বাসস
  ১৮ মে ২০২২, ১৪:৫৫
আপডেট  : ১৮ মে ২০২২, ১৬:৩২

করোনার ছোবলে পুষ্টিখাতে কাঙ্ক্ষিত লক্ষ্যমাত্রা অর্জনে দেশে ঘাটতি দেখা দিয়েছে

ঢাকা, ১৮ মে, ২০২২ (বাসস) : সিএনজি চালক স্বামী রুহুল আমিন আর দুই সন্তান নিয়ে গৃহকর্মী ফিরোজা বেগমের সংসার। রাজধানীর তিলপাপাড়া কালভার্ট রোড এলাকার একটিমাত্র ঘরে এই চারজনের বাস। দেশে করোনার সংক্রমণ শুরুর পর রুহুলের সিএনজি চালানো বন্ধ হয়ে যায়। পুরোপুরি বেকার হয়ে যান রুহুল।
ফিরোজা যে ছয় বাসায় গৃহকর্মীর কাজ করতেন, সেই কাজও হারান। এরইমধ্যে ফিরোজার গর্ভে আবার সন্তান আসে। বড় সন্তানের বয়স পাঁচ বছর, ছোটটির দুই। করোনার আগে প্রতিদিনের খাদ্য তালিকায় মাছ বা ডিমসহ পুষ্টিকর খাবার থাকলেও করোনা শুরুর পর তা বাদ দিতে হয়। দু’জনেরই আয়ের পথ যখন বন্ধ, তখন ভাতের থালায় আলুর প্রাধান্য বেড়ে যায়। চলতি বছরের জানুয়ারি মাসে তৃতীয় সন্তান জন্ম দেন ফিরোজা। শারীরিকভাবে দুর্বল ফিরোজা স্বল্প ওজনের সন্তান প্রসব করেন। দুই মাসের মাথায় সেই সন্তান মারা যায়।
খিলগাঁও রেলগেট এলাকায় পিঠা বিক্রি করেন আফছার আলী ও তার স্ত্রী রাবেয়া খাতুন। বিকাল থেকে রাত পর্যন্ত চিতই ও তেলের পিঠা বানান এই দম্পতি। পিঠা বানানোর সময় রাবেয়া খাতুনের পাশে বসে থাকে তার দুই বছরের মেয়েটি। পাতলা গড়নের মেয়েটি যে অপুষ্টির শিকার, তা দেখেই বোঝা যায়।
রাবেয়া খাতুনের সাথে আলাপে জানা গেছে, তার তিনটি সন্তানই এমন লিকলিকে। করোনার কারণে পিঠা বিক্রি বন্ধ ছিল। জমানো পুঁজিও তেমন ছিল না। তিন বেলার খাবার জোগানোই কষ্টকর হয়ে পড়ে। অভাবের সংসারে খাবার তালিকায় মাছ, ডিম মাংস থাকার প্রশ্নই ওঠে না। তখন ক্ষুধা নিবারণই ছিল মুখ্য। করোনার সময় ধার-দেনা করে চলতে হয়েছিল। এখন টানতে হচ্ছে ঋণের বোঝা।  
ফিরোজা ও রাবেয়ার পরিবারের মতো অসংখ্য পরিবারের খাবার নিশ্চিত হলেও পুষ্টির বিষয়টি থেকে যাচ্ছে উপেক্ষিত, একেবারেই তলানিতে। করোনা মহামারির কারণে এর ব্যাপকতা বেড়েছে। তবে এও সত্য যে কোভিডের আগেও দেশের পুষ্টি নিরাপত্তার সূচকগুলো খুব একটা সন্তোষজনক পরিস্থিতিতে ছিল না।
বিশেষজ্ঞরা বলছেন, স্বাস্থ্যখাতের বিভিন্ন সূচকে উন্নতি হলেও পুষ্টিখাতে কাক্সিক্ষত লক্ষ্যমাত্রা  এখনো পুরোপুরি অর্জন করতে পারেনি  বাংলাদেশ। দেশে নবজাতক, শিশু, নারী ও প্রবীণ জনগোষ্ঠীর বড় একটি অংশ এখনো স্থায়ীভাবে অপুষ্টিতে ভুগছে। স্বাভাবিক সময়ে অপুষ্টির যে চিত্র, করোনা মহামারিতে বেড়েছে তার ব্যাপকতা। জাতিসংঘসহ বিভিন্ন আন্তর্জাতিক ও দেশীয় গবেষণায়ও এমন তথ্য উঠে এসেছে।
জনস্বাস্থ্য পুষ্টি প্রতিষ্ঠানের রিপোর্ট বলছে, গড়ে একজন প্রাপ্তবয়স্ক সুস্থ স্বাভাবিক মানুষের দিনে ২১০০ কিলো ক্যালোরির প্রয়োজন। প্রয়োজনীয় ক্যালরি পূরণ করেও যদি কোনো ব্যক্তির প্রয়োজনীয় পুষ্টির চাহিদা পূরণ না হয়, সেটিও পুষ্টিহীনতা।
‘দ্য স্টেট অব ফুড সিকিউরিটি এন্ড নিউট্রিশন ইন দ্য ওয়ার্ল্ড টু থাউজ্যান্ড নাইনটিন’ শীর্ষক প্রতিবেদন অনুযায়ী, বাংলাদেশে প্রতি ছয় জনের একজন অপুষ্টিতে ভুগছে। জাতীয় পুষ্টি পরিষদের তথ্য অনুযায়ী, দেশে পাঁচ বছরের কম বয়সি শিশুদের মধ্যে দীর্ঘস্থায়ী অপুষ্টি বা খর্বতায় ভুগছে ৩১ শতাংশ। ৮ শতাংশ ভুগছে তীব্র অপুষ্টিতে। বয়স অনুপাতে কম ওজন ২২ শতাংশ শিশুর।
২০২০ সালের জুলাই মাসে খাদ্য অধিকার বাংলাদেশ পরিচালিত ‘দরিদ্র মানুষের খাদ্য ও পুষ্টির ওপর কোভিড ১৯-এর প্রভাব’ শীর্ষক জরিপের তথ্য ঃ ওই জনগোষ্ঠীর ৮৭ শতাংশই খাদ্য ও পুষ্টির সংকটে রয়েছে। ২০২০ সালে বিশ্বের মোট জনসংখ্যার প্রায় ৯ দশমিক ৯ শতাংশ (৮১ কোটি ১০ লাখ) মানুষ অপুষ্টিতে ভুগেছে বলে বিশেষজ্ঞরা ধারণা করছেন। যা ২০১৯ সালের তুলনায় ৮ দশমিক ৪ শতাংশ বেশি।
বারডেম হাসপাতালের পুষ্টি বিভাগের প্রধান অধ্যাপক ডা. শামসুন নাহার নাহিদ বলেন, দারিদ্র্যই অপুষ্টির মূল কারণ নয়। সঠিক খাদ্যাভ্যাসের বিষয়ে মানুষের অসচেতনতা এবং নিরাপদ খাদ্য প্রাপ্যতার অভাবও অপুষ্টির অন্যতম কারণ। বাংলাদেশের বাস্তবতা হলো; মানুষ এখনো অতিরিক্ত পরিমাণে ভাত ও অপর্যাপ্ত পুষ্টি উপাদান সংবলিত খাদ্যের ওপর নির্ভরশীল হওয়ায় অন্য যে পুষ্টিকর খাবারগুলো আছে, যেমন শাক-সবজি, মাছ-মাংস, ডিম-দুধ-ডাল এগুলো খাওয়ার ব্যাপারে খুব একটা জোর দেন না।
তিনি বলেন, দ্রব্যমূল্যের ঊর্ধ্বগতির কারণে অনেকের মাছ-মাংস, শাক-সবজি ফলমূলের মতো পুষ্টিকর খাবার কিনতে পারছেন না। আবার সামর্থ্য থাকলেও অনেকে জানেন না কোন খাবার কী পরিমাণে খেতে হবে। খাদ্যে ভেজালের আতঙ্কে অনেকে জেনেবুঝেও পুষ্টিকর খাবার এড়িয়ে চলেন। এছাড়া বাংলাদেশে যে উপায়ে রান্না করা হয়, খাবারের পুষ্টি উপাদান নষ্ট হওয়ার পেছনে সেটিও একটি কারণ।
সম্প্রতি এক অনুষ্ঠানে স্বাস্থ্যমন্ত্রী জাহিদ মালেক জানান, বর্তমান বিশ্বে প্রায় ১০০ কোটি মানুষ পুষ্টিকর খাবার পান না। আর দেশে ১০ শতাংশ মানুষ এখনো পুষ্টিহীনতায় ভোগে। বাংলাদেশে পুষ্টির ঘাটতি থাকলেও আশপাশের দেশ থেকে ভালো অবস্থানে আছে। এমনকি ভারতের চেয়েও পুষ্টির দিক থেকে ভালো অবস্থানে আছে বাংলাদেশ।
পুষ্টিহীনতার কারণ সম্পর্কে তিনি বলেন, আমাদের দেশে কিছু মানুষ নানা কারণে পুষ্টিকর খাবার গ্রহণ করতে পারে না। এর মধ্যে দেশে পুষ্টিকর খাদ্যে ভেজাল বা কেমিক্যাল মেশানোর ফলে অনেক মানুষ সাধ্য থাকলেও পুষ্টিকর খাবার গ্রহণ করে না।
জনস্বাস্থ্য পুষ্টি প্রতিষ্ঠানের (আইপিএইচএন) পরিচালক অধ্যাপক ডা. নাসিরউদ্দিন মাহমুদ বাসসকে জানান, পুষ্টি বিষয়ে স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় সরাসরি কাজ করছে। পরোক্ষভাবে ২২টি মন্ত্রণালয় পুষ্টির সঙ্গে জড়িত। সবাই প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষভাবে এ নিয়ে কাজ করছে। শিশু পুষ্টি নিশ্চিত করতে দেশের প্রতিটি হাসপাতালে পুষ্টি কর্নার স্থাপন করা হয়েছে। আলাদা শিশু পুষ্টি কর্নার রয়েছে জেলা পর্যায়েও ।
শিশুদের স্বাস্থ্যগত ক্ষতি প্রতিরোধে কাজ চলছে জানিয়ে তিনি বলেন, গর্ভবতী মায়েদের স্বাস্থ্য ও পুষ্টির জন্য কাউন্সেলিংয়ের ওপর জোর দেয়া হচ্ছে। দেশের পুষ্টিমান বাড়ানোর জন্য আয়রন ও আয়োডিনের ওপর জোর দেয়া হচ্ছে। সারা দেশে সেটি মনিটরিং করা হচ্ছে। যাতে বাংলাদেশে আয়োডিনের ঘাটতিজনিত সমস্যার সমাধান করা যায়।

  • সর্বশেষ
  • জনপ্রিয়