বাসস
  ১২ নভেম্বর ২০২৫, ২৩:০৬

মেট্রোরেল যাত্রীদের নিরাপত্তা নিশ্চিতে নিরলস কাজ করছে এমআরটি পুলিশ

ফাইল ছবি

ওবাইদুর রহমান

ঢাকা, ১২ নভেম্বর, ২০২৫ (বাসস): রাজধানীতে মেট্রোরেলে যাতায়াতকারী যাত্রীদের নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে ও বিভিন্ন স্টেশনে সেবা দিতে নিরলসভাবে কাজ করে যাচ্ছে ম্যাস র‌্যাপিড ট্রানজিট (এমআরটি) পুলিশ। 

ঢাকা শহরের দ্রুত ও আধুনিক গণপরিবহনের এক নতুন যুগের প্রতীক মেট্রোরেলে। প্রযুক্তিনির্ভর এই পরিবহন ব্যবস্থার পেছনে এমআরটি পুলিশের ভূমিকা গুরুত্ব বহন করে। 

২০১৯ সালে গৃহীত এক সিদ্ধান্তের আলোকে ২০২৩ সালের ২১ মে তৎকালীন সরকার ২৩১টি পদ অনুমোদন দিয়ে আনুষ্ঠানিকভাবে এমআরটি পুলিশ গঠন করে। তবে এখন ৫৫১ জন জনবল নিয়ে সেবা দিয়ে যাচ্ছে। আধুনিক নগর পরিবহনে নিরাপত্তার নতুন ধারা তৈরি করাই ছিল এ ইউনিটের মূল লক্ষ্য।

এমআরটি পুলিশের নিয়মিত দায়িত্বের মধ্যে রয়েছে স্টেশনে মেটাল ডিটেক্টরের মাধ্যমে যাত্রী ও লাগেজ তল্লাশি, সন্দেহভাজন ব্যক্তিদের শনাক্তকরণ, সিসিটিভি পর্যবেক্ষণ এবং যেকোনো ঘটনার তাৎক্ষণিক প্রতিক্রিয়া। পাশাপাশি ইউনিটটি জরুরি পরিস্থিতিতে দ্রুত সাড়া দিতে সর্বদা প্রস্তুত থাকে। দক্ষ জনবল ও আধুনিক সরঞ্জাম এমআরটি পুলিশকে একটি কার্যকর নিরাপত্তাবলয়ে পরিণত করতে পারে।

এমআরটি পুলিশের ডিআইজি সিদ্দিকী তাঞ্জিলুর রহমান বাংলাদেশ সংবাদ সংস্থা (বাসস)-কে জানান, প্রতিটি বগিতে সিসিটিভি থাকলেও অতিরিক্ত যাত্রী চাপের কারণে সব জায়গা ক্যামেরার আওতায় না আসায় এই সুযোগেই সক্রিয় থাকে চোরচক্র। যাত্রীদের নিরাপত্তায় প্রতিটি স্টেশনে এমআরটি পুলিশ সদস্যরা দায়িত্ব পালন করছে।

তিনি জানান, নারী ও শিশু যাত্রীদের সুরক্ষায় এমআরটি পুলিশ বিশেষ গুরুত্ব দিচ্ছে। প্রতিটি স্টেশনে নার্স, প্রাথমিক চিকিৎসা কেন্দ্র ও অ্যাম্বুলেন্স থাকা জরুরি। বিশেষ করে প্রত্যেক স্টেশনে মায়েদের জন্য আলাদা ব্রেস্ট-ফিডিং বুথ থাকা উচিত। এতে নারী যাত্রীরা স্বাচ্ছন্দ্যে যাতায়াত করতে পারবেন, যা কর্মক্ষেত্রে অংশগ্রহণ বাড়াতে সহায়ক হবে।

মেট্রোরেল প্রকল্পে শুধু অবকাঠামো নয়, বরং একটি পূর্ণাঙ্গ সমন্বিত নিরাপত্তা ব্যবস্থার প্রয়োজনীয়তা শুরু থেকেই অনুভূত হয়। এজন্যই নিরাপত্তার সঙ্গে প্রযুক্তিকে সমন্বিত করা হয়েছে। আধুনিক সিসিটিভি নজরদারি, কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা (এআই) নির্ভর পর্যবেক্ষণ ব্যবস্থা, ফেসিয়াল রিকগনিশন প্রযুক্তি এবং বায়োমেট্রিক সিকিউরিটি সিস্টেম এসবের মাধ্যমে নিরাপত্তা ব্যবস্থা কার্যকর ও গতিশীল করার প্রয়োজনীয়তা থাকলেও তা সম্ভব হয়ে ওঠেনি।

সেন্ট্রালাইজড কন্ট্রোল রুম থেকে ওয়্যালেস ও মোবাইল কানেক্টের মাধ্যমে প্রতিটি ট্রেন, স্টেশন এবং প্ল্যাটফর্মে ঘটনার তাৎক্ষণিক মনিটরিং সম্ভব হচ্ছে। প্রযুক্তি ও নিরাপত্তার এই সমন্বয় মেট্রোরেলকে করেছে আরও নির্ভরযোগ্য ও যাত্রীবান্ধব।

বর্তমানে প্রতিদিন প্রায় পৌনে ৪ লাখ যাত্রী মেট্রোরেলে যাতায়াত করছেন। যাত্রীচাপ ও কৌশলগত গুরুত্ব বিবেচনায় সরকার মেট্রোরেলকে ১ (ক) শ্রেণির কেপিআই ঘোষণা করেছে। অর্থাৎ, এটি এখন জাতীয় নিরাপত্তার অগ্রাধিকারপ্রাপ্ত স্থাপনাগুলোর একটি। ফলে মেট্রোরেল কেবল একটি পরিবহন ব্যবস্থা নয় বরং এটি একটি কৌশলগত জাতীয় সম্পদে পরিণত হয়েছে। ফলে এর নিরাপত্তা এখন রাষ্ট্রীয় দায়িত্বের অংশ হিসেবে বিবেচিত।

ঢাকা শহরের মতো জনবহুল শহরে মেট্রোরেলে যাত্রীর চাপ সবসময়ই অত্যধিক থাকে। নাশকতা ও অগ্নিকাণ্ড যেকোনো ঘটনা যেমন বিপুল যাত্রীর দুর্ভোগ তৈরি করতে পারে, তেমনি দেশের ভাবমূর্তিতেও নেতিবাচক প্রভাব ফেলতে পারে।

গত বছর কয়েকটি ঘটনা যেমন- স্টেশনে আগুন লাগা, গেট সিস্টেমে বিভ্রাট, কিংবা বৈদ্যুতিক লাইনে ঘুড়ি আটকে পড়া— এই ঝুঁকির বাস্তব ইঙ্গিত দিয়েছে। কিন্তু এমআরটি পুলিশের তড়িত প্রচেষ্টায় তা সমাধান হয়ে যায়।

এমআরটি পুলিশ জানিয়েছে, ২০২৩ সাল থেকে চলতি বছরের অক্টোবর পর্যন্ত এমআরটি পুলিশ নিরাপত্তা কার্যক্রমে চমকপ্রদ সাফল্য দেখিয়েছে। এই সময়ে তারা স্টেশন এলাকা থেকে হারিয়ে যাওয়া ৩৩৮ জন শিশুকে উদ্ধার করে যথাযথ প্রক্রিয়ায় পরিবারের কাছে হস্তান্তর করেছে।

একই সময়ে ১৯২ জন বৃদ্ধ ও নারী যাত্রীকেও উদ্ধার করা হয়েছে, যারা ভিড় বা বিভ্রান্তির কারণে পরিবারের থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়েছিলেন। যাত্রীদের হারানো ৮৪৭টি মোবাইল, মানিব্যাগ ও অন্যান্য মূল্যবান সামগ্রী উদ্ধার করে মালিকদের ফেরত দিয়েছে এমআরটি পুলিশ।

এছাড়া নিয়মিত টহল ও তল্লাশির সময় ১ কেজি ৩০০ গ্রাম গাঁজা ও ৭ বোতল বিদেশি মদ জব্দ করা হয়েছে, যা অবৈধভাবে বহন করা হচ্ছিল বলে নিশ্চিত করেছে পুলিশ।

সম্প্রতি ট্রেনের ভেতরে পকেটমারি ও চুরির ঘটনা রোধে একটি বিশেষ টিম গঠন করা হয়েছে। 

সিদ্দিকী তাঞ্জিলুর রহমান বলেন, পর্যাপ্ত জনবল পেলে প্রতিটি বগিতে পুলিশ মোতায়েন করা সম্ভব হবে। তখন মেট্রোরেল যাত্রীরা শতভাগ নিরাপত্তা পাবে। বর্তমানে এমআরটি পুলিশের যাতায়াতের জন্য একটি বাস, একটি ট্রাক, একটি মাইক্রোবাস ও সীমিতসংখ্যক মোটরসাইকেল রয়েছে। মেট্রোরেলের পূর্ণাঙ্গ নিরাপত্তা নিশ্চিতে প্রায় ১ হাজার ৯০০ জনবল প্রয়োজন।

তিনি আরও বলেন, আমাদের লক্ষ্য মেট্রোরেলকে এমন এক নিরাপদ, শৃঙ্খল ও আধুনিক গণপরিবহনে পরিণত করা, যেখানে প্রতিটি যাত্রী নিশ্চিন্তে যাতায়াত করতে পারে।

ঢাকা শহরের ছয়টি মেট্রোলাইনের (৫টি লাইনের কাজ চলমান) মাধ্যমে একটি সমন্বিত, পরিবেশবান্ধব ও সময় সাশ্রয়ী পরিবহন ব্যবস্থা গড়ে তোলা কাজ চলছে, যা শহরের বিভিন্ন প্রান্তকে যুক্ত করবে একটি সুষম নেটওয়ার্কে।

তিনি বলেন, ‘এমআরটি পুলিশের সদস্যদের মেট্রোরেল রক্ষণাবেক্ষণ বা পরিচালনাসংক্রান্ত কোনো বিশেষ প্রশিক্ষণ এখনো দেওয়া হয়নি। তারা মূলত প্রচলিত পুলিশি প্রশিক্ষণের অভিজ্ঞতা নিয়েই মেট্রোরেলে দায়িত্ব পালন করছেন। এই সাধারণ প্রশিক্ষণ দিয়ে উচ্চপ্রযুক্তিনির্ভর মেট্রো সিস্টেমে পুরোপুরি মানসম্মত সেবা দেয়া সম্ভব হচ্ছে না।’

তিনি আরও বলেন, উন্নত দেশগুলোর মেট্রো ব্যবস্থাপনার সঙ্গে যৌথ উদ্যোগ বা প্রশিক্ষণ বিনিময় কর্মসূচি চালু করা হলে এমআরটি পুলিশ আরও দক্ষ হয়ে উঠবে। এতে যাত্রীদের প্রতি সেবা, নিরাপত্তা এবং প্রযুক্তিগত ত্রুটি মোকাবিলায় তাদের সক্ষমতা বহুগুণ বৃদ্ধি পাবে।