শিরোনাম
মোফাজ্জেল হোসাইন
বরিশাল, ২৩ অক্টোবর, ২০২৫ (বাসস) : রূপসী বাংলার কবি জীবনানন্দ দাশের স্মৃতি বিজড়িত বাসভবনটি আজও কালের সাক্ষী হয়ে জেগে আছে অনাদরে, অবহেলায়। তাঁর সকল চিহ্ন তাঁরই মতো যেন বিষাদাক্রান্ত।
বরিশালের লেখক কবি ও সংস্কৃতজনদের দাবি ছিল বাড়িটিকে সংস্কৃতি বিষয়ক মন্ত্রণালয়ের অধীনে নিয়ে প্রত্নতত্ত্ব অধিদপ্তরের মাধ্যমে সংরক্ষণের। আন্দোলন হয়েছে, মানববন্ধন হয়েছে, সভা-সমাবেশও হয়েছে। অবশেষে কবির নামে প্রতিষ্ঠিত হয় ‘জীবনানন্দ দাশ পাঠাগার ও মিলনায়তন’। কিন্তু পাঠাগারের দুয়ার আজ বন্ধ। বইয়ের তাকে ধুলো জমে আছে। আলো-বাতাসহীন ঘরে নিস্তব্ধতা।
গতকাল ২২ অক্টোবর ছিল কবি জীবনানন্দ দাশের ৭১তম প্রয়াণ দিবস। এ দিবস উপলক্ষে কথা হয় বরিশাল জেলা শহরের কবি, শিল্পী, সাহিত্যিক, সংগঠক ও গবেষকদের সাথে। তাদের সবার দাবি বিংশ শতাব্দীর অন্যতম প্রধান আধুনিক বাঙালি কবি জীবনানন্দ দাশের বসতবাড়িটি সংরক্ষণের পাশাপাশি এর সংস্কার করা হোক। এই বাড়িকে ঘিরে গড়ে উঠুক সংস্কৃতিজনদের মিলনকেন্দ্র।
বরিশালের প্রগতি লেখক সংঘের কেন্দ্রীয় কমিটির নির্বাহী সদস্য অপূর্ব গৌতম বাসসকে বলেন, ‘অনেক আন্দোলনের ফলে জীবনানন্দ পাঠাগার প্রতিষ্ঠিত হলেও, সেই পাঠাগার আজ তালাবদ্ধ! ধুলো জমে আছে বইয়ের তাকগুলোয়, মিলনায়তনের মঞ্চে নীরবতা। আলো-ফ্যান বন্ধ, বাতাসে স্যাঁতসেঁতে গন্ধ। যেন কেউ নেই, কিছুই নেই!’
তবে কবি আছেন কবিতার প্রাণে। বরিশাল সরকারি বিএম কলেজের বাংলা বিভাগের শিক্ষার্থী নুশরাত বলেন, ‘কবি নেই কিন্তু তাঁর রেখে যাওয়া কবিতা, প্রবন্ধ আজও আমাদের ফিরিয়ে নিয়ে যায় ওই সময়ে। তিনি বেঁচে থাকবেন রূপসী বাংলার কবি হয়ে প্রত্যেক প্রাণে।’
বরিশালের বগুড়া রোডের সেই ঠিকানায় জীবনানন্দের পদচিহ্ন খুঁজতে গেলে দেখা মেলে সরকারি গুদাম, নলকূপ আর ইটের দালান। কবির স্বপ্নের বাড়ি, তাঁর নির্জন বারান্দা, সেই সবুজ সমাধিক্ষেত্র, সবই এখন ইতিহাসের পাতায় বন্দি। তবুও, বাতাসে যেন ভেসে আসে কবির সেই চিরচেনা উচ্চারণ,‘আবার আসিব ফিরে ধানসিঁড়িটির তীরে, এই বাংলায়...।’
কবির স্মৃতি বিজড়িত বাড়িটি এখন তালাবদ্ধ পাঠাগার। এর প্রধান দরজায় কবির একটি প্রতিকৃতি টানানো। এই প্রতিকৃতিতেই ফুল দিয়ে প্রয়াণ দিবসের শ্রদ্ধা নিবেদন করলেন বরিশালের কবি ও সংস্কৃতিকর্মীরা। আয়োজন করা হলো আলোচনা সভা ও সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানের। আয়োজকদের দাবি কবির বাসভবনটি সংস্কার করা হোক। এখানেই গড়ে উঠুক বরিশালের সাহিত্য ও সংস্কৃতিকর্মীদের মিলনকেন্দ্র। এখান থেকেই কবির অনুভব ছড়িয়ে পড়বে দিকদিগন্তে।
জীবনানন্দের প্রতিকৃতিতে শ্রদ্ধা জানাতে আসা কবি আসমা চৌধুরী বাসসকে বলেন, ‘দেশ-বিদেশ থেকে অনেক কবি-সাহিত্যিক আসেন বরিশালে। সবাই জীবনানন্দের বাড়ি দেখতে চান। কিন্তু আমরা কিছুই দেখাতে পারি না। পাঠাগার বন্ধ, মিলনায়তন ধুলোয় ঢাকা। এটি আমাদের জন্য লজ্জার বিষয়। কবির নামে যা করা হয়েছে, তা কেবল কাগজে-কলমে। বাস্তবে সেটি প্রায় পরিত্যক্ত।’
জীবনানন্দ গবেষকদের সাথে কথা বলে জানা যায়, ১৯৪৬ সালে কলকাতা যাওয়ার আগ পর্যন্ত তাঁর স্থায়ী ঠিকানা ছিল বরিশাল নগরীর বগুড়া রোডের এই ‘সর্বানন্দ ভবন’। এটাই তাঁর স্বপ্নের বাড়ি। বগুড়া সড়ক ধরে শীতলাখোলা পেরিয়ে ব্রজমোহন কলেজ পর্যন্ত যে পথ, সেই সড়ক ধরেই ছিল সর্বানন্দ ভবন জীবনানন্দের পৈতৃক নিবাস। নামটি এসেছে তাঁর ঠাকুরদা সর্বানন্দ দাশের নামানুসারে। তিনি ছিলেন বরিশাল কালেক্টরেটের কর্মচারী।
পরবর্তীতে বগুড়া সড়কের নাম পরিবর্তন করে ‘জীবনানন্দ সড়ক’ রাখা হলেও মানুষের মুখে মুখে আজও ‘বগুড়া রোড’ নামেই পরিচিত।
জীবনানন্দ গবেষক কবি হেনরি স্বপন জানান, দাশ পরিবার বরিশালে এই বাড়ি কেনার আগে তাঁরা ভাড়া থাকতেন সেখানে। অশ্বিনী দত্তের বাড়ির উল্টোদিকে এই বাড়ি। সেখানে ১৮৯৯ সালের ১৭ ফেব্রুয়ারি কবির জন্ম, যার চিহ্ন এখন নগরায়ণে বিলীন। হেনরী স্বপন বলেন, গাছগাছালিতে ঢাকা, ফলদ বৃক্ষের সমাহারের সেই ‘সর্বানন্দ ভবন’ ছিল প্রাণচঞ্চল এক একান্নবর্তী বাড়ি। বাড়ির পেছনের মাঝারি পুকুর ঘিরে নারকেল, সুপারি, আম, কাঁঠাল, জাম, আনারসের বাগান। আজ সেই বাড়ি নেই। ‘সর্বানন্দ ভবন’ এখন তিন ভাগে বিভক্ত। বাম পাশে জনস্বাস্থ্য প্রকৌশল অধিদপ্তরের গভীর নলকূপ, ডান দিকে সেই দপ্তরের গুদাম ও কলোনি, মাঝখানে আবাসিক ভবন। আর যেখানে মূল বাড়িটি ছিল, সেখানে এখন দাঁড়িয়ে আছে একটি বাড়ি, নাম তার ‘ধানসিঁড়ি’। কবির কবিতায় বহুল ব্যবহৃত শব্দ ‘ধানসিঁড়ি’ থেকে অনেকে ভাবেন এটাই ছিল কবির বাড়ি। বাড়ির একাংশে একসময় ছিল দাশ পরিবারের ছোট্ট সমাধিক্ষেত্র, লম্বা কংক্রিটের বেদির ওপর স্মৃতির মঠ। চারপাশে ফুলের বাগান। কবি জীবদ্দশায় এখানেই কাটাতেন, নিভৃত নির্জনে। সমাধিক্ষেত্রের পেছনে ছিল তাঁর ঘর। আড়াই বা তিন ফুট উঁচু দেয়ালের ওপর মুলিবাঁশের বেড়া, তার ওপর গোলপাতার ছাউনি। ছোট্ট সেই ঘরে ছিল শোবার ঘর, গোসলখানা, আর সামনে দুদিকের বারান্দা। বড় বারান্দাতেই কবির হাঁটাচলা, ভাবনার সময় কাটত নিঃশব্দে।
চারুকলা বরিশালের সংগঠক আইনজীবী সুভাষ চন্দ্র দাস বাসসকে বলেন, ১৯৪৬ সালের জুলাইয়ে বিএম কলেজ থেকে ছুটি নিয়ে জীবনানন্দ কলকাতা যান, এর পর আর দেশে ফেরেননি। দেশভাগের পর দাশ পরিবারও চলে যায় কলকাতায়। এরপর ১৯৫৫ সালে কলকাতায় সম্পন্ন হয় ‘পাওয়ার অব অ্যাটর্নি’ দলিল। যেখানে কবির নাম থাকলেও তাঁর স্বাক্ষর নেই। কারণ তখন তিনি মৃত। সেই দলিলের মাধ্যমেই ১৯৬৯ সালে বরিশাল কালেকটরেটের কর্মচারী আব্দুর রাজ্জাক মূল বাড়িটি কেনেন। আব্দুর রাজ্জাকের কন্যা মহিলা পরিষদ নেত্রী নুরজাহান বেগমের স্মৃতি থেকে জানা যায়, বাড়িটি কেনার পর তারাই এ বাড়ির নাম দেন ‘ধানসিঁড়ি’। ১৯৫৮-৫৯ সালে জমিটা হুকুম দখল হয়। পরে এখানে জনস্বাস্থ্য প্রকৌশল দপ্তর কলোনি, গুদাম আর পানির পাম্প বসায়।’
কবি জীবনানন্দ দাশের বাসভবন সংরক্ষণের ব্যাপারে সরকারি উদ্যোগের বিষয়ে জানতে চাইলে বরিশালের জেলা প্রশাসক আহসান হাবিব বলেন, ‘কবি জীবনানন্দ দাশের স্মৃতি বিজড়িত বাড়িটি সংস্কারের জন্য ইতোমধ্যে বরিশাল বিভাগীয় কমিশনার উদ্যোগ নিয়েছেন। আমরা বাড়িটি সংস্কার ও সংরক্ষণের জন্য কাজ করছি। এটির সার্বিক সুরক্ষা নিশ্চিত করা হবে।’