বাসস
  ২৪ আগস্ট ২০২৫, ১৩:২২

সীমানা জটিলতায় পদ্মাপাড়ের ৪০ হাজার মানুষ

।। জহুরুল ইসলাম ।।

পাবনা, ২৪ আগস্ট, ২০২৫ (বাসস) : প্রমত্তা পদ্মার বুক চিরে প্রতিদিন যাতায়াত করতে হয় পাবনা ও কুষ্টিয়ার ১৬ গ্রামের প্রায় ৪০ হাজার মানুষকে। কাগজে-কলমে তারা একটি নির্দিষ্ট জেলার বাসিন্দা হলেও জীবনের প্রায় সব চাহিদাই মেটাতে হয় অন্য জেলায় গিয়ে। নদী-বালুর পথ পাড়ি দেওয়া এই মানুষদের দুর্দশা দীর্ঘ দিনের।

জানা গেছে, সীমানার অদ্ভুত জটিলতায় পাবনা সদর উপজেলার ভাড়ারা ও দোগাছি ইউনিয়নের ৭টি গ্রাম চলে গেছে পদ্মার ওপারে, কুষ্টিয়ার কুমারখালীর পাশে। আবার কুষ্টিয়ার চরসাদিপুর ইউনিয়নের ৯টি গ্রাম রয়ে গেছে পদ্মার এপারে, পাবনার গা ঘেঁষে। 

ফলে প্রশাসনিকভাবে এক জেলায়, অথচ জীবন-জীবিকা সম্পূর্ণ অন্য জেলায় তাদের। এমন অস্বস্তিকর বাস্তবতায় কয়েক যুগ কেটেছে হাজারো মানুষের। যে কোনো কাজ তাদের নদী পাড়ি দিয়ে ভিন্ন জেলায় গিয়ে করতে হয়।
সম্প্রতি কুষ্টিয়ার শিলাইদহ ঘাটে গিয়ে দেখা যায়, আধঘণ্টা পরপর নৌকায় করে নদী পাড় হচ্ছেন বাসিন্দারা। শিক্ষার্থী, চাকরিজীবী, কৃষক সবারই একই গন্তব্য, নিজ জেলার অফিস-কাছারি বা বাজার। কেউ চিকিৎসার জন্য আসছেন, কেউ জমিজমার কাগজপত্রে সই করতে। তবে এসব কাজ করতে শুষ্ক মৌসুমে পদ্মার ধুধু বালুচরে পাঁচ কিলোমিটার হেঁটে পাড়ি দিতে হয়।

কুমারখালীর কলেজছাত্র আবু সালেহীন বলেন, পাসপোর্টের কাজ করতে পাবনা শহরে যেতে হয়। বর্ষায় নৌকায় জীবনের ঝুঁকি নিয়ে নদী পাড় হতে হয়। বছরের পর বছর ধরে আমরা এ দুর্ভোগ পোহাচ্ছি।

পাবনার ভাঁড়ারা ইউনিয়ন পরিষদ সচিব সেলিম উদ্দিন জানান, নদীর ওপারে থাকা ৭ গ্রামের মানুষ ইউপি কার্যালয় বা কোর্ট-কাছারির কাজে এপারে আসেন। এতে সময়, অর্থ ও ঝুঁকি সবই বেড়ে যায়।

এর মধ্যে কুষ্টিয়ার চরসাদিপুর ইউনিয়নের অবস্থা বেশি করুণ বলে জানা গেছে। ২৫ বর্গমাইলের এ ইউনিয়নে প্রায় ৩০ হাজার মানুষ বাস করলেও নেই ভালো সড়ক, নেই পর্যাপ্ত শিক্ষা বা চিকিৎসা ব্যবস্থা। 

সরেজমিনে দেখা গেছে, সড়কে বড় বড় গর্ত, ইট-খোয়া বিলীন হয়ে গেছে। শুষ্ক মৌসুমে ধুলোর ধোঁয়া উড়ছে। 

আবার বর্ষায় রাস্তাঘাট কাঁদার সাগরে নিমজ্জিত হয়। 

স্থানীয়দের অভিযোগ, এলাকায় মাদক, বাল্যবিবাহ, চুরি-ডাকাতিসহ নানা অপরাধমূলক কর্মকাণ্ড লেগেই থাকে। 

সরকারি কোনো সেবা পৌঁছায় না এই দুর্গম চরে। তাই সার, বীজ বা ত্রাণ সবক্ষেত্রেই তারা বঞ্চিত হন।

স্থানীয় ইজিবর হোসেন বলেন, চরসাদিপুরের মানুষ সব কাজে পাবনার ওপর নির্ভরশীল। ইউনিয়নটি পাবনা জেলার সঙ্গে যুক্ত হলে অবহেলিত মানুষগুলো উন্নয়নের আলো দেখবে।

৭০ বছরের প্রবীণ শাহেদা আক্তার বলেন, আমি কুষ্টিয়ার বাসিন্দা, কিন্তু জীবনে কোনো দিন কুষ্টিয়া শহরে যাইনি। আমাদের সবকিছু পাবনা শহরকেন্দ্রিক।

সীমান্ত জটিলতা শুধু সড়কে থেমে থাকেনি। এর প্রভাব রয়েছে শিক্ষাক্ষেত্রে ও ভোটের মাঠে। শিক্ষার্থীরা নিয়মিত পড়াশোনা করে পাবনার স্কুল-কলেজে। তবে এসএসসি বা এইচএসসি পরীক্ষার কেন্দ্র হয় কুষ্টিয়ায়। এতে নদী পাড়ি দিতে না পারায় অনেকেই সঠিক সময়ে কেন্দ্রে পৌঁছাতে পারে না।

আবার চরসাদিপুরের তরুণদের অনেকেই এখন পাবনার ভোটার হয়েছেন। পাবনা সরকারি এডওয়ার্ড কলেজের ছাত্র রিমন হোসেন জানান, আমরা চরসাদিপুরের মানুষ কিন্তু ভোটার হয়েছি পাবনার। নতুন প্রজন্মও ভোটার হচ্ছে পাবনায়।

এসব সমস্যার সমাধান চান ভুক্তভোগী বাসিন্দারা। তারা মনে করেন, পদ্মা নদী বিচ্ছিন্ন এ বৃহৎ জনগোষ্ঠীর বাস্তবতার ভিত্তিতে নিকটবর্তী জেলার সঙ্গে প্রশাসনিকভাবে যুক্ত করাই হতে পারে একমাত্র সমাধান। 

এ বিষয়ে পাবনা জেলা প্রশাসক মোহাম্মদ মফিজুল ইসলাম বাসসকে বলেন, আবেদনের পরিপ্রেক্ষিতে পাবনা সদর উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা ও কুষ্টিয়ার কুমারখালী নির্বাহী কর্মকর্তা এলাকাবাসীদের নিয়ে একাধিকবার সীমানা নির্ধারণে যৌথ সভা করেছেন। কিন্তু আইনি কিছু জটিলতা থাকায় এখন পর্যন্ত সমাধান হয়নি। তবে সমাধানের জন্য সর্বোচ্চ চেষ্টা করা হচ্ছে।