শিরোনাম

//শাহজাহান নবীন//
ঝিনাইদহ, ২৬ অক্টোবর, ২০২৫ (বাসস) : খেজুরের রস ও গুড়ের জন্য বিখ্যাত ঐতিহ্যবাহী জনপদ ঝিনাইদহ। আসন্ন শীত সামনে রেখে জেলার গ্রামে গ্রামে চলছে গাছিদের তুমুল প্রস্তুতি। খেজুর গাছের সংখ্যা কমে গেলেও থেমে নেই রস সংগ্রহের চেষ্টা। তবে বছর বছর গাছির সংখ্যাও কমছে। এদিকে খেজুর রস জ্বালানো, গুড় তৈরি ও বাজারজাতকরণের প্রস্তুতিও চলছে পুরোদমে।
সরেজমিন দেখা গেছে, জেলার সদর উপজেলার চোরকোল, গান্না, লক্ষীপুর সহ বিভিন্ন গ্রামে চলছে খেজুর গাছ প্রস্তুতের কাজ। সকাল হলেই ঠুঙ্গি, বাইলধারা, দড়ি, গাছিদা হাতে মাঠের পানে ছুটছেন গাছিরা। ধারালো দা দিয়ে নিপুন হাতে খেজুর গাছের মাথা পরিষ্কার করছেন তারা। খেজুর গাছের মাথা পরিষ্কার করার পরে গাছগুলোকে দুই সপ্তাহের বিশ্রাম দেয়া হয়। সবমিলিয়ে আসছে শীতে, খেজুর রস সংগ্রহ ও গুড় তৈরির মহাযজ্ঞকে ঘিরে কৃষকের চোখে মুখে যেন স্বপ্নের মাখামাখি।
সদর উপজেলার ডেফলবাড়ি গ্রামের গাছি আব্দুর রাজ্জাক বাসস কে বলেন, অন্যান্য বছর কার্তিক মাস শুরু হওয়ার দশ দিন আগে থেকেই খেজুর গাছ প্রস্তুত করার কাজ শুরু করি। কিন্তু এবছর বৃষ্টি বাদলের কারণে খেজুর গাছ তোলার (কাটা) সময় সপ্তাহখানিক পিছিয়ে গেছে। কার্তিক মাসের দ্বিতীয় দশক থেকে রস সংগ্রহ শুরু হবে। প্রথম দিকে উৎপন্ন রস দিয়ে তৈরি করা হবে নলেন গুড়।
জানা গেছে, ঝিনাইদহ অঞ্চল খেজুর রস ও গুড়ের জন্য বিখ্যাত। বৃহত্তর যশোর জেলার মহকুমা ছিল ঝিনাইদহ।
যে কারণে যশোরের খেজুর গুড় ও রসের ঐতিহ্যের ভাগিদার ঝিনাইদহ। প্রতিবছর জেলার ছয়টি উপজেলা থেকে অন্তত ৮’শ থেকে সাড়ে ৮,শ টন খেজুর গুড় উৎপাদন করা হয়। প্রাকৃতিক ও নিরাপদ উপায়ে গ্রামের গাছিরা এসব গুড় তৈরি করেন। খেজুরের কাঁচা রসেরও জনপ্রিয়তাও ব্যাপক। সারাদেশেই খেজুর গুড়, রস ও পাটালির ব্যাপক চাহিদা রয়েছে। ঝিনাইদহ অঞ্চল থেকে এসব রস, গুড় ও পাটালি সারাদেশে সরবরাহ করা হয়।
জেলা কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের প্রস্তুতকৃত হালনাগাদ তথ্য বলছে, বর্তমানে জেলায় প্রায় ১ লাখ ৪২ হাজার ২৩৫টি খেজুর গাছ রয়েছে। এরমধ্যে রস আহরণযোগ্য গাছের পরিমাণ প্রায় ১ লাখ ১২ হাজার ৭৬০টি। এছাড়া বাকি গাছগুলোর মধ্যে কিছু চারা গাছ। আবার কিছু গাছ থেকে গাছিরা রস সংগ্রহ করেন না। শীত মৌসুমে জেলায় প্রায় ৪৮ লাখ ১৪ হাজার ২৪১ লিটার খেজুর রস ও প্রায় ৮৭২ মেট্রিন টন খেজুর গুড় উৎপাদন হয়। যা স্থানীয় চাহিদা মিটিয়ে দেশের বিভিন্ন জেলায় সরবরাহ করা হয়।
জেলার কোটচাঁদপুর ইউনিয়নের পাঁচলিয়া গ্রামের সমীর মন্ডল নামের গাছি বলেন, এখন গাছ কমে যাচ্ছে। যা দু চারটে গাছ আছে তা কেউ কাটতে চায় না। আমার বয়স ৬০ এর ওপরে। এখনো গাছ কেটে রস বানাই। খেজুরের রস ও গুড় আমাদের কাছে ঐতিহ্যের বিষয়। এটা হারিয়ে গেলে তো গ্রামের সৌন্দর্য থাকে না। তাই, এখনো শীত এলে খেজুর গাছ কাটি। জেলায় এই ঐতিহ্য টিকিয়ে রাখতে নতুন করে খেজুর রোপণের বিকল্প নেই।
সদর উপজেলার কুমড়াবাড়িয়া গ্রামের গৃহবধূ নবীরণ নেসা বলেন, আর ১০ দিন পর থেকে বাড়িতে খেজুর রস আসবে। রস জ্বালানোর বাইন (বড় চুলা) তৈরি করেছি। খড়ি-কাঠি গুছিয়ে রেখেছি। বাড়ির পুরুষ মানুষেরা রস মাঠ থেকে এনে দেয়, আমরা বাড়িতে বসে জ্বাল করি। নারী-পুরুষ সবাই গুড় ও পাটালি তৈরির কাজ করি। এতে বছরে বাড়তি কিছু টাকা রোজগার হয়। শীতকালে পিঠা-পায়েস খেতেও তো গুড় লাগে । আমরা নিজেরা খেজুর গুড় দিয়ে পিঠাপুলি, পায়েস, ক্ষীর, মিষ্টি সবকিছু করি। শহর থেকে মানুষ এসে গুড় কিনে নিয়ে যায়।
জেলা কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের উপপরিচালক মো. কামরুজ্জামান বাসস কে বলেন, আমরা গাছিদের তালিকা তৈরির উদ্যোগ নিয়েছি। নিরাপদ উপায়ে খেজুর রস সংগ্রহ, গুড় উৎপাদন ও বাজারজাতকরণের বিষয়ে গাছিদের প্রশিক্ষণ দেয়ার পরিকল্পনা রয়েছে। এই জেলা খেজুর গুড়ের জন্য বিখ্যাত জনপদ। এবছর খেজুর গুড়ের উৎপাদন লক্ষ্যমাত্রা প্রায় ৯’শ মেট্রিক টন। এর মধ্যে জেলার সকল এলাকায় গাছিরা খেজুর গাছ প্রস্তুত করে ফেলেছেন।
আগামী সপ্তাহ থেকে রস সংগ্রহ শুরু হয়ে যেতে পারে। আমরা গাছি ও কৃষকদের সার্বিক খোঁজখবর রাখছি।