বাসস
  ২৪ ডিসেম্বর ২০২৫, ১২:৫৭

তারেক রহমান : গণতান্ত্রিক সংগ্রামের পরম্পরা

বিএনপি’র ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমান। ফাইল ছবি

\ মো. মানিকুল আজাদ \

ঢাকা, ২৪ ডিসেম্বর, ২০২৫ (বাসস) : তারেক রহমান, গণতান্ত্রিক সংগ্রামের এক অনন্য প্রতীক। গণতন্ত্র পুনরুদ্ধার লড়াইয়ের এক আপসহীন অঙ্গীকারের নাম। 

তারেক রহমান ২০০৮ সাল থেকে প্রায় আট হাজার কিলোমিটার দূরের প্রবাস জীবনে থেকেও ঠাঁই করে নিতে পেরেছেন কোটি মানুষের হৃদয়ে। হয়ে উঠেছেন বাংলাদেশের রাজনীতির মূল কেন্দ্রবিন্দু।  

কেবল তাই নয়, দেশের গণতন্ত্র পুনরুদ্ধারের লক্ষ্যে দীর্ঘ ও ক্লান্তিহীন সংগ্রামের মধ্য দিয়ে তিনি আজ জনগণের আস্থার এক অনন্য প্রতীক।

বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী দলের (বিএনপি) ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমান পরিবর্তিত রাজনৈতিক প্রেক্ষাপটে নির্বাসিত জীবনের ইতি টেনে ইতোমধ্যে স্বদেশে ফেরার সব প্রস্তুতি সম্পন্ন করেছেন। এবার সশরীরে দলের হাল ধরে দলকে যোগ্য অবস্থানে প্রতিষ্ঠিত করা এবং মানুষের হারানো ভোটাধিকার নিশ্চিত করাই তাঁর প্রধানতম লক্ষ্য।

শহীদ রাষ্ট্রপতি জিয়াউর রহমান ও তিনবারের সাবেক প্রধানমন্ত্রী বেগম খালেদা জিয়ার জ্যেষ্ঠ পুত্র তারেক রহমানের জন্ম ১৯৬৫ সালের ২০ নভেম্বর। তার শৈশব ও কৈশোর কেটেছে ঢাকায়, স্বাধীনতা ও গণতন্ত্রের লড়াইয়ের এক উত্তাল সময়ের মধ্য দিয়ে। 

দেশের নানা রাজনৈতিক উত্থান-পতনের প্রত্যক্ষ সাক্ষী তারেক রহমান মুক্তিযুদ্ধ চলাকালে তার মা এবং প্রয়াত ছোট ভাই আরাফাত রহমান কোকোসহ আটক হন। ফলে তিনি ছিলেন বাংলাদেশের স্বাধীনতা সংগ্রামের অন্যতম কনিষ্ঠ রাজনৈতিক বন্দি।

তার পিতা বিএনপির প্রতিষ্ঠাতা শহীদ রাষ্ট্রপতি জিয়াউর রহমান নিরাপদ সেনাজীবন ত্যাগ করে বাংলাদেশের স্বাধীনতার ঘোষণা দিয়ে মহান মুক্তিযুদ্ধে সম্মুখ সারিতে থেকে নেতৃত্ব দেন। 

বর্তমানে তারেক রহমান বিএনপির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যানের দায়িত্ব পালন করছেন। এর আগে তিনি দলের সিনিয়র ভাইস চেয়ারম্যান ও সিনিয়র যুগ্ম মহাসচিব ছিলেন।

শিক্ষা ও রাজনীতিতে হাতেখড়ি 

তারেক রহমান ঢাকা রেসিডেন্সিয়াল মডেল কলেজ থেকে মাধ্যমিক ও আদমজী ক্যান্টনমেন্ট কলেজ থেকে উচ্চ মাধ্যমিক সম্পন্ন করেন। ১৯৮৪ সালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হয়ে প্রথমে আইন এবং পরে আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিভাগে পড়াশোনা করেন।

কৈশোরে তিনি রাজনৈতিক পরিবেশ খুব কাছ থেকে দেখেন। এ সময় পিতার রাষ্ট্রপতি হিসেবে দেশ পরিচালনার পাশাপাশি নবগঠিত বিএনপিকে এগিয়ে নেয়ার কার্যক্রমকে খুব কাছ থেকে দেখার অভিজ্ঞতা লাভ করেন তারেক রহমান।

বিশ্ববিদ্যালয় জীবনেই তিনি সরাসরি রাজনীতিতে যুক্ত হন। তৃণমূল পর্যায়ে সাংগঠনিক ও জনসম্পৃক্ত কাজে প্রাথমিক অভিজ্ঞতা অর্জন করেন। পড়াশোনার সময় তিনি সক্রেটিস, প্লেটো, অ্যারিস্টটল, হবস, লক, রুশো, ভলতেয়ার ও কার্ল মার্কসের মতো মহান দার্শনিকদের চিন্তাধারার সঙ্গে পরিচিত হন, যা তার রাজনৈতিক দর্শনকে সমৃদ্ধ করে।

এরশাদ বিরোধী আন্দোলন 

আশির দশকে স্বৈরশাসক এরশাদের বিরুদ্ধে আন্দোলন একজন তরুণ রাজনীতিক হিসেবে তারেক রহমানের ব্যক্তিত্ব গঠনে বিশেষ ভূমিকা রাখে। কারণ সময়টি ছিল তাঁর মা বেগম খালেদা জিয়ার সাতদলীয় জোটের ব্যানারে রাজপথে আপসহীন নেতৃত্ব দেয়ার কাল। যা তারেক রহমানের চিন্তা ও মনন গঠনে ব্যাপক অবদান রাখে।

তারেক রহমান ১৯৮৮ সালে বগুড়ার গাবতলী উপজেলা বিএনপির প্রাথমিক সদস্য হিসেবে দলে যোগ দেন। নব্বইয়ের গণ-অভ্যুত্থানের মুখে স্বৈরশাসনের পতন ঘটলে ১৯৯১ সালে একটি অবাধ ও নিরপেক্ষ নির্বাচনের পথ প্রশস্ত হয়। এ সময় তারেক রহমান মায়ের সাথে সারা দেশের প্রায় প্রতিটি জেলায় নির্বাচনী প্রচারণা চালান, যার ফলশ্রুতিতে বিএনপি নিরঙ্কুশ জয়লাভ করে এবং বেগম জিয়া দেশের প্রথম নারী প্রধানমন্ত্রী হন।

পরবর্তীকালে তৃণমূল পর্যায়ে গণতন্ত্র শক্তিশালী করতে তিনি গোপন ব্যালটের মাধ্যমে জেলা নেতৃত্ব নির্বাচনের প্রক্রিয়া চালু করেন। তিনি ২০০১ সালে রাজধানীতে একটি গবেষণা দপ্তর স্থাপন করেন। সেখানে স্থানীয় সরকার ও সুশাসন বিষয়ে গবেষণা হয়। এসব আধুনিক ও সময়োপযোগী উদ্যোগ ২০০১ সালের নির্বাচনে বিএনপির ভূমিধস বিজয়ে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখে।

তৃণমূলমুখী রাজনীতি ও সাংগঠনিক দক্ষতা 

দলীয় প্রধানের সন্তান হওয়া সত্ত্বেও তারেক রহমান কোনো সরকারি পদ বা সংসদ সদস্য হওয়ার মোহ দেখাননি। বরং তার পূর্ণ মনোযোগ ছিল সারা দেশে তৃণমূল পর্যায়ে বিএনপিকে শক্তিশালী করার দিকে। এই সাংগঠনিক দক্ষতার স্বীকৃতিস্বরূপ ২০০২ সালে তিনি দলের সিনিয়র যুগ্ম মহাসচিব মনোনীত হন। এই দায়িত্বে থেকে তিনি দেশব্যাপী তৃণমূল পর্যায়ে সম্মেলন আয়োজন করে সাধারণ মানুষের সঙ্গে সরাসরি সম্পৃক্ত হওয়ার সুযোগ পান।

এ সময় তিনি সাধারণ মানুষের পাঠানো ১৮ হাজারেরও বেশি চিঠির উত্তর দেন। এই জনসম্পৃক্ততার পথ ধরেই তিনি কৃষকদের ভর্তুকি, বয়স্ক ভাতা, পরিবেশ রক্ষা এবং সমাজে লিঙ্গ সমতা নিশ্চিত করতে নারী শিক্ষার প্রসারে বৃত্তি চালুসহ নানা জনকল্যাণমূলক কাজে নিজেকে নিয়োজিত করেন।

ব্যক্তিগত জীবন 

তারেক রহমান ১৯৯৪ সালে চিকিৎসক জোবাইদা রহমানকে বিয়ে করেন। জোবাইদা রহমান সাবেক নৌবাহিনী প্রধান ও দুইবারের মন্ত্রী রিয়ার অ্যাডমিরাল মাহবুব আলী খানের কন্যা। 

ডা. জোবাইদা রহমান একজন হৃদরোগ বিশেষজ্ঞ। এই দম্পতির একমাত্র সন্তান ব্যারিস্টার জাইমা রহমান বর্তমানে আইন পেশায় নিয়োজিত। 

তারেক রহমান ২০১৫ সালের ২৪ জানুয়ারি ছোট ভাই আরাফাত রহমান কোকোকে হারান। কোকো মালয়েশিয়ায় হৃদরোগে আক্রান্ত হয়ে অকালে মৃত্যুবরণ করেন। একদিকে ছোট ভাইকে হারানো এবং একইসঙ্গে দীর্ঘদিন ধরে জনগণের গণতান্ত্রিক ও ভোটাধিকার থেকে বঞ্চিত থাকার বিষয়টি তারেক রহমানকে আরও মানবিক ও সহানুভূতিশীল নেতৃত্বে উদ্বুদ্ধ করে তোলে।

রাষ্ট্রীয় নিপীড়ন ও অদম্য মনোবল 

তৎকালীন সেনাসমর্থিত তত্ত্বাবধায়ক সরকার ২০০৭ সালের ৭ মার্চ কোনো আগাম অভিযোগ বা নোটিশ ছাড়াই তারেক রহমানকে আটক করে। ১৮ মাসের বন্দি জীবনে তিনি পুলিশ রিমান্ডে ভয়াবহ নির্যাতন ও অমানবিক আচরণের শিকার হন। 

তিনি ২০০৮ সালের ৩ সেপ্টেম্বর ঢাকার তৎকালীন পিজি হাসপাতালে চিকিৎসাধীন অবস্থায় মুক্তি পান। তাঁর শারীরিক অবস্থার আশঙ্কাজনক অবনতি হলে উন্নত চিকিৎসার জন্য এক সপ্তাহ পর বিদেশে পাঠানো হয়।

এই তিক্ত অভিজ্ঞতাগুলোই সৌভাগ্যবশত তার নৈতিক সাহস এবং দল ও জাতির প্রতি অঙ্গীকারকে আরও শক্তিশালী করেছে।

আন্তর্জাতিক পরিমণ্ডলে প্রাজ্ঞ নেতৃত্ব 

তারেক রহমানের বিচক্ষণ ও দক্ষ রাজনৈতিক চিন্তাধারা কেবল জাতীয় পর্যায়েই নয়, আন্তর্জাতিক অঙ্গনেও স্বীকৃত হয়েছে। তিনি ইতোমধ্যেই দেশের রাজনীতিকদের প্রতিহিংসা ও সংঘাতের পথ পরিহার করার আহ্বান জানিয়েছেন।

লন্ডনে দীর্ঘ প্রবাস জীবনে তারেক রহমান দেশের ভবিষ্যৎ উন্নয়ন পরিকল্পনা নিয়ে গবেষণামূলক কাজে নিজেকে নিয়োজিত রেখেছেন। পাশাপাশি ভার্চুয়াল সভার মাধ্যমে দলের আদর্শ ও রূপরেখা তৃণমূল পর্যায়ে পৌঁছে দিচ্ছেন।

তারেক রহমান ২০২৬ সালের ১২ ফেব্রুয়ারি অনুষ্ঠেয় ১৩তম জাতীয় সংসদ নির্বাচনকে সামনে রেখে তার রাজনৈতিক তৎপরতা ও জনসম্পৃক্ততা বহুগুণ বাড়িয়ে দিয়েছেন।

গণতন্ত্র পুনরুদ্ধার, ভোটাধিকার ফিরিয়ে আনা, রাষ্ট্র সংস্কার, ক্ষমতার বিকেন্দ্রীকরণ, ভঙ্গুর অর্থনীতি পুনর্গঠন এবং শিক্ষা ব্যবস্থার আমূল পরিবর্তনসহ ধর্ম-বর্ণ-লিঙ্গ নির্বিশেষে সমাজে সাম্য ও ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠার লক্ষে তিনি নিরন্তর লড়াই করে যাচ্ছেন।

গণতন্ত্র পুনরুদ্ধারে ভূমিকা 

বাংলাদেশের গণতন্ত্র পুনরুদ্ধারের আন্দোলনে তারেক রহমান গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রেখে চলেছেন। তাঁরই দিকনির্দেশনায় চব্বিশের জুলাই অভ্যুত্থানসহ প্রতিটি আন্দোলনে বিএনপির নেতা-কর্মীরা রাজপথে সক্রিয়ভাবে অংশ নেন।

এই অভ্যুত্থানের মধ্য দিয়ে আওয়ামী নেতৃত্বাধীন স্বৈরাচারী শাসনের পতন ঘটে। ওই বছরের ৫ আগস্ট রক্তাক্ত রাজপথের উত্তাল জনস্রোতের মুখে তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা দেশ ছাড়তে বাধ্য হন।

আওয়ামী লীগ ১৯৭৫ সালে দেশে একদলীয় ‘বাকশাল’ শাসন কায়েম করেছিল। পরবর্তী সময়ে ১৯৭৭ সালের ২১ এপ্রিল তৎকালীন লেফটেন্যান্ট জেনারেল জিয়াউর রহমান রাষ্ট্রীয় দায়িত্ব নিয়ে দেশে বহুদলীয় গণতন্ত্র চালু এবং সংবাদপত্রের স্বাধীনতা ও মতপ্রকাশের অধিকার নিশ্চিত করেন।

পরবর্তীকালে, ১৯৯০ সালের ৬ ডিসেম্বর এইচ এম এরশাদের স্বৈরাচারী শাসনের পতনের পর বাংলাদেশে সংসদীয় গণতন্ত্র পুনরায় চালু হয়। ১৯৯১-১৯৯৬ মেয়াদে বেগম জিয়ার নেতৃত্বে বিএনপি প্রথম সরকার গঠন করে দেশে এই গণতান্ত্রিক ধারা পুনরায় প্রবর্তন করে।

তারেক রহমান সবসময়ই দলের মূল গণতান্ত্রিক আদর্শে অবিচল থেকেছেন। একটি প্রকৃত গণতান্ত্রিক শাসনব্যবস্থা প্রতিষ্ঠার লক্ষ্য নিয়ে তিনি কাজ করে যাচ্ছেন, যা মানুষের অন্ন, বস্ত্র, বাসস্থান, শিক্ষা ও চিকিৎসার মতো মৌলিক অধিকারের পাশাপাশি ভোটাধিকার নিশ্চিত করবে।

৩১ দফা প্রস্তাব

বেগম জিয়ার ‘ভিশন ২০৩০’-এর আলোকে ২০২৩ সালে বাংলাদেশের ভবিষ্যৎ শাসনকাঠামোর রূপরেখা হিসেবে ৩১ দফার প্রস্তাবনা পেশ করেন তারেক রহমান।

এতে দ্বি-কক্ষ বিশিষ্ট সংসদ, তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থা, সাংবিধানিক ভারসাম্য এবং প্রধানমন্ত্রীর মেয়াদকাল নির্ধারণসহ মানবাধিকার সুরক্ষা, বেকার ভাতা, পরিবার-বান্ধব নীতি এবং বৃটিশ মডেলে আধুনিক স্বাস্থ্যসেবা ব্যবস্থা চালুর বিষয়টিও অন্তর্ভুক্ত রয়েছে।

এই প্রস্তাবনাগুলোই বিএনপির রাষ্ট্র পরিচালনা নীতিমালার ভিত্তি হিসেবে বিবেচিত হবে। আগামী জাতীয় নির্বাচনে ক্ষমতায় গেলে এসব বাস্তবায়নে তারেক রহমান পুরোপুরি অঙ্গীকারবদ্ধ।

সাহসের প্রতীক

তারেক রহমানের জীবন সহনশীলতা, তৃণমূলের সাথে নিবিড় সম্পর্ক, আদর্শিক রাজনীতি এবং মানবিক নেতৃত্বের এক উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত।

তারেক রহমানকে এখন দলীয় নেতৃত্বের ঊর্ধ্বে বাংলাদেশের আগামী দিনের প্রধানমন্ত্রী হিসেবে দেখা হচ্ছে। তবে তিনি মুক্তিযুদ্ধ ও জুলাই গণ-অভ্যুত্থানের চেতনায় উদ্বুদ্ধ হয়ে গণতন্ত্র পুনরুদ্ধারের লড়াইয়ে নিজের অবস্থানে অটল রয়েছেন।

১৯৮৮ থেকে ২০২৫ পর্যন্ত তারেক রহমানের এই দীর্ঘ পথচলা ধৈর্য, সংগঠন, নৈতিকতা ও সহমর্মিতার এক অনন্য শিক্ষা। এটি দেশের রাজনৈতিক ইতিহাসে তাকে এক পরিবর্তনকামী নেতা হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করেছে।