শিরোনাম
।। মাহামুদুর রহমান নাযীদ।।
ঢাকা, ২৮ আগস্ট, ২০২৫ (বাসস) : পুরান ঢাকার কলতাবাজারের এক সরু গলিতে হেঁটে যাওয়ার সময় হঠাৎ করেই রবিউল আলম থমকে দাঁড়ান। লক্ষ্মীপুর থেকে আসা এই ব্যবসায়ী পুরান ঢাকায় এসেছেন মালামাল কেনার উদ্দেশ্যে। কিন্তু ওই মুহূর্তে তার মনোযোগ আটকে যায় একটি ঘ্রাণে যা মিষ্টি, সুগন্ধি, মন কাড়ার মতো।
নবাবপুরের হোটেলে উঠার পর বিকেলটা একটু পায়ে হেঁটে ঘুরে বেড়ানোর সিদ্ধান্ত নিয়েছিলেন তিনি। কিন্তু যে ঘ্রাণটা তাকে গলির মুখের এক দোকানের সামনে নিয়ে গেল, তা যে তাকে এক ঐতিহাসিক ও সাংস্কৃতিক অভিজ্ঞতার ভেতর টেনে নিয়ে যাবে, সেটা তিনি কখনো ভাবতে পারেননি।
রবিউল একটি দোকানের সামনে এসে হঠাৎ থমকে দাঁড়ান। কাঁচের বক্সে সাজানো লালচে রঙের পিঠার মতো দেখতে কিছু একটা তার চোখে পড়ে। প্রথমে দেখে বিস্কুট বা কেক মনে হলেও, ভালো করে তাকিয়ে বুঝতে পারেন, বিষয়টা অন্যরকম। তার আগ্রহী দৃষ্টি দেখে দোকানদার হিরু মিয়া মুচকি হেসে বলেন, “এটা বাকরখানি।”
কথাটি শুনে রবিউল আলম আরও কৌতূহলী হয়ে পড়েন। পাশে থাকা বেঞ্চে বসে তিনি একের পর এক প্রশ্ন ছুড়ে দেন হিরু মিয়ার দিকে - “এতো নাম থাকতে এটির নাম বাকরখানি কেন হলো ?” ; “এটি তৈরি করেন কীভাবে?” ; “কারা খান এই খাবার?” কথা বলতে বলতে হিরু মিয়ার সঙ্গে জমে ওঠে রবিউলের আলোচনা। উঠে আসে প্রজন্ম থেকে প্রজন্ম ধরে এই পেশার সঙ্গে হিরু মিয়ার পরিবারের জড়িত থাকার গল্প।
হিরু মিয়ার বাড়ি সিলেট বিভাগের হবিগঞ্জ জেলায়। তার দোকানের বয়স প্রায় ৫০ বছর। একসময় তার বাবা চালাতেন এই দোকান, পরে দায়িত্ব নেন চাচা, আর এখন তিনিই দেখভাল করছেন ‘মায়ের দোয়া বাকরখানি’র ব্যবসা।
হিরু মিয়ার মুখে বাকরখানি তৈরির প্রক্রিয়া
বাকরখানি তৈরি শুরু হয় ময়দার খামির দিয়ে। ময়দার সঙ্গে পরিমাণ মতো লবণ, দুধ, চিনি ও তেল মিশিয়ে খামির তৈরি করা হয়। অনেকসময় স্বাদে বৈচিত্র্য আনতে এতে যোগ করা হয় দারুচিনি, এলাচ ও কালোজিরার মতো মসলা। এরপর নির্দিষ্ট আকারে কেটে বাকরখানির রূপ দেওয়া হয়। খামিরগুলো কাঠের থালায় সাজিয়ে একাধিকবার (দুই থেকে চারবার) তেল ও ময়দার আস্তরণ দেওয়া হয়।
মচমচে বাকরখানির রহস্য
ময়দার আস্তরণের পরবর্তীতে মাটির চুলায় কয়লার তাপে ৮ থেকে ১০ মিনিট পুড়িয়ে প্রস্তুত করা হয় বাকরখানি।
মাটির চুলায় কয়লার বিশেষ তাপে বাকরখানি তৈরি করায় এর আবরণে থাকা তেল শোষণ করে নেয়। এতে মচমচে হয় বাকরখানি এবং যুক্ত করে বিশেষ স্বাদ ও গঠন।
বাকরখানির বিভিন্ন ধরণ ও দাম
বর্তমানে বাজারে বিভিন্ন স্বাদের ও ধরণের বাকরখানি পাওয়া যায়। পনির বাকরখানি প্রতি কেজি ৩০০ টাকা দরে বিক্রি করা হয়ে থাকে । এক কেজিতে সাধারণত ২০ থেকে ২২টি বাকরখানি থাকে। তিলের বাকরখানি প্রতি কেজির দাম ৩০০ টাকা এছাড়া ১০ টির একটি বক্স বিক্রি হয় ১৫০ টাকায়। মিষ্টি বাকরখানি ২০০ টাকা প্রতি কেজি। ছোট আকারের মিষ্টি বাকরখানি কেজি প্রতি ২২০ টাকা। নোনতা বাকরখানি প্রতি কেজির দাম রাখা হয় ২০০ টাকা।
একটি প্রেম কাহিনী ও বাকরখানির নামকরণ
বাকরখানির উৎপত্তি মুঘল আমলে, সম্ভবত ১৭শ’ শতকে, ভারতীয় উপমহাদেশের মুর্শিদাবাদে। এটি একসময় নবাবদের রাজকীয় খাবার হিসেবে পরিচিত ছিল। জনশ্রুতি রয়েছে, বাংলার প্রথম নবাব মুর্শিদ কুলি খানের সময় থেকেই এর নামকরণের গল্প শুরু হয়। মুর্শিদ কুলি খানের পালক পুত্র মির্জা আগা বাকের খানের প্রেমকাহিনী থেকেই ‘বাকরখানি’ নামের উদ্ভব।
পারস্য থেকে আগত আগা বাকের খান ছিলেন নবাবের সেনাপতি। ঢাকার আরামবাগের নবাবদের দরবারে কর্মরত এক গুণবতী ও রূপবতী নৃত্যশিল্পী ‘খানি’র সঙ্গে তার পরিচয় ঘটে। খানি ছিলেন চমৎকার কণ্ঠের ও নৃত্যগুণের অধিকারী। এক নৃত্য অনুষ্ঠানে বাকের খাঁ তার প্রেমে পড়েন। তবে তাদের এই প্রেমের পথে বাধা হয়ে দাঁড়ান ‘জয়নুল’ নামে এক স্থানীয় ব্যক্তি। প্রেমের খবর জানতে পেরে জয়নুল খানিকে অপহরণ করেন। এতে ক্ষিপ্ত হয়ে বাকের খাঁ জয়নুলকে হত্যা করতে উদ্যত হন। পরে গুজব রটে, বাকের খাঁ-ই জয়নুলকে হত্যা করেছেন। এই অভিযোগে নবাব মুর্শিদ কুলি খাঁ তার পুত্রকে মৃত্যুদণ্ড দেন এবং বাঘের খাঁচায় বন্দি রাখেন। বাঘের খাঁচায় বন্দি অবস্থায় প্রিয়তমা খানির কথা মনে করে বাকের খাঁ একটি বিশেষ রুটি তৈরি করেন, যা আজকের ‘বাকরখানি’।
প্রেমিক যুগলের দুই নাম ‘বাকের’ ও ‘খানি’ জুড়ে এই রুটির নামকরণ হয় ‘বাকেরখানি’। পরবর্তীতে তা প্রচলিত উচ্চারণে ‘বাকরখানি’ হয়ে যায়।
পুরান ঢাকা থেকে ঢাকার অলিগলিতে
বর্তমানে শুধু পুরান ঢাকার অলিগলি নয়, নাজিরাবাজার, হাজী আলাউদ্দিন রোড, নারিন্দা, বাংলাবাজার, লক্ষ্মীবাজার, জজ কোর্টের আশপাশ ছাড়াও ঢাকার তেজগাঁও, মিরপুর, খিলগাঁওসহ বিভিন্ন জায়গায় এখন সহজেই বাকরখানি পাওয়া যায়। সাধারণত এটি মাটির চুলায় তৈরি করা হলেও এখন এক্ষেত্রে ব্যবহার করা হয় আধুনিক ওভেন।
হিরু মিয়ার সঙ্গে কথা বলতে বলতে দোকানে আসেন পুরান ঢাকারই বাসিন্দা, ৬৫ বছর বয়সী নাজিম আহম্মেদ।
তার চোখে বাকরখানি শুধু খাদ্য নয়, এক টুকরো শৈশব। তার সাথে কথা হয় বাসসের। তিনি বলেন, “বাকরখানি আমাদের জীবনের অবিচ্ছেদ্য অংশ। আমরা এটি সকালের নাশতায় এবং সন্ধ্যায় মিষ্টির সঙ্গে খেয়ে থাকি। চায়ের সঙ্গে বাকরখানি না হলে নাস্তা অসম্পূর্ণ লাগে। ছোটবেলায় চার আনা দিয়ে খেয়েছি। এখন দাম বেড়েছে, তবে চাহিদার পাশাপাশি দোকানও বেড়েছে।”
আরেক ক্রেতা মোহাম্মদ মনিরুজ্জামান বাসস’কে জানান, “বাকরখানি চর্বিযুক্ত নয়, তাই এটি একটি স্বাস্থ্যকর খাবার। আমাদের বাপ-দাদারাও এটা খেতেন, আমরাও খাই। সকালে চায়ের সঙ্গে কিংবা বিকেলে মিষ্টির সঙ্গে খাওয়ার পারিবারিক রেওয়াজ এখনও চলছে।”
হিরু মিয়া জানান, তার গ্রামের বাড়ি হবিগঞ্জ জেলায়। সেখানের প্রায় ৬৮টি গ্রামের অধিকাংশ মানুষ বাকরখানির ব্যবসার সঙ্গে জড়িত। বাকরখানির ব্যবসা অনেকের বংশপরম্পরায়। তার দোকানের যে তিনজন কর্মচারী রয়েছে তাদের বাড়িও হবিগঞ্জে।