্তবায়নে বাজেট বরাদ্দ নিশ্চিতের ওপর জোরারোপ করেন নিয়াজ আসাদুল্লাহ।
অনুষ্ঠানের নির্ধারিত আলোচনায় বাংলাদেশ হাই-টেক পার্ক কর্তৃপক্ষের যুগ্ম-সচিব (আইসিটি ডিভিশন) মোহাম্মদ সাইফুল হাসান, বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি মন্ত্রণালয়ের উপ-সচিব মোহাম্মদ সাজেদুল ইসলাম, ইস্ট ওয়েস্ট বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য অধ্যাপক ড. শামস রহমান, দ্য ইনস্টিটিউট অব কস্ট অ্যান্ড ম্যানেজমেন্ট অ্যাকাউন্টস অব বাংলাদেশ (আইসিএমএবি)-এর সভাপতি মাহতাব উদ্দিন আহমেদ, ট্রান্সকম গ্রুপের কর্পোরেট মানবসম্পদ বিভাগের প্রধান এম সাব্বির আলী, ব্রিটিশ আমেরিকান টোবাকোর রিজিওনাল সিনিয়র ম্যানেজার খান মোহাম্মদ শফিকুল আলম, বুয়েটের কম্পিউটার সায়েন্স অ্যান্ড ইঞ্জিনিয়ারিং বিভাগের অধ্যাপক ড. মোহাম্মদ মাসরুর আলী এবং ব্রেইন স্টেশন ২৩-এর প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা রাইসুল কবীর অংশগ্রহণ করেন।
হাই-টেক পার্কগুলোতে একক ও যৌথ বিনিয়োগের জন্য দেশীয় ও বিদেশি উদ্যোক্তাদের প্রতি আহ্বান জানান মোহাম্মদ সাইফুল হাসান।
অধ্যাপক ড. শামস রহমান বলেন, শিল্পখাতের চাহিদার নিরিখে দেশের শিক্ষা ব্যবস্থায় দক্ষ মানবসম্পদ তৈরি করতে পারছে না। তাই দক্ষ মানবসম্পদ তৈরিতে শিক্ষা-শিল্পখাতের সমন্বিত কার্যক্রম জরুরি।
আইসিএমএবি সভাপতি মাহতাব উদ্দিন আহমেদ বলেন, আমাদের শিক্ষার্থীদের মাত্র ২০ শতাংশ তাদের দক্ষতা অনুযায়ী চাকরি পেয়ে থাকে এবং প্রায় ২ মিলিয়ন শিক্ষার্থী বেকার রয়েছে। এ অবস্থা মোকাবেলায় কারিগরি শিক্ষার ওপর জোরারোপ ও সমাজের সকল স্তরের মানসিকতা পরিবর্তনের ওপর তিনি গুরুত্বারোপ করেন।
তথ্যপ্রযুক্তি ও অটোমেশনের ফলে কী ধরনের সুবিধা পাওয়া যাবে, সে বিষয়ে উদ্যোক্তাদের আরও সচেতনতা বাড়ানো, সরকারি সংস্থাগুলোর মধ্যকার সমন্বয় বৃদ্ধি এবং প্রশিক্ষণ কার্যক্রম নজরদারির জন্য একটি আলাদা জাতীয় কাউন্সিল স্থাপনের প্রস্তাব করেন এম সাব্বির আলী।
খান মোহাম্মদ শফিকুল আলম বলেন, দক্ষতা উন্নয়নে বাণিজ্যিক প্রতিষ্ঠানগুলোর প্রশিক্ষণ ও সচেতনতা বৃদ্ধি এবং শিক্ষা কারিকুলামের যুগোপযোগীকরণে প্রয়োজনীয় সংস্কার জরুরি।
অধ্যাপক ড. মোহাম্মদ মাসরুর আলী বলেন, গ্রাম ও শহরের বিদ্যালয়গুলোর শিক্ষামানে বড় ধরনের পার্থক্য রয়েছে। ফলে আমাদের শিক্ষার্থীরা প্রাথমিক স্তর থেকেই বৈষম্যের শিকার হচ্ছে, তাই শিক্ষার সকল স্তরে মান নিশ্চিত করা জরুরি।
রাইসুল কবীর বলেন, কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা ব্যবহারের মাধ্যমে দ্রুত ও মানসম্মত কাজের চাহিদা বাড়ছে। এর কারণে কর্মসংস্থান সংকুচিত হওয়ার সম্ভাবনা কম, তবে ভবিষ্যতের চাহিদার নিরিখে প্রশিক্ষণের মাধ্যমে এ খাতের মানবসম্পদের দক্ষতা উন্নয়নে মনোযোগী হতে হবে।
মুক্ত আলোচনায় ডিসিসিআইয়ের সাবেক সহ-সভাপতি এম আবু হোরায়রাহ বিদেশে দক্ষ মানবসম্পদ প্রেরণের ওপর জোরারোপ করেন। যার মাধ্যমে আরও বেশি হারে রেমিট্যান্স আহরণ সম্ভব, সেই সঙ্গে কারিগরি শিক্ষা কার্যক্রম সম্প্রসারণের ওপর তিনি জোরারোপ করেন।
এছাড়াও ডিসিসিআই পরিচালক মোহাম্মদ জমশের আলী, স্ট্যান্ডিং কমিটির আহ্বায়ক মীর শাহরুক ইসলাম প্রমুখ মুক্ত আলোচনায় অংশগ্রহণ করেন।