শিরোনাম
টোকিও, ২৯ মে, ২০২৫ (বাসস): প্রধান উপদেষ্টা প্রফেসর মুহাম্মদ ইউনূস বলেছেন, বিশ্ব বর্তমানে চরম অনিশ্চয়তার মধ্য দিয়ে যাচ্ছে। এ পরিস্থিতিতে বৈশ্বিক আস্থা হুমকির মুখে।
তিনি আজ টোকিওর ইম্পেরিয়াল হোটেলে অনুষ্ঠিত ৩০তম নিক্কেই ফোরাম ‘ফিউচার অব এশিয়া’র উদ্বোধনী অধিবেশনের মূল বক্তব্যে এ কথা বলেন।
অধ্যাপক ইউনূস বলেন, ‘বৈশ্বিক আস্থা এখন হুমকির মুখে। জাতির মধ্যে, সমাজের অভ্যন্তরে, এমনকি নাগরিক ও প্রতিষ্ঠানের মধ্যেও আস্থা হ্রাস পাচ্ছে।’
‘উত্তাল বিশ্বে এশিয়ার চ্যালেঞ্জ’ শীর্ষক বক্তব্যে তিনি আরও বলেন, বিশ্ব ক্রমেই অস্থির হয়ে উঠছে।
ইউনূস বলেন,‘আমরা এক গভীর অনিশ্চিত সময় পার করছি। আমরা এমন একটি বিশ্বকে প্রত্যক্ষ করছি যেখানে শান্তি বিনষ্ট হচ্ছে, উত্তেজনা বাড়ছে এবং পারস্পরিক সহযোগিতা সবসময় নিশ্চিত থাকছে না।’
অধ্যাপক ইউনূস উল্লেখ করেন, এশিয়া ও তার বাইরের বিভিন্ন অঞ্চলে সংঘর্ষ শুরু হয়েছে এবং শান্তি দিন দিন অধরা হয়ে উঠছে।
‘ইউক্রেন, গাজা এবং দক্ষিণ ও দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার দেশগুলোতে যুদ্ধ ও মানবসৃষ্ট সংঘাত হাজারো মানুষের জীবন ও জীবিকা ধ্বংস করে দিচ্ছে’, বলেন প্রফেসর ইউনূস।
তিনি বলেন, ‘আমাদের প্রতিবেশী দেশ মিয়ানমারে গৃহযুদ্ধ এক নির্মম রূপ নিয়েছে এবং সাম্প্রতিক ভূমিকম্প দেশটির গভীর মানবিক সংকটকে আরও অন্ধকারে ঠেলে দিয়েছে।’
প্রধান উপদেষ্টা বলেন, ‘সম্প্রতি আমাদের দুই প্রতিবেশীর মধ্যে একটি সংক্ষিপ্ত কিন্তু ব্যয়বহুল যুদ্ধ সংঘটিত হয়েছে। অত্যন্ত দুঃখজনক যে আমরা কোটি কোটি টাকা যুদ্ধের পেছনে ব্যয় করছি, অথচ লাখ লাখ মানুষ না খেয়ে বা ন্যূনতম চাহিদার জন্য লড়াই করছে।’
অধ্যাপক ইউনূস যুদ্ধবিরতির জন্য উভয় দেশের নেতাদের ধন্যবাদ জানান এবং দক্ষিণ এশিয়ায় শান্তি, স্থিতিশীলতা ও সহাবস্থানের আশাবাদ ব্যক্ত করেন।
তিনি আরও বলেন, ‘জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে বিশ্বব্যাপী লাখ লাখ মানুষ বাস্তুচ্যুত হচ্ছে, অন্যদিকে প্রযুক্তিগত অগ্রগতি অনেক প্রতিশ্রুতি দিলেও নতুন নতুন নৈতিক প্রশ্ন উত্থাপিত হচ্ছে।’
প্রফেসর ইউনূস বলেন, বাণিজ্যিক বিধিনিষেধ বেড়ে যাওয়ায় মুক্ত বাণিজ্য ব্যবস্থার ভিত্তি চ্যালেঞ্জের মুখে এবং আর্থিক বৈষম্য সমাজে বেড়েই চলেছে।
সাম্প্রতিক সময়ে, বাংলাদেশ ও দক্ষিণ কোরিয়ায় এমন বিভাজনের কারণে অসন্তোষ ও অস্থিরতা দেখা গেছে, যা শাসনব্যবস্থার পরিবর্তন ডেকে এনেছে বলে তিনি উল্লেখ করেন।
বাংলাদেশে শাসনব্যবস্থার সাম্প্রতিক পরিবর্তন প্রসঙ্গে তিনি বলেন, ‘গত বছর শিক্ষার্থীদের নেতৃত্বে গণঅভ্যুত্থানের মাধ্যমে দেশে একটি পরিবর্তন ঘটেছে এবং এরপর তাঁর সরকার দায়িত্ব গ্রহণ করে।’
অধ্যাপক ইউনূস বলেন, ‘আমরা আমাদের জনগণের স্বপ্ন ও আকাঙ্ক্ষা পূরণে, ন্যায়বিচার, সমতা, স্বাধীনতা ও মর্যাদা নিশ্চিত করতে এবং একটি অবাধ, সুষ্ঠু, গ্রহণযোগ্য সাধারণ নির্বাচন আয়োজনের মাধ্যমে গণতন্ত্রে শান্তিপূর্ণ রূপান্তরের লক্ষ্যে কাজ করছি।’
তিনি বলেন, ‘আমরা বিশ্বাস করি, এটি আমাদের ভুলগুলো সংশোধন করার, নতুন প্রতিষ্ঠান গড়ে তোলার এবং একটি ন্যায়ভিত্তিক সমাজ গড়ার সুযোগ।’
বহুমুখী অভ্যন্তরীণ চ্যালেঞ্জ থাকা সত্ত্বেও, প্রফেসর ইউনূস বলেন, বাংলাদেশ বৈশ্বিক শান্তি ও নিরাপত্তায় ভূমিকা রাখছে জাতিসংঘ শান্তিরক্ষা ও শান্তি প্রতিষ্ঠা মিশনে অংশগ্রহণের মাধ্যমে এবং মানবিক কারণে মিয়ানমার থেকে পালিয়ে আসা ১০ লাখ রোহিঙ্গাকে আশ্রয় দিয়ে।
তিনি বলেন, ‘বিশ্বের অর্ধেকেরও বেশি মানুষের আবাসস্থল এশিয়া অনিশ্চয়তার কেন্দ্রস্থলে, একই সঙ্গে সম্ভাবনারও কেন্দ্রে।’
‘আমাদের চ্যালেঞ্জগুলো বিশাল, কিন্তু আমাদের সম্মিলিত শক্তিও বিশাল। এ বাস্তবতায়, আমি বিশ্বাস করি এশিয়ার সামনে একটি সুযোগ, এমনকি একটি দায়িত্ব রয়েছে ভিন্ন পথ দেখানোর: শান্তির, সংলাপের, অন্তর্ভুক্তিমূলক উন্নয়নের। শুধু সংখ্যাগত নয়, মানুষের কল্যাণ, আস্থা ও আশার উন্নয়ন,’ তিনি বলেন।
প্রফেসর ইউনূস বলেন, ‘আমরা এই চ্যালেঞ্জগুলোর মুখে অসহায় নই। বরং, আমরা ইতিহাসের একটি সন্ধিক্ষণে আছি। আজকের সিদ্ধান্তগুলো নির্ধারণ করবে আমরা আমাদের সন্তানদের জন্য কেমন পৃথিবী রেখে যাব। তাই আমাদের ঐক্যবদ্ধ হতে হবে, কেবল সমস্যা নিয়ে আলোচনার জন্যে নয়, বরং সমাধান খুঁজে পেতে।’
তিনি বলেন, ‘এই সমাধানগুলো যেন অন্তর্ভুক্তিমূলক, ন্যায্য এবং মানবিকতার ভিত্তিতে গড়ে ওঠে।’
প্রফেসর ইউনূস প্রায়ই উল্লেখ করা নিজের কথা তুলে ধরে বলেন, ‘অর্থ উপার্জন আনন্দের বিষয়। কিন্তু মানুষকে সুখী করা, সেটিই প্রকৃত আনন্দ।’
তিনি বলেন,‘আমাদের মনোযোগ সরাতে হবে, ব্যক্তিগত মুনাফা থেকে সমষ্টিগত কল্যাণে। স্বল্পমেয়াদি অর্জন থেকে দীর্ঘমেয়াদী স্বপ্নের দিকে।’
তিনি বলেন, ‘তাঁর নিজের জীবনের যাত্রায় গ্রামীণ ব্যাংক প্রতিষ্ঠা করা থেকে শুরু করে দরিদ্র নারীদের ক্ষুদ্রঋণ দেওয়া এবং সারা বিশ্বে সামাজিক ব্যবসার ধারণা ছড়িয়ে দেওয়া পর্যন্ত, তিনি একটি বিষয় স্পষ্টভাবে শিখেছেন; মানুষ কষ্ট পাওয়ার জন্য জন্মায়নি।’
‘মানুষ সীমাহীন সম্ভাবনা নিয়ে জন্মায়। আমাদের শুধু তাদের সঠিক সুযোগটি দিতে হবে,’ তিনি বলেন।
‘তিনটি শূন্য’- শূন্য দারিদ্র্য, শূন্য বেকারত্ব, শূন্য নিট কার্বন নিঃসরণ - এই তত্ত্ব উপস্থাপন করে ড. ইউনূস বলেন, এটি কোনো স্বপ্ন নয়, বরং একটি দিকনির্দেশনা।
‘যেখানে একটি লক্ষ্যে সরকার, ব্যবসা, বিশ্ববিদ্যালয় এবং ব্যক্তি একযোগে কাজ করতে পারে,’ তিনি বলেন।
প্রধান উপদেষ্টা বলেন, ‘আমাদের প্রয়োজন এমন একটি নতুন ধরনের অর্থনীতি, যা প্রতিযোগিতার ওপর নয়, সহানুভূতির ভিত্তিতে গড়ে উঠবে। শুধু ভোগের ওপর নয়, অন্যের কল্যাণ হয় এমন অর্থনীতি হবে। এখানেই আমাদের ভবিষ্যৎ।’
নিক্কেই ফোরাম সম্পর্কে তিনি বলেন, ‘ফিউচার অব এশিয়া’ একটি আশাবাদের মঞ্চ।
প্রধান উপদেষ্টা বলেন, ‘নিক্কেই এমন একটি পরিসর তৈরি করেছে যেখানে সংলাপ সমাধানে রূপ নেয়, এবং যেখানে আস্থা কেবল একটি শব্দ নয়, বরং একটি লক্ষ্য—যার দিকে আমরা একসাথে এগিয়ে যাই।’
তিনি বলেন, ‘এশিয়ার ভবিষ্যৎ কেবল অর্থনীতি বা ভূরাজনীতির বিষয় নয়, এটি মানুষের, ভাবনার এবং সাহসের বিষয়।’
ইউনূস বলেন,‘চলুন, আমাদের চারপাশের অস্থিরতা দেখে ভীত না হয়ে এটিকে একটি আহ্বান হিসেবে নিই—নতুন করে ভাবার, পুনর্গঠনের এবং একসাথে জাগরণের আহ্বান।’
প্রধান উপদেষ্টা বলেন, ‘ভয়ের দ্বারা নয়, সম্ভাবনার দ্বারা; শক্তির দ্বারা নয়, উদ্দেশ্যের দ্বারা পরিচালিত হই। চলুন, একটি উত্তম বিশ্বের কল্পনা করতে সাহসী হই। চলুন, একে অপরের প্রতি আস্থা রাখি। চলুন, শুধু প্রয়োজনীয়তার কারণে নয়, বরং আন্তরিক ইচ্ছে থেকে একে অপরকে সহযোগিতা করি।’
তিনি বলেন, ‘এশিয়ার ভবিষ্যৎ এখনো লেখা হয়নি—আমরাই তা একসঙ্গে লিখব।’
প্রফেসর ইউনূস বলেন, ‘বাংলাদেশ ও জাপান একসঙ্গে কাজ করে এশিয়ার ভাগ্য এমনকি বিশ্বের ভাগ্যও পুনর্লিখন করতে পারে।’