শিরোনাম
/বাবুল আখতার রানা/
নওগাঁ, ৯ সেপ্টেম্বর, ২০২৫ (বাসস) : আদিবাসীদের সবচেয়ে বড় ধর্মীয় উৎসব হলো কারাম পূজা। বংশ পরমপরায় ক্ষুদ্র-নৃগোষ্ঠীরা পূর্ণিমা তিথিতে কারাম পূজা পালন করে থাকে। পূজা-অর্চনা আর নাচ-গানের মধ্য দিয়ে যুগ যুগ ধরে প্রতি বছর উত্তরের সমতল ভূমি নওগাঁয় আদিবাসীরা এই কারাম উৎসব পালন করে আসছে।
এ বছর উৎসবের দিন সোমবার বিকেলে পায়ে আলতা, খোঁপায় বাহারি ফুল, শাড়ি আর ঢোল মাদলের তালে তালে রিমঝিম নাচ ও গানে সমতলের আদিবাসীদের চারপাশ ছিল মুখরিত। ঢোল আর মাদলের তালে নাচে-গানে উদযাপন করা হয় আদিবাসী সম্প্রদায়ের ঐতিহ্যবাহী কারাম উৎসব।
নওগাঁয় আদিবাসীদের ৩০তম ঐতিহ্যবাহী কারাম উৎসবে এদিন আশপাশের জেলা থেকে আসা ২৫টি দল যোগ দিয়ে নিজেদের ভাষা, সংস্কৃতি আর ঐতিহ্য তুলে ধরে। পরে সেখানে আলোচনা সভা অনুষ্ঠিত হয়।
সভায় প্রধান বক্তা ছিলেন জাতীয় আদিবাসী পরিষদ কেন্দ্রীয় কমিটির সাধারণ সম্পাদক বিমল চন্দ্র রাজোয়ার। উদ্বোধন করেন কেন্দ্রীয় কমিটির সভাপতি গণেশ মার্ডী।
জাতীয় আদিবাসী পরিষদ জেলা কমিটির সভাপতি আমিন কুজুরের সভাপতিত্বে সভায় প্রধান অতিথি ছিলেন মহাদেবপুর উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা আরিফুজ্জামান। এ সময় জাতীয় আদিবাসী পরিষদের উপদেষ্টা ও সাংস্কৃতিক ব্যক্তিত্ব আজাদুল ইসলাম, বেসরকারি উন্নয়ন সংস্থা আইএসসির সভাপতি ডি এম আব্দুল বারী ও নির্বাহী পরিচালক আবুল হাসনাতসহ অন্যরা বক্তব্য দেন।
কারাম উৎসবকে আবার ডাল পূজাও বলা হয়ে থাকে। আদিবাসী বিভিন্ন জাতিগোষ্ঠীর মানুষের কাছে কারাম একটি পবিত্র গাছের নাম। এই গাছকে মঙ্গলের প্রতীক বলা হয়ে থাকে। কারাম ডাল মাটিতে পুঁতে বিভিন্ন আদিবাসীদের ঐতিহ্যবাহী নাচ, গান ও কিচ্ছা বলার মধ্য দিয়ে এই পূজা করা হয়। আর এ দিনটির জন্য অধির আগ্রহে থাকেন তারা।
ওই উৎসবে শিশু, কিশোর-কিশোরীসহ বিভিন্ন বয়সী নর-নারী গ্রামের পূজাস্থানে জড়ো হন। সেখানে পুরোহিত নতুন প্রজন্মের কাছে কিচ্ছা আকারে কার্মা ও ধার্মা দুই ভাইয়ের কাহিনি তুলে ধরেন। কিচ্ছা বলা শেষ হলে হলে উপোস থাকা নারীরা পরস্পরকে খাবারের আমন্ত্রণ জানিয়ে উপোস ভাঙেন। পরে বেদিতে পুঁতে রাখা কারাম ডালের চারপাশ ঘুরে ঘুরে ঢাক ঢোল ও মাদলের বাজনার তালে তালে নৃত্য পরিবেশন করেন নারীরা। পূজা পর্ব শেষে সবাই মিলে গীত গাইতে গাইতে কারাম ডালকে পুকুরে বিসর্জন দেন।
সমতলের ক্ষুদ্র জাতিসত্তার প্রধান উৎসব কারাম। ভাদ্র মাসের পূর্ণিমায় এ উৎসবের আয়োজন করে তারা। ক্ষুদ্র জাতিসত্তা অধ্যুষিত গ্রামগুলোতে কারাম বৃক্ষের ডাল নিয়ে এ উৎসবের আয়োজন করা হয়। তাদের বিশ্বাস, এটি অভাবমুক্তি ও সৌভাগ্য লাভের উৎসব।
ধর্মীয় বিভিন্ন আচার-অনুষ্ঠান পালনের মাধ্যমে সৃষ্টিকর্তার কাছে মনের কামনা-বাসনা পূরণের লক্ষ্যে প্রার্থনা করে থাকে ক্ষুদ্র জাতিসত্তার মানুষ। এছাড়া নিজেদের ভাষা ও সংস্কৃতি আন্দোলনের অংশ হিসেবে ১৯৯৬ সাল থেকে জাতীয় আদিবাসী পরিষদ এ পূজাকে ঘিরে নওগাঁসহ সমতলের বিভিন্ন অঞ্চলে সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান ও আদিবাসী সম্মেলনের আয়োজন করে আসছে।
উপজেলার নাটশাল মাঠে নওগাঁসহ পাশবর্তী জয়পুরহাট ও নাটোর জেলা থেকে মোট ২৫টি দল উৎসবে অংশ নেয়। এ সময় পুরো এলাকা আদিবাসীদের সকল সম্প্রদায় মানুষের হয়ে উঠে মিলন মেলা।
জেলার পত্নীতলা থেকে আসা অঞ্জলী খানকো বলেন, কারাম আমাদের জাতীয় উৎসব। এ পূজার মাধ্যমে সংসারের উন্নতি, স্বামী-সন্তান ও পরিবার-পরিজন নিয়ে সুখে শান্তিতে থাকতে পারবো ঈশ্বরের কাছে এই চাওয়া।
নবম শ্রেণীর শিক্ষার্থী লাকী তিরকি মুণ্ডা জানায়, ঈশ্বরের কাছে চাওয়া পড়াশুনায় ভালো করাসহ যেন জীবনে উন্নতি করতে পারি। এছাড়া বাবা-মা’র সেবা করাসহ দেশবাসীর সেবা করতে পারি। এ উৎসবে দল বেঁধে নাচতে পেরে অনেক খুশি।
জেলা জাতীয় আদিবাসী পরিষদ সভাপতি আমিন কুজুর বলেন, ১৯৯৬ সাল থেকে জাতীয়ভাবে এ উৎসব পালন করা হচ্ছে। দলবদ্ধ ছন্দময় নাচের মাধ্যমে তাদের নিজেদের ভাষা সাংস্কৃতি তুলে ধরে।
জাতীয় আদিবাসী পরিষদের উপদেষ্টা ও সাংস্কৃতিক ব্যক্তিত্ব আজাদুল ইসলাম বলেন, আদিবাসীরা হচ্ছে প্রকৃতির পূজারি। তারা মনে করে প্রকৃতি তাদের ভালো রাখতে পারবে। এ লক্ষ্যে তারা কারাম পূজা করে থাকে। এ পূজা পরিবার, সমাজ ও দেশের মঙ্গল বয়ে নিয়ে আসবে বলে মনে করা হয়।