শিরোনাম

হাফিজুর রহমান
বরগুনা, ৩১ ডিসেম্বর, ২০২৫ (বাসস) : জেলায় তিন নদীর ভাঙনে বিলীন হওয়ার পথে দুই কিলোমিটার বাঁধ। শুষ্ক মৌসুমেও পায়রা, বিষখালী ও বলেশ্বর নদীর তীব্র ভাঙন আতঙ্কে দিন কাটাচ্ছেন নদীতীরের কয়েক হাজার মানুষ। ইতোমধ্যে জেলার তিন নদীর ভাঙনে প্রায় দুই কিলোমিটার বন্যা নিয়ন্ত্রণ বাঁধ নদীগর্ভে বিলীন হওয়ার পথে। জেলায় থামছেই না নদীভাঙন। ভাঙনের থাবায় ফসলি জমি, বসতভিটা হারিয়ে নিঃস্ব হয়েছেন শত শত পরিবার।
জানা গেছে, বরগুনা জেলার ভেতর দিয়ে প্রবাহিত পায়রা ও বিষখালী নদী বঙ্গোপসাগরে গিয়ে মিলেছে। অপরদিকে পাথরঘাটা উপজেলার পূর্ব দিক দিয়ে বিষখালী ও পশ্চিম পাশ দিয়ে বলেশ্বর নদী সাগরে মিলিত হওয়ায় বরগুনা কার্যত নদীবেষ্টিত একটি জেলা। ফলে বছরজুড়েই নদীভাঙনের ঝুঁকিতে বসবাস করেন জেলার লাখো মানুষ।
সরেজমিনে দেখা যায়, বেশি ঝুঁকি পূর্ণ রয়েছে জেলার বামনা উপজেলার বেড়িবাঁধ। উপজেলার কলাগাছিয়া গ্রামে বিষখালী নদীর ভাঙনে বিলীন হওয়ার ঝুঁকিতে রয়েছে সরকারি আবাসন প্রকল্প ও উপজেলার একমাত্র খাদ্যগুদামটি। দক্ষিণ রামনা এলাকার বন্যা নিয়ন্ত্রণ বাঁধের প্রায় এক-তৃতীয়াংশ ইতোমধ্যে নদীতে বিলীন হয়ে গেছে। স্থানীয়দের আশঙ্কা, যেকোনো সময় পুরো বাঁধটি ভেঙে বিস্তীর্ণ এলাকা প্লাবিত হয়ে পড়বে।
বর্তমানে নদীভাঙনের হুমকিতে থাকা এলাকাগুলোর মধ্যে রয়েছে— বরগুনা সদর উপজেলার ছোট বালিয়াতলী, লতাকাটা, ডালভাঙা ও পালের বালিয়াতলী; বামনা উপজেলার দক্ষিণ রামনা, চলাভাঙ্গা, কলাগাছিয়া ও চেঁচান; বেতাগী উপজেলার কালিকাবাড়ি ও মোকামিয়া; পাথরঘাটা উপজেলার কাকচিড়া, কালমেঘা, পরিঘাটা ও গোড়াপদ্মা এবং তালতলী উপজেলার নলবুনিয়া, জয়ালভাঙা ও নিশানবাড়িয়া।
আরো দেখা গেছে, কাগজে-কলমে বন্যা নিয়ন্ত্রণ বাঁধ থাকলেও বাস্তবে অনেক স্থানে বাঁধের কোনো অস্তিত্ব নেই। কোথাও কোথাও জলোচ্ছ্বাস ঠেকাতে দায়সারা রিং বাঁধ নির্মাণ করা হলেও জোয়ারের পানি লোকালয়ে ঢুকে পড়ছে।
বরগুনা সদরের পায়রা নদীতীরের বালিয়াতলী গ্রামের বাসিন্দা আমিনুল বলেন, পায়রা নদী প্রতিবছর আমাদের ভিটেমাটি গিলে খাচ্ছে। দেড় যুগ ধরে এখানে কোনো বাঁধ নেই। প্রতি বছর বাড়ি ঘর সরাতে হয়। আমরা প্রতিবছরই নদী ভাঙনের আতঙ্কে থাকি।
স্থানীয় হাবিবুর রহমান বলেন, এ এলাকায় ৬০টি পরিবার সরাসরি ঝুঁকিতে রয়েছি। আমাদের এলাকা থেকে ৫০০ ফুট দূরে রিং বাঁধ দেওয়া হয়েছে, যা কোনো কাজে আসে না। এখানে জিও ব্যাগ ফেললে অন্তত কিছুটা রক্ষা পাওয়া যেত।
বামনা উপজেলার রামনা এলাকার ভাঙনকবলিত অংশে জিও ব্যাগসহ বাঁধের অংশ ধসে নদীতে বিলীন হয়েছে।
এ বিষয়ে স্থানীয় সাংবাদিক নাসির উদ্দীন বলেন, গত বছর এখানে বালুভর্তি বস্তা ফেলা হয়েছিল। তিন্তু ছয় মাসও টেকেনি। বিষখালীর উত্তাল ঢেউয়ে সব ভেসে গেছে। যেটুকু বাঁধ আছে, তা যেকোনো সময় ভেঙে পড়বে।
বরগুনা পানি উন্নয়ন বোর্ড (পাউবো) সূত্রে জানা গেছে, জেলায় ২২টি পোল্ডারে মোট ৮০৫ কিলোমিটার বাঁধ রয়েছে। এর মধ্যে প্রায় দুই কিলোমিটার বাঁধ মারাত্মকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত। তবে ৪১/১-এ, বি ও ৪১/৭ পোল্ডারের বাঁধ পুনর্বাসন এবং পায়রা-বিষখালী নদীভাঙন প্রতিরক্ষা প্রকল্পের আওতায় আরএডিপি অর্থায়নে ৮২৬ কোটি টাকা ব্যয়ে ৪৬.৩৫ কিলোমিটার টেকসই বাঁধ নির্মাণ করা হচ্ছে। পাশাপাশি আরও ৭১২ কোটি টাকা ব্যয়ে ১৪.১৬ কিলোমিটার ব্লক দিয়ে টেকসই বাঁধ নির্মাণকাজ চলমান রয়েছে। আগামী দেড় বছরের মধ্যে এসব কাজ শেষ হবে বলে আশা করছে পাউবো।
এ বিষয়ে বরগুনা জেলা নাগরিক অধিকার ফোরামের সাধারণ সম্পাদক মনির হোসেন কামাল বাসসকে বলেন, ‘ঝড় বা পূর্ণিমা-অমাবস্যার জোয়ারে পানির উচ্চতা ১০ থেকে ১৫ ফুট পর্যন্ত বেড়ে যায়। ষাটের দশকে নির্মিত এসব বাঁধগুলোর উচ্চতা এখন অপ্রতুল। বাঁধ মেরামতের পাশাপাশি উচ্চতা বাড়াতে হবে জরুরি ভিত্তিতে। তা না হলে যেকোনো সময় পুরো বাঁধটি ভেঙে বিস্তীর্ণ এলাকা প্লাবিত হয়ে পড়বে।
বরগুনা পানি উন্নয়ন বোর্ডের নির্বাহী প্রকৌশলী আবদুল হান্নান প্রধান বাসসকে বলেন, “আমরা ভাঙনকবলিত এলাকা পরিদর্শন করেছি। সাময়িক প্রতিরক্ষার পাশাপাশি স্থায়ী সমাধানের জন্য নতুন প্রকল্প প্রক্রিয়াধীন রয়েছে। অর্থ বরাদ্দ পেলে দ্রুত কাজ শুরু করা হবে।”
নদীভাঙন অব্যাহত থাকলে বরগুনার উপকূলীয় জনপদে সংকট আরও ঘনীভূত হবে বলে আশঙ্কা করছেন স্থানীয়রা। তারা দ্রুত কার্যকর ও টেকসই বাধের ব্যবস্থা গ্রহণের দাবি জানান।