বাসস
  ২৫ ডিসেম্বর ২০২৫, ১৬:৪৫

নেত্রকোণায় হাওরাঞ্চলে বোরো ধান চাষের প্রস্তুতিতে ব্যস্ত সময় পার করছেন কৃষকেরা 

ছবি : বাসস

 মো. তানভীর হায়াত খান

নেত্রকোণা, ২৫ ডিসেম্বর, ২০২৫ (বাসস) : শীতের কুয়াশাচ্ছন্ন ভোরে জেলার কৃষকেরা বেরিয়ে পড়েন হাওরে বোরো ধান চাষের প্রস্তুতি নিতে। শীতের সকালে পূবের আকাশে সূর্যের মিঠে আলো যখন বাঁশের বেড়ার ফাঁক-ফোকর দিয়ে ঘরে আসে এবং আড়মোড়া দিয়ে ঘুম ভাঙায় নবজাতক থেকে শুরু করে বৃদ্ধের, ঠিক তেমনি হাওরের আষ্টেপৃষ্টে জড়িয়ে থাকা বিস্তীর্ণ জলরাশি যখন নামতে শুরু করে তখনি আড়মোড়া দিয়ে জাগতে শুরু করে ধানি জমি।

এ সময়টাতে হাওরের বুক থেকে পানি নেমে যায়। আর পানি নামার সাথে সাথেই বেরিয়ে আসে কাদা পলিমাটির কালচে স্তর। এই মাটি কেবল কাদা নয়, বরং কৃষকের চোখে আগামীর সোনালী ফসল। দীর্ঘ কয়েক মাস জলের নিচে থাকায় জমে থাকা এই পলি বোরো চাষের জন্য আশীর্বাদ হয়ে দেখা দেয়। কৃষকেরা এখন ব্যস্ত সময় পার করছেন জমি প্রস্তুত করতে।

জেলার মদন, মোহনগঞ্জ ও খালিয়াজুড়ি উপজেলায় হাওরের প্রায় ৪২ হাজার হেক্টর জমি বর্ষায় পানিতে ডুবন্ত থাকে। শীতকালে পানি নেমে যাওয়ার সময় হলে কৃষকেরা পানি ধরে রাখার জন্যে আইল বেঁধে পানি আটকে রেখে তা বোরো ধান চাষের কাজে ব্যবহার করেন।

সরেজমিনে হাওরাঞ্চলে গিয়ে দেখা যায় কৃষকেরা বোরো ধানের বীজতলা থেকে বীজ তুলে নিয়ে যাচ্ছেন, বোরো ধানের এই বীজ জেলায় স্থানীয়ভাবে "জালা" নামে পরিচিত।
কোথাও দেখা যায়, কৃষকেরা ধানের ক্ষেত প্রস্তুত করছেন, আবার কোথাও ছোট ছোট আইল দিয়ে পানি আটকে রেখে জমিতে ট্রাক্টরের মাধ্যমে জমি প্রস্তুত করছেন। কোথাও কয়েকজন মিলেমিশে জমির আইলে বসে কাজের ফাঁকে দুপুরের খাবার সেড়ে নিচ্ছেন। আবার কোথাও দেখা যায় ডাঙায় আটকে পরা নৌকা মেরামত করতে।
হাওরের কৃষিতে বেড়েছে যন্ত্রের ব্যবহার।

পূর্বে গরু, লাঙল, মই, জোয়ালের মাধ্যমে কৃষকেরা কৃষি জমি প্রস্তুত বেশি পরিমাণে করলেও বর্তমানে তা অনেকটাই কমে গেছে। আজকাল কৃষকেরা আধুনিক প্রযুক্তির বিভিন্ন মেশিনের সাহায্যে জমি প্রস্তুত থেকে শুরু করে ফসল কর্তন পর্যন্ত ব্যবহার করেন প্রযুক্তি। ফলে সময় ও শ্রমের পরিমাণ কমেছে, কিন্তু বাড়ছে খরচ।

হাওরাঞ্চলে বছরে উৎপাদিত একটি মাত্র ফসল এ বোরো ধানের বেশ গুরুত্ব রয়েছে। জেলার খাদ্যের চাহিদা মিটিয়ে হাওরাঞ্চলের ধান দেশের বিভিন্ন জেলার খাদ্য ঘাটতি পূরণে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে আসছে।

মদন উপজেলার কুলিয়াটি গ্রামের কৃষক ফজলুর রহমানের সঙ্গে কথা হলে তিনি বলেন, কয়া হাওরে পূর্বপুরুষদের রেখে যাওয়া কৃষি জমিতে মেহনত করে বোরো ধান চাষের জন্য ক্ষেত প্রস্তুত করছেন। এবছর প্রায় ৫০ কাঠা জমিতে তিনি বোরো ধান চাষ করবেন। ইতিমধ্যে ১৫ কাঠা জমিতে রোপণ করেছেন বোরো ধানের বীজ।

তিনি জানান, গত তিন বছরে বন্যা না হওয়ায় হাওরাঞ্চলের কৃষকেরা স্বস্তিবোধ করছেন, হাওরের একমাত্র এ ফসল উৎপাদনে দিনরাত এক করে কাজ করে যাচ্ছেন তিনি। আগাম জাতের ধানের জাত রোপণ করছেন যেন বর্ষার পানি আসার আগেই ফসল ঘরে তুলতে পারেন।

খালিয়াজুড়ি উপজেলার নূরপুর বোয়ালী গ্রামের বেশ কয়েকজন কৃষকদের সাথে আলাপকালে জানা যায়, হাওরের একমাত্র ফসল বোরো ধান চাষে এখন বছর বছর খরচ বাড়ছে, তেলের দাম বাড়ায় সেচের খরচও বেড়ে গেছে। 

বিশাল হাওরের জমিতে প্রয়োজন অধিক শ্রমিক, কৃষিকাজে সম্পৃক্ত শ্রমিক ঢাকা, চট্টগ্রাম ও সিলেটসহ বিভিন্ন বিভাগে কাজের সুবাদে চলে যায়। এতে এখন হাওরে কৃষি শ্রমিক সঙ্কট থাকায় বাধ্য হয়ে অধিক টাকা মজুরি দিয়ে কাজ করাতে হচ্ছে, হালচাষে আধুনিক প্রযুক্তি ব্যবহারেও কাঠাপ্রতি বেড়েছে খরচ। ফলে বোরো ধান উৎপাদনে বেড়েছে অধিক খরচ।

জেলা কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের জেলা প্রশিক্ষণ কর্মকর্তা ড.চন্দন কুমার মহাপাত্র বাসসকে জানান, "জেলায় এ বছর জেলায় ১ লাখ ৮৫ হাজার ৫ শত ৪৮ হেক্টর জমিতে বোরো ধান আবাদের লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করা হয়েছে, যা উৎপাদনের লক্ষ্যমাত্রায় ৮ লাখ ৮১ হাজার ১১৫ মেট্রিক টন চাল।

হাওরাঞ্চলের ৪২ হাজার হেক্টর জমিতে বোরো ধান রোপণ শুরু হয়ে গেছে। ইতিমধ্যে হাওরের ১২শত হেক্টর জমিতে রোপণ করা হয়েছে, হাওরাঞ্চলে ব্রি ধান-৭৪,৮৮,৮৯,১০১,১০২,১০৪,১০৫ ইত্যাদি এবং বিনা ধান-২৪,২৫ এর পাশাপাশি হাইব্রিড ধানের আবাদ দিনদিন বৃদ্ধি পাচ্ছে।

তিনি জানান, হাওরে বীজতলা থেকে শুরু করে ফসল কর্তণ পর্যন্ত আমাদের উপসহকারী কৃষি কর্মকর্তার মাধ্যমে আমরা মাঠ পর্যায়ে কৃষকদের প্রযুক্তিগত সহযোগিতা দিয়ে থাকি। হাওরাঞ্চলে যেহেতু আকস্মিক বন্যা ও প্রাকৃতিক দুর্যোগের একটা সম্ভাবনা থাকে, তাই সেই বিষয়গুলো সামনে রেখে কৃষকেরা যেন আগাম ফসল ঘরে তুলতে পারে সেজন্যে আমরা সব রকম পরামর্শ ও সহযোগিতা করে থাকি।

প্রশিক্ষণ কর্মকর্তা আরো বলেন, “আমরা কৃষকদের আগাম জাতের বীজ রোপণ, পোকামাকড়ের আক্রমণ থেকে রক্ষা পাওয়াসহ বিভিন্ন প্রযুক্তিগত সহায়তা দিয়ে থাকি কৃষকদের। কোন প্রাকৃতিক দুর্যোগ না হলে এ বছর হাওরাঞ্চলসহ জেলায় বোরো ধানের ভালো ফলন আশা করা যায়।”

হাওরের একমাত্র এ ফসল ঘরে তুলতে কৃষকদের করতে হয় সংগ্রাম, সবসময় শঙ্কা থাকে আকস্মিক বন্যার। তাই আকস্মিক বন্যার পানি মোকাবেলায় প্রতিবছর হাওরে বাঁধ নির্মাণ ও সংস্কার করা হয়। এবছরও জেলার হাওরাঞ্চলে ফসল রক্ষায় বাঁধ নির্মাণ ও সংস্কারের কাজ শুরু হয়ে যাবে কয়েকদিনের মধ্যেই।

বাঁধ নির্মাণ ও সংস্কারের বিষয়ে জেলা পানি উন্নয়ন বোর্ডের নির্বাহী প্রকৌশলী মো. সাখাওয়াত হোসেন বাসসকে জানান, "গতকাল পিআইসি কমিটির সভা অনুষ্ঠিত হয়েছে। পি আই সি গঠন করা হয়ে গেছে, দু একদিনের মধ্যেই কাজ শুরু হয়ে যাবে, হাওরে অনেক জায়গার পানি নেমে গেলেও মাটি এখনো কাজের উপযুক্ত হয়নি, ভিজা অবস্থায় আছে। 

তিনি জানান, মদন উপজেলায় কয়েকটি পয়েন্টে শনিবার থেকে কাজ শুরু হয়ে যাবে, টাস্কফোর্সের মাধ্যমে চেক করতে হয়। গতকালের মিটিংয়ে তা জেলা পর্যায়ে সুপারিশ করা হয়েছে। প্রায় ১৪৯ কিলোমিটার বা এর বেশি বাঁধ নির্মাণ করা হবে। যা টাস্কফোর্সের মাধ্যমে সমন্বয় করে তা যাচাই বাচাই করে নির্ধারণ করা হবে। আশা করা যায় বাঁধ নির্মাণ ও সংস্কার কাজ যথাসময়ে শেষ হয়ে যাবে"।

পৌষের এই কনকনে ঠান্ডা বাতাসে শরীর যখন জমে যাওয়ার মতো অবস্থা, তখনো থেমে থাকেনা কৃষককের কর্মযজ্ঞ। ভোর হওয়ার সাথে সাথেই মাঠে এসে শুরু করেন কাজ, কৃষকদের যেন ক্লান্তি নেই, নিরলসভাবে কাজ করার এই দৃঢ় মানসিকতা যেন সভ্যতার উন্নতির অন্যতম পাথেয়। হাওর পারের কৃষকদের বিশ্বাস সব প্রতিকূলতা কাটিয়ে এবারও তারা ঘরে তুলবেন মেহনতের ফসল।