বাসস
  ১৭ মার্চ ২০২২, ১০:২৮
আপডেট  : ১৭ মার্চ ২০২২, ১৮:২৭

বঙ্গবন্ধু বললেন, তোরা বিদেশে চলে গেলে দেশ গড়বে কে? : মাজেদুর রহমান চাঁদ

॥ ফারাজী আহম্মদ রফিক বাবন ॥
নাটোর, ১৭ মার্চ, ২০২২ (বাসস) : সারাদেশটাই ছিল বঙ্গবন্ধুর নিজের আঙিনা। এদেশের মাটি আর মানুষের সঙ্গে তাঁর ছিল আতœার সম্পর্ক। কিন্তু নাটোরের উত্তরা গণভবন যেন একটু বেশি আপন। বঙ্গবন্ধুর প্রিয় আঙিনা নাটোরের উত্তরা গণভবন!
স্বাধীনতা উত্তর স্বদেশ প্রত্যাবর্তনের মাত্র এক মাসের মাথায় বঙ্গবন্ধু নাটোরে আসেন। ১৯৭২ সালের ৯ ফেব্রুয়ারি নাটোরের জন্যে একটি রেড লেটার ডে। এদিন দিঘাপতিয়ার গভর্নর হাউজকে ‘উত্তরা গণভবন’ হিসেবে নামফলক উন্মোচন করেন তিনি। গণভবনকে রাষ্ট্রীয় স্বীকৃতি প্রদানের মাধ্যমে অনন্য এক উচ্চতায় পৌঁছে যায় নাটোর।
বঙ্গবন্ধুর হৃদয়ের গহীনে ছিল নাটোরের অবস্থান। ভৌগলিক অবস্থানে উত্তরবঙ্গের প্রবেশদ্বার হওয়ায় তিনি নাটোরকে কেন্দ্র করেই উত্তরবঙ্গের উন্নয়ন পরিকল্পনার কথা ভাবেন। মন্ত্রী পরিষদের সভা নাটোরের উত্তরা গণভবনে আয়োজনের পরিকল্পনা করেন তিনি। ঘোষণা দেন, নাটোর হবে দ্বিতীয় রাজধানী। দ্বিতীয় রাজধানীর পরিকল্পনায়, নাটোরে স্থাপন করেন বাংলাদেশ টেলিভিশনের পূর্ণাঙ্গ সম্প্রচার কেন্দ্র।
উত্তরা গণভবনকে সরকার প্রধানের অন্যতম দপ্তর হিসেবে স্বীকৃতি প্রদান করে উত্তরবঙ্গের উন্নয়নের কেন্দ্র বিন্দু হিসেবে নাটোরকে নির্বাচন করেন বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব। গণভবনে মন্ত্রী পরিষদের সভা আয়োজন এবং নাটোরকে দ্বিতীয় রাজধানী করার ব্যাপারে বঙ্গবন্ধুর ঐকান্তিক আগ্রহের বিষয়টি নিশ্চিত করেছেন জেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি অধ্যাপক আব্দুল কুদ্দুস এমপি, জেলা আওয়ামী লীগের সহ-সভাপতি এডভোকেট সিরাজুল ইসলাম ও এডভোকেট কামরুল ইসলাম প্রমুখ।
পাবনা বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক প্রো-ভাইস চ্যান্সেলর ড. মো. আনোয়ারুল ইসলাম উত্তরা গণভবনে বঙ্গবন্ধুর অবস্থান প্রসঙ্গে বলেন, বঙ্গবন্ধু তাঁর শাসনামলে উত্তরবঙ্গ সফরে এলে সময় সুযোগ পেলেই নাটোরে আসতেন এবং উত্তরা গণভবনে অবস্থান করতেন। ১৯৭৩ সালের ৯ জানুয়ারি শহরের বড়হরিশপুরে এক বিশাল জনসভায় ভাষণ দেন তিনি। যথারীতি ওইদিন উত্তরা গণভবনে অবস্থান করেন। একই বছরের ফেব্রুয়ারি মাসে উত্তরের জেলাগুলোতে সফরের প্রস্তুতি হিসেবে উত্তরা গণভবনে আসেন। কিন্তু পাবনায় দলীয় একজন নেতার মৃত্যুর খবর পেয়ে তাৎক্ষণিক বঙ্গবন্ধু উত্তরা গণভবন থেকে পাবনা রওনা হয়ে যান। একই বছরে উত্তরের জেলাগুলোতে বন্যা পরিস্থিতি পরিদর্শন করে নাটোরের উত্তরা গণভবনে আসেন এবং ১ জুলাই গণভবনে আইন-শৃঙ্খলা এবং বন্যা পরিস্থিতি নিয়ে উচ্চ পর্যায়ের সভা করেন। একই দিনে গণভবনে নব নির্বাচিত রাকসু এবং রাজশাহী মেডিকেল কলেজ ছাত্র সংসদ প্রতিনিধিদের সাক্ষাৎ দেন এবং তাদেরকে দেশ সেবায় মনোনিবেশ করতে বলেন।
১৯৭৪ সালেও বঙ্গবন্ধু সপরিবারে নাটোরের উত্তরা গণভবনে আসেন। বাংলাদেশের ‘দুষ্প্রাপ্য’ ছবি সমগ্র নামের ফেসবুক পাতায় শাহরিয়ার বর্ন এর নামে পোস্ট করা ছবিতে বঙ্গবন্ধু গণভবনের হ্রদ বা পরিখা থেকে জাল দিয়ে ধরা মাছ দেখছেন। সঙ্গে রয়েছেন বঙ্গবন্ধুর কন্যা শেখ হাসিনা, শেখ রেহানা, শেখ রাসেল, জাতীয় চার নেতার অন্যতম ক্যাপ্টেন মনসুর আলীসহ অন্যান্য ব্যক্তিবর্গ। এই ছবিতে স্টাইপ গেঞ্জি, হাফপ্যান্ট, সাদা মোজা ও সাদা কেডস্ পড়া হাস্যোজ্জ্বল শেখ রাসেল আগ্রহ সহকারে মাছ দেখছেন। শেখ রাসেলের আগ্রহেই পরিখা থেকে মাছ ধরা হয়েছিল বলে জানান, গণভবনে কর্মরত নুর মোহাম্মদ।
 স্বাধীনতা পরবর্তী সময়ে রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রনেতা এবং বর্তমানে জেলা আওয়ামী লীগের সহ-সভাপতি অধ্যক্ষ মাজেদুর রহমান চাঁদ বলেন, উত্তরা গণভবনে দেখা করে বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীদের খাবার ও পোশাক সংকটের কথা বঙ্গবন্ধুকে জানাই। বঙ্গবন্ধু বলেছিলেন, তিন বছর কিছু দিতে পারবো না, দেশের সাধারণ মানুষ না খেয়ে আছে। কষ্ট করে ভার্সিটি চালু রেখেছি। তবে, অল্প ক’দিনের মধ্যে টিসিবি’র মাধ্যমে বিশ্ববিদ্যালয়ে সকল শিক্ষার্থীর কাছে পোশাক পৌঁছে যায়। একবার বৃত্তি নিয়ে দেশের বাইরে যাওয়ার কথা বলাতে বঙ্গবন্ধু বিদেশ যেতে নিষেধ করে বলেছিলেন, তোরা চলে গেলে দেশ গড়বে কে? দেশের উন্নয়ন চিন্তায় মগ্ন থাকতেন বঙ্গবন্ধু। তিনি মাটি আর মানুষের কাছে থাকতে পছন্দ করতেন, পছন্দ করতেন না তোষামোদী।
ছাত্রলীগের সাবেক নেতা, নাটোর নবাব সিরাজ-উদ-দৌলা কলেজের দুই বারের ভিপি এবং পরবর্তীতে সংসদ সদস্য মজিবর রহমান সেন্টু বলেন, বঙ্গবন্ধুর স্মরণশক্তি ছিল প্রখর, ছাত্রলীগ নেতাদের নাম মনে রাখতে পারতেন। বঙ্গবন্ধু লুটেরাদের বিদায় করার অভিপ্রায় ব্যক্ত করে বলতেন, ছাত্রলীগকে সংগঠিত করতে হবে।  
গণভবনকে সুশোভিত ও সুরভিত করছে সাতটি হৈমন্তি গাছ। রাণীমহলের গাছটি বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান রোপন করেছিলেন বলে জেলা প্রশাসন একটি ফলক দিয়েছে। সাবেক জেলা প্রশাসক শাহিনা খাতুনের সময়ে মৃতপ্রায় হৈমন্তি গাছটি বাঁচিয়ে তুলতে পদক্ষেপ গ্রহণ করা হয় আর নামফলক দেয়া হয়।
তবে, উত্তরা গণভবনে কর্মরত সবচে’ পুরনো মানুষ অবসরপ্রাপ্ত গার্ডেনার আব্দুল হাকিম অসুস্থ্য অবস্থায় শয্যাশায়ী থাকাকালীন জানিয়েছিলেন, ৯ ফেব্রুয়ারি ১৯৭২ সালে বঙ্গবন্ধু নাটোরে এসে গভর্নর হাউজকে গণভবন হিসেবে নামফলক স্থাপন করেন এবং রাজপ্রাসাদের সামনে একটি গাছের চারা রোপণ করেন।
সম্প্রতি নাটোর জেলা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক সংসদ সদস্য শফিকুল ইসলাম শিমুল বঙ্গবন্ধুর রোপন করা হৈমন্তি গাছ নিয়ে কথা বলেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সঙ্গে। সংসদ সদস্য প্রধানমন্ত্রীকে উদ্বৃত করে বলেন, নামফলক দেয়া হৈমন্তি গাছটি বঙ্গবন্ধুর রোপিত নয়। তবে, বঙ্গবন্ধুর প্রিয় ফুলের তালিকায় ছিল হৈমন্তি। এই গাছের তলায় প্রিয় সময় উপভোগ করেছেন তিনি, করেছেন কবিতা আবৃত্তি। উত্তরা গণভবন ছিল বঙ্গবন্ধুর প্রিয় আঙিনা। এই আঙিনায় প্রকৃতির মাঝে তিনি খুঁজে পেতেন দু’দন্ড শান্তির পরশ।

 

  • সর্বশেষ
  • জনপ্রিয়