বাসস
  ২৭ ডিসেম্বর ২০২৫, ১৬:২২

পটুয়াখালীতে আধুনিক প্রযুক্তিতে চারা উৎপাদনে সাফল্য, বদলে যাচ্ছে কৃষি চিত্র

ছবি : বাসস

এনামুল হক এনা

পটুয়াখালী, ২৭ ডিসেম্বর (বাসস): আধুনিক প্রযুক্তিতে চারা উৎপাদনে বদলে যাচ্ছে পটুয়াখালী জেলার কৃষি চিত্র। জেলার দশমিনা উপজেলায় এই প্রথম আধুনিক কৃষি প্রযুক্তি ব্যবহার করে মাটি ছাড়াই চারা উৎপাদনে সাফল্য অর্জন করেছেন জেলার কৃষি উদ্যোক্তা আবু জাফর চৌকিদার। কোকো পিট ও পলিনেট হাউজ পদ্ধতির মাধ্যমে উপজেলার সদর ইউনিয়নের আরজবেগী গ্রামের আবু জাফর বিভিন্ন জাতের সবজি, ফুল ও ফলের চারা উৎপাদন করে এলাকায় ব্যাপক সাড়া ফেলেছেন। কৃষিতে এই নতুন উদ্যোগকে জলবায়ু পরিবর্তন মোকাবিলায় একটি সময়োপযোগী ও টেকসই উদ্ভাবন হিসেবে দেখছেন সংশ্লিষ্টরা।

সংশ্লিষ্ট সূত্রে জানা গেছে, সাম্প্রতিক বছরগুলোতে জলবায়ু পরিবর্তনের বিরূপ প্রভাবের কারণে জেলার দশমিনা উপজেলাসহ উপকূলীয় অঞ্চলে কৃষি উৎপাদনে নানামুখী সংকট দেখা দিয়েছে। অনিয়মিত বৃষ্টিপাত, দীর্ঘস্থায়ী জলাবদ্ধতা, ঘূর্ণিঝড় ও লবণাক্ততার প্রভাব কৃষি কার্যক্রমকে ঝুঁকিপূর্ণ করে তুলেছে। বিশেষ করে বর্ষা মৌসুমে ফসলি জমিতে দীর্ঘ সময় পানি জমে থাকায় প্রচলিত পদ্ধতিতে চারা উৎপাদন প্রায় অসম্ভব হয়ে পড়ে। অবিরাম বৃষ্টিপাত ও রোগবালাইয়ের আক্রমণে অনেক সময় বপন করা চারাগুলো নষ্ট হয়ে যাওয়ার ফলে কৃষকরা আর্থিক ক্ষতির মুখে পড়েন।

এসব আর্থিক ক্ষতির বাস্তবতায় আধুনিক কৃষি প্রযুক্তির সহায়তায় কোকো পিটে মাটি ছাড়া পলিনেট হাউজ পদ্ধতিতে চারা উৎপাদনের উদ্যোগ গ্রহণ করা হয়। উপজেলা কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের পরামর্শ ও কারিগরি সহায়তায় কৃষি উদ্যোক্তা আবু জাফর চৌকিদার নিজ উদ্যোগে এই পদ্ধতি চালু করেন।

সরেজমিনে উপজেলার সদর ইউনিয়নের আরজবেগী গ্রামে আবু জাফরের বাগানে গিয়ে দেখা যায়, পলিনেট হাউজের ভেতরে সারিবদ্ধভাবে সাজানো ট্রেতে নারিকেলের ছোবড়া প্রক্রিয়াজাত করে তৈরি কোকো পিট ব্যবহার করে বীজ বপন করা হয়েছে। নির্দিষ্ট তাপমাত্রা ও আলো নিয়ন্ত্রণের মাধ্যমে এবং নিয়মিত পরিচর্যায় অল্প সময়ের মধ্যেই সুস্থ, সবল ও রোগমুক্ত চারা উৎপন্ন হচ্ছে। বর্তমানে এই পদ্ধতিতে বোম্বাই মরিচ, দেশি মরিচ, বিভিন্ন জাতের বারোমাসি ফুল, পাশাপাশি কিছু ফলজ চারাও উৎপাদন করা হচ্ছে। একেক দফায় প্রায় দুই হাজার চারা উৎপাদন করা সম্ভব হচ্ছে বলে জানান উদ্যোক্তা আবু জাফর।

স্থানীয় কৃষকদের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, আগে চারা সংগ্রহের জন্য পটুয়াখালীসহ দেশের বিভিন্ন জেলা থেকে চারা আনতে হতো। এতে পরিবহন ব্যয় বেড়ে যেত, সময় নষ্ট হতো এবং অনেক ক্ষেত্রে চারার গুণগত মান নিয়েও প্রশ্ন থাকত। দূরবর্তী এলাকা থেকে আনা চারার একটি অংশ পরিবহনজনিত কারণে নষ্ট হয়ে যেত। নতুন এই উদ্যোগের ফলে এখন স্থানীয় পর্যায়েই মানসম্মত ও রোগমুক্ত চারা সহজলভ্য হওয়ায় কৃষকরা উপকৃত হচ্ছেন এবং চাষাবাদে আগ্রহ বাড়ছে।

কৃষি উদ্যোক্তা আবু জাফর চৌকিদার বাসসকে বলেন, কোকো পিট পদ্ধতিতে চারা উৎপাদনে কোনো মাটির প্রয়োজন হয় না। নারিকেলের ছোবড়া নির্দিষ্ট সময় পানিতে ভিজিয়ে বিশেষভাবে প্রস্তুত করে ট্রেতে ব্যবহার করা হয়। এতে পানি ধারণ ক্ষমতা বেশি থাকায় চারার শিকড় দ্রুত বৃদ্ধি পায় এবং অতিরিক্ত পানির কারণে পচে যাওয়ার আশঙ্কা থাকে না বললেই চলে। ফলে চারা তুলনামূলকভাবে বেশি শক্ত ও সবল হয়।

তিনি বলেন, বর্ষা মৌসুম, গ্রীষ্মে তীব্র তাপদাহ কিংবা দীর্ঘ জলাবদ্ধতার মতো প্রতিকূল পরিস্থিতিতেও এই পদ্ধতিতে সারা বছর চারা উৎপাদন সম্ভব হচ্ছে। এতে কৃষকদের ক্ষতির ঝুঁকি কমে আসছে এবং উৎপাদন ব্যয়ও নিয়ন্ত্রণে থাকছে।

আবু জাফর বলেন, জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাবে দিন দিন কৃষি উৎপাদন ও কৃষকের জীবিকায় বড় ধরনের প্রভাব পড়ছে। আধুনিক প্রযুক্তি ব্যবহার ছাড়া এই চ্যালেঞ্জ মোকাবিলা করা কঠিন। পলিনেট হাউজে কোকো পিট পদ্ধতি ব্যবহার করে চারা উৎপাদনের মাধ্যমে কৃষিতে এক ধরনের বৈপ্লবিক পরিবর্তনের সূচনা হয়েছে, যা ভবিষ্যতে কৃষকদের জন্য নতুন সম্ভাবনা সৃষ্টি করবে।

উপজেলা কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের কর্মকর্তারা জানান, পলিনেট হাউজে চারা উৎপাদনের ফলে কীটপতঙ্গ ও ভাইরাসজনিত রোগের আক্রমণ উল্লেখযোগ্যভাবে কমে আসে। নিয়ন্ত্রিত পরিবেশে চারা উৎপাদনের কারণে রাসায়নিক কীটনাশকের ব্যবহারও কম প্রয়োজন হয়, যা পরিবেশ ও মানবস্বাস্থ্যের জন্য ইতিবাচক। পলিনেট হাউজে চারা উৎপাদন করার ফলে প্রবল বৃষ্টি, জলাবদ্ধতা ও অতিরিক্ত তাপমাত্রা থেকেও চারা সুরক্ষিত থাকে।

এ বিষয়ে উপজেলা কৃষি কর্মকর্তা কৃষিবিদ মো. জাফর আহমেদ বাসসকে বলেন, দশমিনায় কোকো পিট ব্যবহার করে মাটি ছাড়া পলিনেট হাউজ পদ্ধতিতে চারা উৎপাদন এই প্রথম। এটি একটি সময়োপযোগী ও সম্ভাবনাময় উদ্যোগ। এই পদ্ধতি অনুসরণ করলে উপজেলার ক্ষুদ্র ও প্রান্তিক কৃষক-কিষানীরা সারা বছরই মানসম্মত চারা উৎপাদন করতে পারবেন এবং নিজেদের চাহিদা মিটিয়ে অতিরিক্ত চারা বিক্রি করে আয় বাড়াতে পারবেন।

তিনি বলেন, ভবিষ্যতে এই প্রযুক্তি আরও বিস্তৃত করার পরিকল্পনা রয়েছে। কৃষি বিভাগের পক্ষ থেকে প্রশিক্ষণ ও পরামর্শের মাধ্যমে অন্যান্য কৃষকদেরও এ পদ্ধতির সঙ্গে যুক্ত করা হবে। এর মাধ্যমে স্থানীয় পর্যায়ে চারা উৎপাদনে স্বয়ংসম্পূর্ণতা আসবে, কৃষি উৎপাদন ব্যয় কমবে এবং দশমিনাসহ পুরো পটুয়াখালী জেলায় আধুনিক ও টেকসই কৃষির ভিত্তি আরও সুদৃঢ় হবে বলে কৃষি বিভাগ আশাবাদী।