শিরোনাম

মো. তানিউল করিম জীম
ময়মনসিংহ (বাকৃবি), ১৭ ডিসেম্বর ২০২৫ (বাসস): সারের সঠিক ব্যবহারে ফলন বাড়ে ও মাটির উর্বরতা বজায় রাখে। দেশের কৃষি খাতে ইউরিয়া, টিএসপি, ডিএপি এবং এমওপি এ চার ধরনের রাসায়নিক সারের চাহিদা সবচেয়ে বেশি। এর মধ্যে সবচেয়ে বেশি প্রয়োজন হয় ইউরিয়া সার। সরবরাহে ঘাটতি হলে এর সরাসরি প্রভাব পড়ে ফসল উৎপাদনে। তাই কৃষি উৎপাদন স্বাভাবিক রাখতে প্রতি বছরই সরকারকে ভর্তুকি দিয়ে সার কিনতে হয় আন্তর্জাতিক বাজার থেকে।
এতে একদিকে সরকারকে ব্যয় করতে হচ্ছে বৈদেশিক মুদ্রা, অন্যদিকে দিতে হচ্ছে ভর্তুকিও। কিন্তু এর পরেও কাঙ্ক্ষিত ফসল উৎপাদন সম্ভব হচ্ছে না। এর ফলে যে পরিমাণ দানাদার ইউরিয়া সার কৃষি কাজে ব্যবহার করা হয়, তার সর্বোচ্চ ৪০ শতাংশ কাজে লাগে, বাকি অংশ নষ্ট হয়। এর ফলে উৎপাদন যেমন কম হচ্ছে, তেমনি বড় আর্থিক ক্ষতিরও সম্মুখীন হতে হচ্ছে।
দেশের কৃষি খাতের উৎপাদন বৃদ্ধি ও আর্থিক ক্ষতি কমানোর লক্ষে ইউরিয়া সারের ব্যবহার ও দক্ষতা বৃদ্ধির কথা বিবেচনা করে বাংলাদেশ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ের (বাকৃবি) একদল গবেষক প্রথমবারের মতো ন্যানো বায়োচার (কার্বন) সমৃদ্ধ ন্যানো ইউরিয়া সার উদ্ভাবনের দাবি করেছেন।
আজ বুধবার ন্যানো বায়োচার সমৃদ্ধ ন্যানো ইউরিয়া সার উদ্ভাবনের কথা জানিয়েছেন, গবেষক দলের প্রধান কৃষিতত্ত্ব বিভাগের বিভাগীয় প্রধান অধ্যাপক ড. আহমদ খায়রুল হাসান।
কৃষি গবেষণা ফাউন্ডেশনের (কেজিএফ) আর্থিক সহায়তায় এ গবেষণাটি পরিচালিত হচ্ছে ২০২৩ সাল থেকে। এ গবেষণায় অন্যান্য সদস্যদের মধ্যে আরো যারা যুক্ত ছিলেন তারা হলেন, বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের (বুয়েট) অধ্যাপক ড. মুহাম্মদ খোরশেদ আলম, বাংলাদেশ পরমাণু শক্তি কমিশনের (বিএইসি) সিএসও ড. শেখ মনজুরা হক, বাকৃবির মৃত্তিকা বিভাগের অধ্যাপক ড. তাহসিনা শারমিন হক, পিএইচডি ফেলো মো. আমজাদ হোসেন এবং বুয়েটের শিক্ষার্থী মো. রোকনুজ্জামান রিপন।
গবেষক দলের প্রধান অধ্যাপক ড. খায়রুল জানান, আমরা দুইটি পদ্ধতি ব্যবহারের মাধ্যমে ন্যানো ইউরিয়া তৈরি করতে সক্ষম হয়েছি। আমাদের তৈরিকৃত ন্যানো ইউরিয়া ২০-৫০ ন্যানো মিটারের। পাশাপাশি ন্যানো ইউরিয়াকে ন্যানো কার্বন কোটেড করা হয়েছে। যা ইউরিয়ার নাইট্রোজেন মুক্ত করার প্রক্রিয়াকে ধীরগতির করেছে।
তিনি জানান, ধান উৎপাদনের ক্ষেত্রে এর মাধ্যমে নিয়ন্ত্রিতভাবে নাইট্রোজেন মুক্ত করা সম্ভব হবে। এর মাধ্যমে নাইট্রোজেনের অপচয় কম হবে এবং কৃষকেরা কম ইউরিয়া সার ব্যবহারে অর্থনৈতিকভাবে লাভবান হবার পাশাপাশি তাদের ফসল উৎপাদনও বেড়ে যাবে।
তিনি আরো জানান, আমাদের মাঠ পর্যায়ে পরীক্ষা এখনো বাকি, তবে আশা করা যায় আগামী বোরো মৌসুমের পরেই দেশের বিভিন্ন অঞ্চলে এর মাঠ পর্যায়ের পরীক্ষা করা সম্ভব হবে। আমাদের লিটারেচার রিভিউ অনুসারে এই ন্যানো ইউরিয়া ব্যবহারের ফলে ২৫ শতাংশ কম ইউরিয়া লাগবে। বায়োচার কোডের ন্যানো ইউরিয়া পরিবেশবান্ধব।
এর ফলে গ্রিনহাউজ গ্যাস নিঃসরণ কমে যায়। আশা করি ন্যানো ইউরিয়া ব্যবহারে কৃষক এবং দেশ উপকৃত হবে। পাশাপাশি সরকার ইউরিয়া খাতে যে ভর্তুকি দেয় তার পরিমাণও কমে আসবে।
অধ্যাপক ড. খায়রুল গবেষণায় প্রাপ্ত ফলাফলের বিষয়ে বলেন, হাইড্রক্সিঅ্যাপাটাইট- ইউরিয়া, ইউরিয়া-ন্যানো বায়োচার এবং হাইড্রক্সিঅ্যাপাটাইট-ইউরিয়া-ন্যানো বায়োচার এই তিনটি ন্যানো হাইব্রিড ম্যাটেরিয়ালস সফলভাবে ল্যাবরেটরিতে উৎপাদন সম্পন্ন হয়েছে। এফটিআইআর বিশ্লেষণে শক্তিশালী রাসায়নিক বন্ধন ও ফাংশনালাইজেশন নিশ্চিত করা হয়েছে।
তিনি আরো বলেন, টিইএম বিশ্লেষণে কণার আকার ৩০-৩২ ন্যানোমিটারের মধ্যে পাওয়া গেছে, যা গাছের কোষে সহজে প্রবেশ করতে পারবে। প্রচলিত ইউরিয়া সার ব্যবহারের কার্যকারিতা মাত্র ৩০-৪০শতাংশ, যেখানে অ্যামোনিয়া গ্যাস, লিচিং, রানঅফ এবং ডিনাইট্রিফিকেশনের মাধ্যমে মোট ৫৫-১০০শতাংশ পর্যন্ত অপচয় ঘটে। এই বিশাল অপচয়ের ফলে নাইট্রাস অক্সাইড নির্গমনের মাধ্যমে মারাত্মক পরিবেশ দূষণ ঘটে (যা কার্বন-ডাই-অক্সাইডের চেয়ে ৩০০ গুণ শক্তিশালী গ্রিনহাউজ গ্যাস) এবং বৈশ্বিকভাবে ২৬-৪০ বিলিয়ন ডলারের বার্ষিক অর্থনৈতিক ক্ষতি হয়। এ সমস্যার সমাধানে সবচেয়ে বড় সাফল্য হিসেবে প্রায় অপচয়হীন ন্যানো সার তৈরির পদ্ধতি উদ্ভাবন করা হয়েছে। যা একবার প্রয়োগের সুবিধার কারণে শ্রম খরচও কমাবে।
ন্যানো-কার্বন ইউরিয়া সার ব্যবহারের সুবিধার বিষয়ে তিনি বলেন, নাইট্রোজেন ব্যবহারের দক্ষতা ৭৫-৮৫ শতাংশ বৃদ্ধি করে। যা গাছের চাহিদা অনুযায়ী নাইট্রোজেন রিলিজ নিশ্চিত করে এবং ন্যানো সারের ব্যবহারে আর্থিক ফলন নিশ্চিত হয়। অ্যামোনিয়া অপচয় ৮০-৯০ শতাংশ কম হয়, নাইট্রেট লিচিং ৬৫-৭৫ শতাংশ কম এবং নাইট্রোজেন ডাই অক্সাইড নির্গমন ৪০-৫০ শতাংশ কম করে। যার ফলে মাটির গুণাগুণ বৃদ্ধি পায়। পাশাপাশি ধানের ফলন ১০-২৫ শতাংশ বৃদ্ধি করে এবং প্রোটিনের উপাদান ৮-১২শতাংশ বৃদ্ধি করে ফসলের গুণগত মান উন্নয়ন ও রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা বৃদ্ধি করে। ন্যানো ইউরিয়া ব্যবহারের ফলে কমপক্ষে ২৫ শতাংশ ইউরিয়া সারের ব্যবহার কমবে, ফলে বিপুল পরিমাণ অর্থ সাশ্রয় করা সম্ভব হবে।
পিএইচডি ফেলো মো. আমজাদ হোসেন বলেন, ভারত থেকে অনেকেই তরল ন্যানো ইউরিয়া এনে ল্যাবে দিচ্ছে। কিন্তু আমরাই প্রথম ন্যানো বায়োচার সমৃদ্ধ ন্যানো ইউরিয়া নিয়ে গবেষণার মাধ্যমে সংশ্লেষণ করেছি। মাঠ পর্যায়ে ন্যানো ইউরিয়া নিয়ে পরীক্ষণ সফল হলে দেশের জন্যে এটি একটি মাইলফলক হবে।
বাংলাদেশ কৃষি গবেষণা কাউন্সিলের চেয়ারম্যান ড. মো. আবদুস ছালাম এ বিষয়ে বলেন, আমাদের লক্ষ্য টেকসই, নিরাপদ ও লাভজনক কৃষি ব্যবস্থার ব্যাপক উন্নতি।
এখন কৃষিকে লাভজনক করতে হলে উৎপাদন ব্যয় কমিয়ে আনতে হবে। আমাদের দেশে প্রতিবছর প্রায় ২.৭ মিলিয়ন মেট্রিক টন ইউরিয়া সার ব্যবহৃত হয়।
তিনি বলেন, আমাদের দেশের কৃষির ৩০ টি বিশেষ অঞ্চলে পরীক্ষামূলক প্রয়োগের মাধ্যমে ন্যানো ইউরিয়া কতটুকু মাত্রায় প্রয়োগ করা দরকার তা নির্ধারণ করা প্রয়োজন।
কোন অঞ্চলে এবং কোন ফসলের জন্য কি পরিমাণ ন্যানো ইউরিয়া প্রয়োজন তা মাঠ পর্যায়ে গবেষণা করে সুনির্দিষ্ট ভাবে কৃষকদের জানানো প্রয়োজন। এভাবে কৃষকদের নির্দেশনা প্রদান করতে পারলে কৃষকরা উপকৃত হবেন বলে আশাবাদী।