শিরোনাম
ঢাকা, ১৪ অক্টোবর, ২০২৫ (বাসস) : বহুল আকাঙ্ক্ষিত 'জুলাই জাতীয় সনদ, ২০২৫' রাজনৈতিক দলগুলোর কাছে পৌঁছে দেয়া হয়েছে। আজ জাতীয় ঐকমত্য কমিশন থেকে একথা জানানো হয়েছে। সেইসঙ্গে প্রকাশিত হয়েছে জুলাই জাতীয় সনদ।
প্রায় ৪০ পৃষ্ঠার এই জাতীয় সনদে সন্নিবেশিত হয়েছে বাংলাদেশের রাজনৈতিক পটভূমি। ব্রিটিশ ঔপনিবেশিক শাসনের থেকে শুরু করে ১৯৫২ সালের ভাষা আন্দোলন, ১৯৬২ সালের শিক্ষা আন্দোলন, ১৯৬৬ সালের স্বায়ত্তশাসনের আন্দোলন এবং ১৯৬৯ সালের গণঅভ্যুত্থানের কথা সেখানে উল্লেখ করা হয়েছে।
সেইসঙ্গে ১৯৭০ সালের নির্বাচন, ১৯৭১ সালের রক্তক্ষয়ী মহান মুক্তিযুদ্ধ ও ১৯৭৫ সালে সংবিধান সংশোধনের মাধ্যমে একদলীয় বাকশাল কায়েমের কথাও এতে উল্লেখ করা হয়েছে।
এতে বলা হয়েছে, "নানামুখী রাজনৈতিক ঘটনাপ্রবাহের ধারাবাহিকতায় ১৯৭৮ সালে বহুদলীয় রাজনৈতিক ব্যবস্থা পুনঃপ্রবর্তনের উদ্যোগের ফলে ১৯৭৯ সালে অনুষ্ঠিত জাতীয় সংসদ নির্বাচনের মধ্য দিয়ে দেশ আবারও গণতন্ত্রে প্রত্যাবর্তন করে। কিন্তু সেই গণতান্ত্রিক অভিযাত্রা দীর্ঘস্থায়ী হয়নি।"
বিশেষত, ২০০৯ সাল থেকে ২০২৪ সাল পর্যন্ত সমগ্র রাষ্ট্রযন্ত্রকে স্বৈরতান্ত্রিকভাবে বিশেষ ব্যক্তি, পরিবার ও গোষ্ঠী বন্দনার জন্য নিবেদিত রাখা হয় উল্লেখ করে এতে আরো বলা হয়েছে, "২০১৪, ২০১৮ ও ২০২৪ সালে পরপর তিনটি বিতর্কিত ও প্রহসনমূলক নির্বাচন অনুষ্ঠান করে নির্বাচনি ব্যবস্থাকে ধ্বংস এবং বিচার বিভাগ, আইন প্রয়োগকারী সংস্থা ও জনপ্রশাসনকে দলীয়করণ এবং দুর্নীতির মাধ্যমে রাষ্ট্রীয় সম্পদ লুণ্ঠনের ব্যবস্থা কায়েম করে।"
কিভাবে দীর্ঘ ১৬ বছরের ধারাবাহিক গণতান্ত্রিক আন্দোলন-সংগ্রাম এবং ২০১৮ সালে শিক্ষার্থীদের নেতৃত্বে সরকারি চাকরিতে কোটা ও বৈষম্যের বিরুদ্ধে আন্দোলন, নিরাপদ সড়ক আন্দোলন এবং অবশেষে ২০২৪ সালের জুলাই-আগস্টের এক দফা আন্দোলনে বিপুল সংখ্যক ছাত্র-শ্রমিক-নারী-পেশাজীবী তথা ফ্যাসিস্ট বিরোধী রাজনৈতিক দল এবং সকল স্তরের জনতার অংশগ্রহণের ফলে এক অভূতপূর্ব গণঅভ্যুত্থান সংঘটিত হয় তারও উল্লেখ রয়েছে।
জুলাই জাতীয় সনদে রাষ্ট্র পরিচালনার মূলনীতি, আইনসভা, নির্বাচন ব্যবস্থা, বিচার বিভাগ, নির্বাচন কমিশন, দুর্নীতি দমন কমিশন, সাংবিধানিক প্রতিষ্ঠানের নিয়োগ, স্থানীয় সরকার প্রতিষ্ঠান ইত্যাদি বিভিন্ন বিষয়ে জনসাধারণ, বিশেষজ্ঞ ও রাজনৈতিক দলের মতামত পর্যালোচনা করে জাতীয় জুলাই সনদের ভাষ্য এবং সে বিষয়ে রাজনৈতিক দল ও জোট গুলোর মতামত সন্নিবেশিত হয়েছে।
সবশেষে 'জুলাই জাতীয় সনদ, ২০২৫' বাস্তবায়নের সাতটি পয়েন্টসহ একটি অঙ্গীকারনামা এতে লিপিবদ্ধ হয়েছে।
গণতান্ত্রিক মূল্যবোধ এবং জাতীয় ঐকমত্যের ভিত্তিতে ২০২৪ সালের জুলাই গণঅভ্যুত্থানে প্রকাশিত জনগণের ইচ্ছাকে প্রাধান্য দিয়ে রাজনৈতিক দলগুলোর প্রতিনিধিরা এতে স্বাক্ষর করবেন বলে অঙ্গীকারনামায় উল্লেখ করা হয়েছে।
অঙ্গীকারনামায় ২০২৪ সালের জুলাই-আগস্টের গণঅভ্যুত্থানে হাজারো মানুষের জীবন ও রক্তদান এবং অগণিত মানুষের সীমাহীন ক্ষয়ক্ষতি ও ত্যাগ-তিতিক্ষার বিনিময়ে অর্জিত সুযোগের ফলে নতুন রাজনৈতিক সমঝোতার দলিল হিসেবে 'জুলাই জাতীয় সনদ,২০২৫'-এর পরিপূর্ণ বাস্তবায়ন নিশ্চিত করা ও এই সনদ পূর্ণাঙ্গভাবে সংবিধানে তফসিল হিসেবে বা যথোপযুক্তভাবে সংযুক্ত করার কথা উল্লেখ করা হয়েছে।
এতে বলা হয়েছে যে স্বাক্ষরকারীরা এই সনদের বৈধতা ও প্রয়োজনীয়তা সম্পর্কে কোনো আদালতে প্রশ্ন উত্থাপন না করে এর বাস্তবায়নের প্রতিটি ধাপে আইনি ও সাংবিধানিক সুরক্ষা নিশ্চিত করবেন ও গণতন্ত্র ,মানবাধিকার ও আইনের শাসন প্রতিষ্ঠায় মানুষের সংগ্রাম, বিশেষত ২০২৪ সালের গণঅভ্যুত্থানের ঐতিহাসিক তাৎপর্যকে সাংবিধানিক তথা রাষ্ট্রীয় স্বীকৃতি প্রদান করবেন।
অঙ্গীকারনামায় স্বাক্ষরকারীরা গণঅভ্যুত্থানপূর্ব ১৬ বছরের ফ্যাসিবাদ বিরোধী গণতান্ত্রিক সংগ্রামে গুম, খুন ও নির্যাতনের শিকার হওয়া ব্যক্তিদের এবং ২০২৪ সালের জুলাই-আগস্টের গণঅভ্যুত্থানকালে সংঘটিত সকল হত্যাকান্ডের বিচার, শহীদদের রাষ্ট্রীয় মর্যাদা প্রদান ও শহীদ পরিবারগুলোকে যথোপযুক্ত সহায়তা প্রদান এবং আহতদের সুচিকিৎসা ও পুনর্বাসনের ব্যবস্থা নিশ্চিত করবেন বলে উল্লেখ করা হয়েছে।
সেইসঙ্গে বাংলাদেশের সামগ্রিক রাষ্ট্র ব্যবস্থা সংস্কারের বিষয়ে যেসব সিদ্ধান্ত লিপিবদ্ধ রয়েছে সেগুলো বাস্তবায়নের জন্য সংবিধান এবং বিদ্যমান আইনসমূহের প্রয়োজনীয় সংশোধন, সংযোজন, পরিমার্জন বা নতুন আইন প্রণয়ন, প্রয়োজনীয় বিধি প্রণয়ন বা বিদ্যমান বিধি ও প্রবিধির পরিবর্তন বা সংশোধন এবং এ বিষয়ে ঐকমত্যের ভিত্তিতে গৃহীত যে সকল সিদ্ধান্ত অবিলম্বে বাস্তবায়নযোগ্য সেগুলো কোনো প্রকার কালক্ষেপণ না করেই দ্রুততম সময়ে অন্তর্বর্তীকালীন সরকার ও অন্যান্য সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষ সম্পূর্ণরূপে বাস্তবায়ন করবে বলে সনদে অন্তর্ভুক্ত হয়েছে।
চলতি বছরের ফেব্রুয়ারি মাসে জাতীয় ঐক্যমত্য কমিশন গঠন করে প্রজ্ঞাপন জারি করে সরকার। কমিশন ১৫ ফেব্রুয়ারি থেকে কাজ শুরু করে।
তিন ধাপে রাজনৈতিক দল ও বিশেষজ্ঞদের সঙ্গে আলোচনা শেষে অবশেষে স্বাক্ষরিত হয়ে আগামী ১৭ অক্টোবর চূড়ান্ত হতে যাচ্ছে 'জুলাই জাতীয় সনদ, ২০২৫'।
এর আগে গত ১৬ আগস্ট রাতে রাজনৈতিক দলগুলোর কাছে পাঠানো পূর্ববর্তী খসড়ায় কিছু ত্রুটি থাকায়, তা সংশোধন করে নির্ভুল খসড়া প্রেরণ করা হয়।
সর্বশেষ গত বুধবার (২০ আগষ্ট) কমিশনের পক্ষ থেকে খসড়াটির ওপর নিজেদের যেকোনো ধরনের মতামত প্রদানের সময় ২২ আগস্ট বিকেল তিনটা পর্যন্ত বাড়ানো হয়।
সকলের মতামত পর্যালোচনা করে নির্ভুল আকারে জুলাই সনদ লিখিত আকারে চূড়ান্ত করে আজ রাজনৈতিক দলগুলোর কাছে পাঠানো হয়।