বাসস
  ১৮ মে ২০২৫, ১৪:২৩

‘ভাদ্রা’:  যেন এক ঝুলন্ত কানের দুল

ছবি : বাসস

মাহামুদুর রহমান নাযীদ

ঢাকা, ১৮ মে, ২০২৫ (বাসস): ঢাকার ফুসফুস খ্যাত রমনা পার্কের মূল ফটকের বাম দিকে পায়ে হাঁটা পথ ধরে কিছুক্ষণ হাঁটলে হঠাৎ চোখে পড়বে ঝুলন্ত হলুদ ফুল। দেখে মনে হবে যেন সোনালি কানের দুল সারি সারি ঝুলছে গাছের ডালে। এই ফুলের নাম ‘ভাদ্রা’। দেখতে সোনালি দুলের মতো। এখন জ্যৈষ্ঠ মাস হলেও নামের মতোই এ ফুল ফোটে প্রধানত ভাদ্র মাসে। তবে গ্রীষ্মের শুরু থেকে শরৎকাল পর্যন্ত ফুলটি ফোটে। সম্ভবত ভাদ্র মাসে অধিক পরিমাণে ফুল ফোটে বলে তার নামকরণ করা হয়েছে ‘ভাদ্রা’।

ভারতীয় প্রজাতি ভাদ্রা ফুলের আদি নিবাস দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়া। এটির বৈজ্ঞানিক নাম ‘জিমেলিনা আরবোরিয়া’, ফুলটির ইংরেজি নাম ‘বিচউড’, ‘ভারবেনিচ’ পরিবারের অন্তর্ভুক্ত এই উদ্ভিদটির আদি নিবাস দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়া হলেও বর্তমানে ভারত, ফিলিপাইন, মরিশাস, কেনিয়া ও তাঞ্জানিয়ার কিছু অঞ্চলে শোভাবর্ধক গাছ হিসেবে ব্যবহৃত হচ্ছে। বাংলাদেশে ঢাকার বলধা গার্ডেন, রমনা পার্কের মতো জায়গাগুলোতে এই গাছের দেখা পাওয়া গেলেও সাধারণ ফুলের বাগানে একে খুঁজে পাওয়া কঠিন।

ঝোপজাতীয় ফুলগাছটি বাগানবিলাসের মতোই লতানো ও কাঁটাযুক্ত। ফুলের রং হলুদ ৷ফুল শেষে গাছে ফল হয় । ফল আকৃতিতে কুলের মতো।ডালগুলো লতার মতো নিচের দিকে ঝুঁকে পড়ে এবং সেগুলোর একদম সামনে হলুদ ঘেরা ফুলটি ঝুলে থাকে। একটু দূর থেকে তাকালে মনে হয়, যেন কানের দুলের মতো ঝুলে আছে হলুদ ফুলটি। আমাদের দেশে এই ফুল কমই দেখা যায় । তাই একে দুর্লভ ফুল বলা যায়।

ফুল গাছটি শুধু সৌন্দর্যে নয়, ভাদ্রা ফুলের রয়েছে ভেষজ গুণও। ভাদ্রা ফলের নির্যাস চর্মরোগের প্রতিকারে ব্যবহৃত হয়। ভাদ্রা ফুলটি গরমের শুরু থেকে শীতের আগ পর্যন্ত মোহনীয় রূপে দেখা  যায়। তবে শীত সহিষ্ণু না হওয়ায় দেশের ঠাণ্ডাপ্রবণ অঞ্চলে এর চাষ করলে যত্নের প্রয়োজন পড়ে। ডাল কাটিং কিংবা বীজের মাধ্যমে এর বংশ বিস্তার করা গেলেও একটি ফলে মাত্র একটি বীজ হওয়ায় গাছটির বিস্তারে সময় লাগে।

রমনা পার্কে নিয়মিত ব্যায়াম করত আসেন ওমর ফারুক। তিনি বলেন, ‘আমি নিয়মিত পার্কে আসি তবে ভাদ্রা গাছটা আগে চোখে পড়েনি। প্রথম ভাদ্রা ফুলটা দেখে চোখ আটকে যায়। এমন ঝুলন্ত হলুদ ফুলটি আগে কখনো দেখিনি। মনে হচ্ছিল যেন প্রকৃতির কোনো কানের দুল। আজকে ফুলটি ছবি তুললাম, সাইনবোর্ড দেখে গাছটির নাম জানলাম ভাদ্রা।’

জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ের উদ্ভিদবিজ্ঞান বিভাগের চেয়ারম্যান অধ্যাপক ড. শাহরিয়ার আহম্মেদ বলেন,‘ভাদ্রা গাছ আমাদের দেশের জীববৈচিত্র্েযর একটি দুর্লভ অথচ গুরুত্বপূর্ণ উপাদান। এটির উজ্জ্বল হলুদ ফুল শুধু নান্দনিকতা নয় বরং আমাদের স্থানীয় ঔষধি ঐতিহ্যেরও প্রতিনিধিত্ব করে। বর্তমানে শহরাঞ্চলে এই গাছটি অনেকটাই অদৃশ্য হয়ে গেলেও, রমনা পার্ক বা এর মতো কিছু জায়গায় এর টিকে থাকা আশাব্যঞ্জক।’

তিনি আরও বলেন, ‘বাংলাদেশে এই গাছটি মূলত উষ্ণ ও আর্দ্র অঞ্চলে জন্মে। চট্টগ্রাম, পার্বত্য চট্টগ্রাম, সিলেট এবং অন্যান্য কিছু জেলায় প্রাকৃতিকভাবে এর দেখা মেলে। কিছু উদ্ভিদপ্রেমী ও ঔষধি গাছের সংগ্রহকারীরা তাদের বাগানেও এই গাছ লাগিয়ে থাকেন। গাছটির ফল ক্যাপসুল আকারের হয় এবং এর মধ্যে ছোট ছোট বীজ থাকে। লোকায়ত চিকিৎসায় ভাদ্রা গাছের পাতা ও অন্যান্য অংশ বিভিন্ন রোগের উপশমে ব্যবহৃত হয়। বিশেষত, পোকামাকড়ের কামড়, ফোলা এবং ত্বকের ছোটখাটো সমস্যা সমাধানে এর ব্যবহার দেখা যায়। তাছাড়াও কিছু অঞ্চলে ভাদ্রা গাছ সাপের কামড়ের প্রতিষেধক হিসেবে ব্যবহার করা হয়। তবে এর কোনো বৈজ্ঞানিক প্রমাণ পাওয়া যায়নি এবং সাপের কামড়ের ক্ষেত্রে দ্রুত ডাক্তারের পরামর্শ নেওয়া অত্যাবশ্যক।’

ফুল গাছটির কৃষি সম্ভাবনা নিয়ে তিনি বলেন, ‘শোভাময়ী উদ্ভিদ হিসেবে এর বাণিজ্যিক সম্ভাবনা রয়েছে। পরিকল্পিত চাষাবাদের মাধ্যমে এটি নার্সারি শিল্পে একটি নতুন সংযোজন হতে পারে। বর্তমানে বাংলাদেশে ভাদ্রা গাছ বিলুপ্তির ঝুঁকিতে নেই, তবে এর প্রাকৃতিক আবাস রক্ষা করা এবং নির্বিচারে সংগ্রহ রোধ করা প্রয়োজন।’