শিরোনাম
শাহজাহান নবীন
ঝিনাইদহ, ১৬ অক্টোবর, ২০২৫ (বাসস) : পঞ্জিকার পাতার সঙ্গে বদলে যাচ্ছে ঝিনাইদহের প্রকৃতি। শরতের শুভ্রতা ও প্রকৃতির নান্দনিক পালাবদলের বিদায়ি বার্তা নিয়ে প্রকৃতিতে এসেছে হেমন্ত। হেমন্তের হাত ধরেই প্রকৃতিতে শুরু হয়েছে শীতের আগমনি। এসময় প্রকৃতিতে নয়নাভিরাম সৌন্দর্যের দেখা মিলছে। জেলার গ্রামাঞ্চলে এরই মধ্যে প্রকৃতি জানান দিচ্ছে শীতের আগমনি বার্তা।
সরেজমিনে দেখা যায়, চলতি মাসের ১০ তারিখের পর থেকে জেলায় শীতের আবহ শুরু হয়েছে। কার্তিক-অগ্রহায়ণ দুই মাস হেমন্ত কাল। পঞ্জিকা অনুযায়ী আগামীকাল হেমন্তের শুরু। অগ্রহায়ণে নতুন ফসল ঘরে তোলার মধ্যদিয়ে বাংলার প্রকৃতি থেকে বিদায় নেবে হেমন্ত। তবে গত এক সপ্তাহ ধরে জেলার গ্রামাঞ্চলে মৃদু হিমশীতল পরিবেশ লক্ষ্য করা গেছে। বিশেষ করে, ভোরে মৃদু কুয়াশা ও রাতের শীতল হাওয়ায় শীতের আগমনি। গ্রামের প্রতিটি বাড়িতে শুরু হয়েছে শীতকালীন প্রস্তুতি। শীতে পরিধানযোগ্য গরম কাপড়, কাঁথা, কম্বল প্রস্তুত ও পরিষ্কার-পরিচ্ছন্নতার কাজে ব্যস্ত গ্রামের নারীরা। চলছে শীতকালীন পোশাক ও কাঁথা-কম্বল রোদে শুকানোর কাজ।
হেমন্তের সকাল ও সন্ধ্যা যেন শীতের প্রারম্ভিক সৌন্দর্য। এই সৌন্দর্য ছড়িয়ে পড়েছে গ্রাম থেকে গ্রামান্তরে। হেমন্তের এই দিনে মূলত বাড়িতে বাড়িতে চলছে আসন্ন শীতের প্রস্তুতি। অগ্রহায়ণে নতুন ধান আসবে কৃষকের উঠানে। গৃহস্থের উঠোনে চলছে নতুন ধান বরণের আয়োজন।
জেলার হরিণাকুণ্ডু উপজেলার চাঁদপুর গ্রামের গৃহবধূ জাহারন নেসা (৪০) বাসসকে বলেন, বর্ষাকাল চলে গেছে। বৃষ্টির সময় বাড়ির চারপাশে ঝোপ-জঙ্গল হয়ে যায়। কাদাপানি জমে থাকে। এখন শীতের টান চলে এসেছে। বসত বাড়ির আঙিনা পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন করতে কাজ করছে গৃহবধূরা। গ্রামের প্রতিটি বাড়িতেই এখন উঠান প্রস্তুত করতে আমরা ব্যস্ত। মাস খানিক পরেই আসবে নতুন ধান।
সদর উপজেলার হলিধানী ইউনিয়নের নাটাবাড়িয়া গ্রামের গৃহবধূ মিনারা খাতুন (৪৫) বাসসকে বলেন, কার্তিক মাসের শুরু থেকেই গ্রামের বাড়িতে বাড়িতে শীতকে উপলক্ষ করে বাড়তি প্রস্তুতি চলে। লেপ-কাঁথা তৈরিসহ শীতের পোশাক ধুয়ে শুকিয়ে ব্যবহারের উপযোগী করতে হয়। আবার অগ্রহায়ণের শুরু থেকে আমন ধান ঘরে আসবে। ধান মাড়াইয়ের জন্য উঠান প্রস্তুত করতে হয়। প্রতিবছর গ্রামের সব বাড়িতেই এই কাজগুলো করেন গৃহবধূরা। পরিবারের অন্য সদস্যরাও এসব কাজে একে অপরকে সহযোগিতা করে।
কালীগঞ্জ উপজেলার বালিয়াডাঙ্গা গ্রামের গীতা রানি (৬০) বলেন, আমরা ছোট বয়স থেকে সংসার করছি। আগে কার্তিক মাসে গ্রামে গ্রামে নানান ধরনের গান-বাজনা হতো। নানান রকম কুসংস্কারও ছিল। আমরা ছোট বেলায় কার্তিক-অগ্রহায়ণ মাসের শীত দেখেছি। এখন আর সেই শীত নেই। আগে বছরের এই সময় মাটির দেয়াল, উঠান, বাহিরবাড়ি (খানকা/বৈঠকখানা) লেপাপোছার কাজে বউ-ঝি’রা ব্যস্ত থাকতো। এখন তো খানকা বা বৈঠকখানা আর নেই। আগে গ্রামের বউ-ঝি’রা মিলেমিশে সবাই সবার লেপ, মোটা কাঁথা (ধোপড়া) বানাতাম।
তিনি বলেন, এখনো গ্রামে সেই আগের মতো লেপ, কাঁথা বানানোর চল আছে। গ্রামের নারীরা মিলেমিশে একে অপরের কাজে সহযোগিতা করে। যাকে বলে ‘গাতা’ করে কাজ করা।
সদর উপজেলার রামনগর প্রাথমিক বিদ্যালয়ের শিক্ষক মিজানুর রহমান আজ সকালে প্রাতঃভ্রমণ কালে বাসসকে বলেন, প্রকৃতির বৈচিত্র্য বোঝা বড় দায়। সপ্তাহ খানিক আগেই চরম গরম ও বৃষ্টিতে মানুষ ছিল বিপাকে। এখন গরম উধাও। সকাল-সন্ধ্যা শীতের আমেজ। প্রকৃতিতে দারুণ একটা পরিবর্তন এসেছে। হেমন্তকালের মৃদু শীত উপভোগ করার মতো। সকালে হাঁটতেও ভালো লাগে। বছরের এই সময়টায় কৃষকেরা নতুন ফসল ঘরে তোলার আশায় দিন গোনে।
জেলা শহরের পুলিশ লাইন্স স্কুল অ্যান্ড কলেজের শিক্ষক আব্দুল্লাহ আল ফারুক বাসসকে বলেন, শহরের পাশেই আমার গ্রামের বাড়ি। আমি গ্রামীণ জীবনধারা ও শহুরে জীবনাচার দেখেছি। বাঙালির ঐতিহ্যবাহী গ্রামীণ জীবনাচার বাংলার ছয়টি ঋতুর সাথে নিবিড়ভাবে যুক্ত। বাংলা ঋতু ও পঞ্জিকা অনুযায়ী পৌষ ও মাঘ মাস শীত কাল। কার্তিক-অগ্রহায়ণ মাস হেমন্ত। ঋতু ও প্রকৃতির বৈচিত্র্যের কারণেই বাংলাদেশ প্রাকৃতিক ভাবে বিশ্বে অনন্য।
তিনি বলেন, হেমন্তে বাংলাদেশের ঋতুতে দারুণ পরিবর্তন আসে। দিনের বেলা মাঝারি গরম থাকলেও সারাদিন মৃদু শীতলতা থাকে বাতাসে। বিশেষ করে ভোরের মৃদু কুয়াশা, ফসলের ডগায় জমে থাকা শিশির বিন্দু, নতুন শাক সবজির কাঁচা ঘ্রাণ ও আমনের বিস্তীর্ণ সুবজ ধান ক্ষেত হেমন্তের বার্তা বয়ে আনে। সেই সাথে আসে শীতের আগাম হাতছানি।