বাসস
  ১৯ মে ২০২৫, ১৬:৪২

রমনায় অশোক গাছে ফুলের লুকোচুরি খেলা

সবুজ পাতার ফাঁকে কমলা ও লালরঙের ফুলের লুকোচুরি খেলা। ছবি : বাসস

 মাহামুদুর রহমান নাযীদ 

ঢাকা, ১৯ মে, ২০২৫ (বাসস) : সবুজ পাতার ফাঁকে কমলা ও লালরঙের ফুলেরা যেন উঁকি মারছে। তবে যাদের চোখ পড়ে এই অশোক ফুলে, তারা নিসন্দেহে মুগ্ধ হয়ে বারবার তাকায়। রাজধানীর রমনা পার্কের মূল ফটক ধরে একটুখানি এগিয়ে গেলেই দেখা মেলে অশোক গাছ ও গাছে ফুলের লুকোচুরি খেলা।
 
অশোক গাছের বৈজ্ঞানিক নাম সারাকা ইনডিকা। এটির ইংরেজি নাম ইয়েলো অশোক। গাছটি সেসালপিনিয়াসি গোত্রের অন্তর্ভুক্ত। অশোক গাছটি সাধারণত ফুলের জন্য বিখ্যাত। গাছটি এই অঞ্চলের নিজস্ব বৃক্ষ। শুধু তাই নয় অশোক ফুল ভারতের ওড়িশার রাজ্য ফুল। অশোককে বলা হয় বসন্তকালের ফুল। তবে হেমন্ত অবধি গাছে ফুল ফুটতে দেখা যায়। তাছাড়াও শীতকালেও অল্প সংখ্যায় ফুল ফুটতে দেখা যায়।

অশোক গাছটি মাঝারি আকৃতির ছায়াদানকারী চিরসবুজ বৃক্ষ। এর গাঢ়-সবুজ পাতাগুলো দীর্ঘ, চওড়া ও বর্শাফলাকৃতির। কচিপাতা কোমল, নমনীয় ও ঝুলন্ত। ফুল আকারে ছোট, কিন্তু বহুপৌষ্পিক, ছত্রাকৃতি। তাজা ফুলের রঙ কমলা কিন্তু বাসি ফুল লাল রঙ ধারণ করে। অশোক ফল বড় শিমের মতো চ্যাপ্টা, পুরু এবং বেগুনি রঙের। ভারতে ও বাংলাদেশে রাজ অশোক এবং স্বর্ণ অশোক নামে দুই রকমের অশোক গাছ দেখা যায়। অশোক ফলের বীজ থেকে সহজেই চারা জন্মায়।

অশোক ফুল হিন্দু ও বৌদ্ধদের কাছে অত্যন্ত পবিত্র। কথিত আছে, গৌতম বুদ্ধ লুম্বিনিতে এই গাছের নিচে জন্মগ্রহণ করেছিলেন। হিন্দু পৌরাণিক কাহিনী মতে, গৌরী দেবী এই বৃক্ষের নিচে তপস্যা করে সিদ্ধি লাভ করেছিলেন। 

রামায়ণে বলে সীতাকে অপহরণ করে অশোক বনে রাখা হয়েছিল। অশোক ফুল প্রেমের প্রতীক। তাই তো বিশ্বকবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর লিখেছেন-
‘তোমার অশোকে কিংশুকে
অলক্ষ্য রঙ লাগল আমার
অকারণের সুখে।’

জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয় উদ্ভিদবিজ্ঞান বিভাগের চেয়ারম্যান অধ্যাপক ড. শাহরিয়ার আহম্মেদ বলেন, ‘অশোক গাছটি মূলত ভারতীয় উপমহাদেশ, থাইল্যান্ড, মালয়েশিয়া এবং ইন্দোনেশিয়ার স্থানীয় উদ্ভিদ। তবে সারাকা ইন্ডিকা প্রজাতিটি প্রাকৃতিকভাবে ভারতে পাওয়া যায় না, এটি দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার পূর্ব দিকের প্রজাতি। ভারতে যে অশোক গাছটি ব্যাপকভাবে দেখা যায় এবং ঔষধিগুণে ব্যবহৃত হয়, সেটি আসলে সারাকা অশোকা।’

গাছটির বর্ণনায় তিনি বলেন, ‘সাধারণত ৬-৯ মিটার (২০-৩০ ফুট) পর্যন্ত উঁচু হতে পারে, তবে কিছু ক্ষেত্রে ২০ মিটার (৬৬ ফুট) পর্যন্তও দেখা যায়। গাছটির সরল কাণ্ড এবং বিস্তৃত, ঘন পাতাযুক্ত ডালপালা থাকে যা একটি ছাতা আকৃতির রূপ নেয়। এটির বাকল গাঢ় বাদামী থেকে প্রায় কালো রঙের, অসমান এবং আঁচিলযুক্ত হতে পারে। পাতাগুলো যৌগিক, প্রতিটি পাতায় ৬-১২টি ছোট, লম্বাটে এবং গাঢ় সবুজ রঙের পাতা থাকে। নতুন পাতা তামাটে বা লালচে রঙের হয় এবং ঝুলন্ত অবস্থায় থাকে। ফুলগুলো সুগন্ধিযুক্ত, বিশেষ করে রাতে তীব্র সুবাস ছড়ায়। ফুল সাধারণত ফেব্রুয়ারি থেকে এপ্রিল মাসে ফোটে। গাছটির ফলগুলো চ্যাপ্টা, লম্বাটে শুঁটি আকৃতির হয় এবং প্রতিটি শুঁটিতে কয়েক বীজ থাকে।’

গাছটির সাংস্কৃতিক, ঔষধি, ধর্মীয় উল্লেখ করে, অধ্যাপক শাহরিয়ার বলেন, ভারতীয় সংস্কৃতি ও হিন্দু ধর্মে অশোক গাছের বিশেষ তাৎপর্য রয়েছে। এটিকে পবিত্র গাছ হিসেবে গণ্য করা হয় এবং বিভিন্ন ধর্মীয় অনুষ্ঠানে এর ব্যবহার দেখা যায়। ‘অশোক’ নামের অর্থ ‘দুঃখহীন’, যা শান্তি ও আনন্দের প্রতীক। অশোক গাছের বিভিন্ন অংশ, যেমন- বাকল, ফুল, পাতা এবং বীজ ঐতিহ্যবাহী ভারতীয় আয়ুর্বেদ, ইউনানি চিকিৎসাপদ্ধতিতে বহু রোগের নিরাময়ে ব্যবহৃত হয়। উল্লেখযোগ্য ঔষধি ব্যবহার হলো- অশোক গাছের বাকলে ব্যথানাশক ও প্রদাহনাশক উপাদান রয়েছে। তাছাড়াও কিছু গবেষণায় এর জীবাণুনাশক বৈশিষ্ট্যও পাওয়া গেছে। অশোক ফুলের নির্যাস ডায়াবেটিস নিয়ন্ত্রণে সহায়ক হতে পারে। বাকলের নির্যাস ত্বকের বিভিন্ন সমস্যা, যেমন- ব্রণ ও অন্যান্য দাগ নিরাময়ে ব্যবহৃত হয়। হজমক্ষমতা বৃদ্ধিতে এবং পেটের সমস্যায় উপকার দেয়।

অশোক গাছটির ব্যাবহার সম্পর্কে তিনি বলেন, অশোক গাছের কাঠ শক্ত হলেও তা খুব বেশি টেকসই নয়। তাই এটি সাধারণত ছোটখাটো জিনিসপত্র, প্যাকিং কাঠ, ভেনিয়ার এবং প্লাইউড তৈরিতে ব্যবহৃত হয়। শুকনো কাঠ জ্বালানি হিসেবেও ব্যবহার করা যেতে পারে।

অধ্যাপক ড. শাহরিয়ার আহম্মেদ আরও বলেন, অশোক গাছ আর্দ্র গ্রীষ্মমন্ডলীয় অঞ্চলে ভালোভাবে জন্মে। এটি পূর্ণ সূর্যালোকে এবং উর্বর, সুনিষ্কাশিত মাটিতে জন্মাতে পছন্দ করে। মৌমাছিরা এই গাছের ফুলের পরাগায়ন করে থাকে। কিছু অঞ্চলে আবাসস্থল ধ্বংস এবং অতিরিক্ত ব্যবহারের কারণে এই গাছ হুমকির মুখে রয়েছে। ঔষধিগুণ সম্পন্ন বৃক্ষ যা ভারতীয় উপমহাদেশে শুধু প্রাকৃতিক সৌন্দর্যই বৃদ্ধি করে না, বরং ঐতিহ্যবাহী চিকিৎসায়ও গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখে। তবে সারাকা ইন্ডিকা এবং সারাকা অশোকা দু’টি ভিন্ন প্রজাতি হওয়ায় এদের বৈশিষ্ট্য এবং ঔষধি গুণাবলীতে কিছু পার্থক্য থাকতে পারে।