বাসস
  ১৭ ডিসেম্বর ২০২৫, ১২:৫৩

বিজয়ের একদিন পর ১৭ ডিসেম্বর খুলনা মুক্ত দিবস

ঐতিহাসিক খুলনা মুক্ত দিবস আজ। ফাইল ছবি

\ মুহাম্মদ নূরুজ্জামান \

খুলনা, ১৭ ডিসেম্বর, ২০২৫ (বাসস) :বাংলাদেশের বিজয় ১৬ ডিসেম্বর অর্জিত হলেও খুলনা মুক্ত হয়েছিল বিজয় দিবসের একদিন পর, ১৭ ডিসেম্বর। 

আজ বুধবার মুক্তিযোদ্ধা সমাবেশের মধ্য দিয়ে পালিত হচ্ছে ‘খুলনা মুক্ত দিবস’।

মুক্তিযুদ্ধের ঐতিহাসিক প্রেক্ষাপট বিশ্লেষণে জানা যায়, ১৬ ডিসেম্বর রাতেও খুলনা কেঁপে ওঠে ট্যাংক, কামান, বোমা ও গোলাবারুদের আঘাতে। এ সময় মিত্রবাহিনী ও হানাদার বাহিনী মুখোমুখি যুদ্ধ হয় খুলনার শিরোমণি, গল্লামারী রেডিও স্টেশন (খুলনা বিশ্ববিদ্যালয় এলাকা), লায়ন্স স্কুল, বয়রার পোস্ট মাস্টার জেনারেলের কলোনি এলাকা, ৭ নম্বর জেটি এলাকা, নূরনগর ওয়াপদা (পানি উন্নয়ন বোর্ড) ভবন, গোয়ালপাড়া, গোয়ালখালি, দৌলতপুর, টুটপাড়া, নিউ ফায়ার ব্রিগেড স্টেশনসহ বিভিন্ন এলাকায়।

হানাদার পাকিস্তানি বাহিনীর আত্মসমর্পণ ও সারাদেশে বিজয়ের লাল-সবুজ উড়লেও ব্যতিক্রম ছিল খুলনা। সেদিনও হানাদারদের আগ্রাসন বন্ধ হয়নি। পরাজয়ের শেষ প্রতিশোধে মরিয়া। তারা খুলনার প্রবেশ পথে বীর মুক্তিযোদ্ধা ও মিত্রবাহিনী অগ্রযাত্রায় আক্রমণ করে পাক সেনারা।

চারিদিক থেকে তীব্র প্রতিরোধ গড়ে বীর মুক্তিযোদ্ধারা। হার মানতে বাধ্য হয় হানাদার বাহিনী, মহান বিজয় দিবসের একদিন পর হানাদার মুক্ত হয় খুলনা। তাই আজ ১৭ ডিসেম্বর খুলনা মুক্ত দিবস।

১৬ ডিসেম্বর শেষ রাতে খুলনার প্রবেশ পথে গল্লামারীতে যে যুদ্ধ হয় তাতে দুজন মুক্তিযোদ্ধা মারাত্মকভাবে আহত হন। ১৭ ডিসেম্বর ভোরে শিপইয়ার্ডের কাছে রূপসা নদীতে বটিয়াঘাটা ক্যাম্প থেকে মুক্তিযোদ্ধাদের একটি লঞ্চ এসে পৌঁছে। কিন্তু শিপইয়ার্ডের মধ্যে ঘাপটি মেরে থাকা পাক সৈন্যরা লঞ্চটির ওপর আক্রমণ চালায় এবং গুলিবর্ষণ করে।

মুক্তিবাহিনীও লঞ্চ থেকে নেমে শিপইয়ার্ডের ওপারের ধানখেতে অবস্থান নিয়ে পাল্টা গুলি চালায়। উভয় পক্ষের গুলিবিনিময়ে এক জন মুক্তিযোদ্ধা নিহত ও ১৬ জন আহত হন। এই যুদ্ধে পাক বাহিনীরও কয়েকজন সদস্য নিহত ও আহত হয়।
অবশেষে সব বাধা অতিক্রম করে ১৭ ডিসেম্বর সকালে মুক্তিযোদ্ধারা খুলনা শহরে প্রবেশ করতে শুরু করেন। খুলনা সার্কিট হাউস দখল করার পর মেজর জয়নুল আবেদীন ও রহমত উল্লাহ্ দাদু যৌথভাবে সার্কিট হাউসে স্বাধীন বাংলার পতাকা উত্তোলন করেন।

পরে মুক্তিযোদ্ধা স ম বাবর আলী, আবুল কালাম আজাদ, রেজাউল করিম, গাজী রফিকুল ইসলাম প্রমুখ হাদিস পার্কে স্বাধীন বাংলার পতাকা উত্তোলন করেন।

মিত্রবাহিনী খুলনা শহরে প্রবেশ করার ৮ ঘণ্টা আগেই হানাদার বাহিনী মুক্তিযোদ্ধাদের কাছে আত্মসমর্পণ করতে বাধ্য হয়।

৯ম সেক্টর কমান্ডার মেজর এম এ জলিল, ক্যাপ্টেন হুদা, ডা. শাজাহান মোস্তফাসহ কয়েকজন খালিশপুরে মিত্রবাহিনীর সদর দপ্তরে গিয়ে জেনারেল দলবীর সিংহের সঙ্গে সাক্ষাৎ করেন। এরপর পাক বাহিনীর ব্রিগেডিয়ার হায়াত আলী খান খবর দেন যে তিনি তার বাহিনী নিয়ে আত্মসমর্পণ করতে সম্মত হয়েছেন। আত্মসমর্পণের যাবতীয় বিষয় আলাপ-আলোচনা শেষে ব্রিগেডিয়ার হায়াত তার ব্রিগেড মেজর ফিরোজকে বলেন, ‘সব সৈন্যকে অস্ত্র সমর্পণের নির্দেশ দাও- যুদ্ধশেষ’।এরপর খুলনা নিউজপ্রিন্ট মিলের দপ্তর থেকে ব্রিগেডিয়ার হায়াত খুলনা সার্কিট হাউস ময়দানের দিকে রওনা হন।

১৯৭১ সালের এদিন সূর্যোদয়ের পরপর গল্লামারী রেডিও সেন্টার থেকে সেনা ছাউনি ছেড়ে কনভয় নিয়ে বর্তমান সার্কিট হাউজে উপস্থিত হন। সেখানে শিরোমণি যুদ্ধেও পরাজয়ের খবর আসে। কিছুক্ষণের মধ্যে আকাশবাণী কলকাতা কেন্দ্র থেকে খুলনায় পাকবাহিনীর পতনের খবর প্রচার করা হয়। সকাল ৯টার দিকে ৯ নম্বর সেক্টর অধিনায়ক মেজর জয়নাল আবেদীন, লে. গাজী রহমতুল্লাহ দাদু বীর প্রতীক ও মুক্তিবাহিনীর আঞ্চলিক তৎকালীন প্রধান স ম বাবার আলী সার্কিট হাউজে উপস্থিত হয়ে পতাকা উত্তোলন করেন। হানাদার পাকবাহিনী ভীত সন্তস্ত্র হয়ে সার্কিট হাউজে আশ্রয় নেয়।

পাক বাহিনীর পরাজিত বিধ্বস্ত সৈন্যরাও সার্কিট হাউস ময়দানের দিকে রওনা হয়। রাস্তায় তখন আবাল-বৃদ্ধ, নারী-পুরুষের ঢল নেমেছে। সবাই ছুটছেন খুলনা সার্কিট হাউস ময়দানের দিকে। ১৭ ডিসেম্বর সার্কিট হাউস ময়দানে পাক বাহিনী আত্মসমর্পণের পর উল্লাসে আর আনন্দে ফেটে পড়ে মুক্তিকামী জনতা।

খুলনা শহর মুক্ত হওয়ায় চারিদিক থেকে মুক্তিপাগল জনতা স্লোগান দিতে থাকে ‘জয় বাংলা’। খুলনা নগরীর মুক্ত বাতাসে স্বাধীনতার পতাকা উড়তে শুরু করে।

মহানগরী খুলনা- ইতিহাসের আলোকে গ্রন্থে ড. শেখ গাউস মিয়া লিখেছেন, খুলনায় আত্মসমর্পণের প্রধান অনুষ্ঠান হয় সার্কিট হাউস ময়দানে, ১টা ৩০ মিনিটে। বিগ্রেডিয়ার দেলবার সিং, মেজর মঞ্জুর, মেজর জলিল, মেজর জয়নাল আবেদীন প্রমুখের সামনে ৮ জন সঙ্গীসহ খুলনাস্থ সদর দপ্তরের অধিনায়ক বিগ্রেডিয়ার হায়াৎ খান (পিএ ২১০৩)। অস্ত্র ও বেল্ট খুলে নত হয়ে আত্মসমর্পণ করেন।

আত্মসমপর্ণের দ্বিতীয় অনুষ্ঠান হয় খালিশপুর নিউজপ্রিন্ট মিলে হায়াৎ খানের সদর দপ্তরে। তখন প্রচণ্ড উল্লাস ধ্বনি শোনা যায়।
সাংবাদিক ও লেখক কাজী মোতাহার রহমান বাবু এক নিবন্ধে উল্লেখ করেন, ১৯৭১ সালের ১৭ ডিসেম্বর, শুক্রবার। খুলনার পূর্বাকাশে প্রত্যুষে নতুন সূর্য উকি দেয়। তখনও শহরবাসী ঘুমে আচ্ছন্ন। গল্লামারী ও শিরোমণিতে দুপক্ষের মেশিনগান গর্জে উঠছে। শহরের পথে প্রান্তরে হাজার হাজার মুক্তিবাহিনী। শিপইয়ার্ড, ফায়ার বিগ্রেড, ওয়াপদা, পিএমজি, খুলনা সার্কিট হাউজের সেনা ছাউনি গুটিয়ে পাকবাহিনীর কর্মকর্তারা নিউজপ্রিন্ট মিলে আশ্রয় নেয়। সেখানে পাকবাহিনীর আত্ম সমর্পণের পর জেনেভা কনভেনশন অনুযায়ী পরাজিত পাক সেনাদের নিরাপত্তার জন্য জেলা কারাগারে পাঠানো হয়। হাজার হাজার মানুষ বিজযের স্লোগানে মুখরিত করে মহানগরী।

এদিকে খুলনা মুক্ত দিবস উপলক্ষে আজ ১৭ ডিসেম্বর শিল্পকলা একাডেমি মিলনায়তনে খুলনা, বাগেরহাট, সাতক্ষীরা ও খুলনা মহানগর ইউনিট কমান্ডের পক্ষ থেকে মুক্তিযোদ্ধা সমাবেশ অনুষ্ঠিত হয়। কর্মসূচিতে মুক্তিযোদ্ধা, স্থানীয় প্রশাসনসহ বিভিন্ন সংগঠন অংশগ্রহণ করেন।