বাসস
  ১৩ নভেম্বর ২০২৫, ১৭:৪৫

১৮ মাসের মধ্যে ব্যাংক আমানতের দ্বিতীয় সর্বোচ্চ প্রবৃদ্ধি

ঢাকা, ১৩ নভেম্বর, ২০২৫ (বাসস): ২০২৫ সালের সেপ্টেম্বরের শেষে বাংলাদেশের ব্যাংক আমানত বছরওয়ারি আমানতের পরিমাণ ৯ দশমিক ৯৮ শতাংশ বৃদ্ধি পেয়েছে, যা গত ১৮ মাসের মধ্যে দ্বিতীয় সর্বোচ্চ প্রবৃদ্ধি হার।

এই শক্তিশালী পারফরম্যান্স কয়েক মাসের স্থবিরতার পর ব্যাংকিং খাতের প্রতি জনগণের আস্থা পুনরুদ্ধারের স্পষ্ট ইঙ্গিত দেয়।

সেপ্টেম্বরে এ অর্জনের আগে আগস্ট মাসে প্রবৃদ্ধি ছিল আরও বেশি-১০ দশমিক ০২ শতাংশ, যা গত ১৭ মাসের মধ্যে সর্বোচ্চ হার।

এর আগে, আগস্ট থেকে এই ইতিবাচক ধারা শুরুর আগে টানা ১৩ মাস আমানত প্রবৃদ্ধি ৯ শতাংশের নিচে ছিল। সর্বশেষ ৯ শতাংশ ছাড়িয়েছিল ২০২৪ সালের জুনে, যখন তা ছিল ৯ দশমিক ২৫ শতাংশ।

বাংলাদেশ ব্যাংকের তথ্য অনুযায়ী, ২০২৫ সালের সেপ্টেম্বর শেষে ব্যাংকিং খাতে মোট আমানতের পরিমাণ দাঁড়িয়েছে ১৯ দশমিক ১৪ লাখ কোটি টাকা, যা ২০২৪ সালের সেপ্টেম্বরের ১৭ দশমিক ৪১ লাখ কোটি টাকার তুলনায় বেশি।

বিশেষজ্ঞরা সেপ্টেম্বরের এই পরিসংখ্যানকে ‘উৎসাহব্যঞ্জক’ বলে অভিহিত করেছেন। তাদের মতে, এটি গত ১৬ মাসের তুলনায় একটি উল্লেখযোগ্য পুনরুদ্ধারের প্রতিফলন।

তারা আমানত বৃদ্ধির পেছনে তিনটি মূল কারণ উল্লেখ করেছেন- শক্তিশালী ব্যাংকগুলোর প্রতি আমানতকারীদের ঝোঁক, মুদ্রাস্ফীতির তুলনায় তুলনামূলক বেশি সুদের হার এবং ট্রেজারি বিল ও বন্ডের মুনাফার হার কমে যাওয়া।

শীর্ষস্থানীয় ব্যাংকগুলোতে সবচেয়ে বেশি প্রবৃদ্ধি দেখা গেছে, কারণ আমানতকারীরা এখন ভালোভাবে পরিচালিত ব্যাংকগুলোর প্রতি বেশি আস্থা রাখছেন। গত বছর সরকার পরিবর্তনের পর অনেক গ্রাহক দুর্বল ব্যাংক থেকে টাকা তুলে নিয়ে শক্তিশালী ব্যাংকে স্থানান্তর করেছেন।

বর্তমানে অধিকাংশ ব্যাংক ৮ দশমিক ৫ শতাংশ থেকে ৯ দশমিক ৫ শতাংশ হারে আমানতের সুদ দিচ্ছে, যা সেপ্টেম্বরে রেকর্ড করা ৮ দশমিক ৩৬ শতাংশ মুদ্রাস্ফীতির চেয়ে বেশি।

প্রতিবেদনে উলে¬খ করা হয়েছে যে সেপ্টেম্বর মাসে আমানতের সুদের হার গড়ের চেয়ে ২৫ থেকে ৫০ বেসিস পয়েন্ট বেশি ছিল, যা মানুষকে নিরাপদ বিনিয়োগের বিকল্প হিসেবে ব্যাংকে তহবিল জমা করতে উৎসাহিত করেছে।

একই সময়ে, সেপ্টেম্বর মাসে ট্রেজারি বিল এবং বন্ডের মুনাফার হার শুরু করে, যার ফলে অনেক ব্যক্তি এবং প্রতিষ্ঠান তাদের বিনিয়োগ সরকারি সিকিউরিটিজ থেকে ব্যাংক আমানতে স্থানান্তর করতে বাধ্য হয়।

ডাচ-বাংলা ব্যাংক লিমিটেডের উপ-ব্যবস্থাপনা পরিচালক (ডিএমডি) মোহাম্মদ শহীদ উল্লাহ বলেন, যেসব ব্যাংক তাদের মান এবং সুশাসন উন্নত করেছে, সেখানে আমানত বাড়ছে।

তিনি আরো বলেন, ‘ব্যাংক খাতে আস্থা বেড়েছে বলেই আমানতও বাড়ছে।’

প্রিমিয়ার ব্যাংক পিএলসি’র উপ-ব্যবস্থাপনা পরিচালক আবদুল কাইউম চৌধুরী বলেন, ‘বছরের শেষ দিকে বার্ষিক লক্ষ্য অর্জনের জন্য ব্যাংকগুলোর বিশেষ প্রচারণাও আমানত বৃদ্ধিতে ভূমিকা রেখেছে।’

বাংলাদেশ ব্যাংকের তথ্যানুসারে, ২০২৫ সালের সেপ্টেম্বর শেষে ব্যাংকিং খাতে মোট আমানত দাঁড়িয়েছে ১৯ দশমিক ১৪ লাখ কোটি টাকা, যা গত বছরের একই সময়ে ছিল ১৭ দশমিক ৪১ লাখ কোটি টাকা।

ইসলামী ব্যাংক বাংলাদেশ লিমিটেড (আইবিবিএল), আইএফআইসি ব্যাংক এবং ইউনাইটেড কমার্শিয়াল ব্যাংক (ইউসিবি) এর প্রতি গ্রাহকদের আস্থা ধীরে ধীরে ফিরে আসছে, কারণ সাম্প্রতিক মাসগুলিতে এই ব্যাংকগুলির আমানতের প্রবৃদ্ধি উল্লেখযোগ্য।

সরকার পরিবর্তনের পর বাংলাদেশ ব্যাংক আইবিবিএল, আইএফআইসি ও ইউসিবিসহ কয়েকটি ব্যাংকের বোর্ড বিলুপ্ত করে। এতে আতঙ্কে অনেক আমানতকারী টাকা তুলে নেন, ফলে তারল্য সংকট দেখা দেয়।

তবে, সুশাসন নিয়ে উদ্বেগ থাকলেও এসব ব্যাংক আমানতকারীদের টাকা ফেরত দিতে কোনো সমস্যায় পড়েনি। এক বছরের দুর্বল প্রবৃদ্ধির পর এখন আমানত আবার বাড়ছে।

দেশের সবচেয়ে বড় বেসরকারি ব্যাংক আইবিবিএল গত এক বছরে আমানতে ১৪ দশমিক ৭ শতাংশ প্রবৃদ্ধি অর্জন করেছে। ২০২৫ সালের সেপ্টেম্বর শেষে ব্যাংকটির আমানত দাঁড়িয়েছে ১,৭৯,৫৭৯ কোটি টাকা, যা ২০২৪ সালের সেপ্টেম্বরের ১,৫৬,৫৬৪ কোটি টাকার তুলনায় বেশি।

২০২৪ সালের ৫ আগস্ট চট্টগ্রামভিত্তিক ব্যবসায়ী এস আলম ব্যাংকটির বোর্ডের নিয়ন্ত্রণ হারালে আতঙ্ক ছড়িয়ে পড়ে এবং আমানতকারীরা টাকা তুলে নেন।

রাজনৈতিক পরিবর্তনের পর, যখন তৎকালীন চেয়ারম্যান সালমান এফ রহমানকে অপসারণ করা হয়, তখন আইএফআইসি ব্যাংকও অস্থিরতা এবং অভ্যন্তরীণ বিক্ষোভের মুখোমুখি হয়। ব্যাংকটি ভেঙে পড়তে পারে এমন গুজব ছড়িয়ে পড়ার ফলে অর্থ উত্তোলনের ঝড় ওঠে।

তবে গত এক বছরে আইএফআইসি ব্যাংকের আমানত ৫ হাজার ৭১৪ কোটি টাকা বেড়েছে, প্রবৃদ্ধি ১২ দশমিক ৬ শতাংশ। ২০২৪ সালের সেপ্টেম্বরের ৪৫ হাজার ৪১২ কোটি টাকা থেকে ২০২৫ সালের সেপ্টেম্বর শেষে তা বেড়ে দাঁড়িয়েছে ৫১ হাজার ১২৭ কোটি টাকায়।

সরকার পরিবর্তনের পর ইউসিবিও উল্লেখযোগ্য পরিমাণে অর্থ উত্তোলনের সম্মুখীন হয়েছিল, কিন্তু ব্যাংকটি তখন থেকে পুনরুদ্ধার করেছে, এক বছরের মধ্যে ১১ হাজার কোটি টাকারও বেশি আমানত যোগ করেছে। ২০২৪ সালের সেপ্টেম্বরে আমানতের পরিমাণ ৫৪ হাজার ৪৩৯ কোটি টাকা থেকে বেড়ে ২০২৫ সালের সেপ্টেম্বরে ৬৫ হাজার ৫২৪ কোটি টাকায় দাঁড়িয়েছে।

বাংলাদেশ ব্যাংকের তথ্য অনুযায়ী, ব্যাংকিং ব্যবস্থার বাইরে জনগণের হাতে থাকা নগদের পরিমাণ বছরওয়ারি হিসেবে ৮ হাজার ৮২৯ কোটি টাকা কমেছে। সেপ্টেম্বর ২০২৫ শেষে ব্যাংকের বাইরে থাকা নগদের পরিমাণ দাঁড়িয়েছে ২ লাখ ৭৪ হাজার কোটি টাকা, যা ২০২৪ সালের সেপ্টেম্বরের ২ লাখ ৮৩ হাজার কোটির তুলনায় কম।