বাসস
  ০৪ ডিসেম্বর ২০২৫, ১৭:৫৮

মেজর হাফিজ উদ্দিন সিলেটের ধলাই বিওপিতে বাংলাদেশের পতাকা উত্তোলন করেন

বীরবিক্রম মেজর (অব.) হাফিজউদ্দিন আহম্মেদ। ছবি : সংগৃহীত

আল-আমিন শাহরিয়ার

ভোলা, ৪ ডিসেম্বর ২০২৫ (বাসস): ১৯৭১ সালে মুক্তিযুদ্ধের নেতৃত্ব দানকারী এক দুঃসাহসী বীর বিক্রমের নাম মেজর (অব.) হাফিজউদ্দিন আহম্মেদ। বর্তমানে তিনি বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী দল বিএনপির জাতীয় স্থায়ী কমিটির সদস্য। তিনি সাবেক পানি সম্পদ মন্ত্রী ছিলেন। বাংলাদেশের মুক্তির সংগ্রাম আর বিজয় রণতরীর নবদিগন্ত ছিনিয়ে এনে স্বাধীনতার লাল সূর্য যারা উপহার দিয়েছিলেন, তাদের-ই একজন তিনি। স্বাধীনতার ইতিহাস ঘাটলে তার মুক্তিযুদ্ধকালীন উত্তাল দিনের নানা ইতিহাস আজো অনুপ্রেরণা যোগায় নতুন প্রজম্মকে। 

ভোলা জেলার মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস পাঠে জানা যায়, মেজর হাফিজ উদ্দিন আহমদের জন্ম ২৯ অক্টোবর ১৯৪৪ইং সালে। মাতা করিমুন্নেসা ও বাবা ডাক্তার আজহারউদ্দিন এর গর্বিত এ বীর সন্তান হাফিজ উদ্দিন আহমদের বাড়ি ভোলার লালমোহন উপজেলার ধলীগৌড় নগর ইউনিয়নের চতলা নামক গ্রামে। তিনি একাধারে একজন বাংলাদেশী সামরিক ব্যক্তিত্ব, রাজনীতিবিদ, ফুটবলার, দৌড়বিদ ও বীর মুক্তিযোদ্ধা। তিনি সাবেক প্রধানমন্ত্রী দেশনেত্রী বেগম খালেদা জিয়ার মন্ত্রিসভায় পানি প্রতিমন্ত্রী ও পানি মন্ত্রীর দায়িত্ব পালন করেছেন। ভোলা-৩ আসন (লালমোহন-তজুমদ্দিন) থেকে তিনি পরপর ৬ মেয়াদে সংসদ সদস্য নির্বাচিত হয়েছিলেন।

জানা যায়, ১৯৭১ সালের ১ ডিসেম্বর ভোরের অন্ধকারে সিলেটের ছাতক উপজেলার ধলাই বিওপিকে চারদিক থেকে ঘিরে ফেলেছিল মুক্তিযোদ্ধাদের এক দুর্বার বাহিনী—জেড-ফোর্সের ব্র্যাভো কোম্পানি। আর সেই কোম্পানির নেতৃত্বে ছিলেন, ভোলার গর্ব, অদম্য বীর সেনানী, মেজর (তৎকালীন ক্যাপ্টেন) হাফিজ উদ্দীন বীর বিক্রম।

মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস গ্রন্থ থেকে প্রাপ্ত তথ্য অনুযায়ী জানা যায়, ধলাই ছিল পাকিস্তানিদের এক অভেদ্য দুর্গ—৪৫০-৫০০ পাকসৈন্য, মর্টার, রিকয়েলেস গান, এমএমজিসহ এক ভয়ঙ্কর প্রতিরক্ষা বেষ্টনী।

অন্যদিকে ব্র্যাভো কোম্পানির ছিল মাত্র ৩৫০-৪০০ তরুণ যোদ্ধা, কয়েকটি লাইট মেশিনগান ও দু’টি ৩-ইঞ্চি মর্টার। কিন্তু বাঙালিদের ছিল আরেক অস্ত্র—বাংলাদেশের প্রতি অটল ভালোবাসা এবং বিজয়ের শপথ।

ওইদিন ভোর পৈানে পাঁচটায় চার কোম্পানি ধলাই ঘিরে ফেলে। সকাল ৬টায় হানাদারদের বাঙ্কারের দিকে ছুটে যায় ব্র্যাভো কোম্পানি। শুরু হয় এক ভয়ংকর সম্মুখযুদ্ধ—হাতে-হাতে লড়াই, বাঙ্কার ভেদ, টানা এমএমজি ফায়ার, তবুও মুক্তিযোদ্ধারা থামেননি।

সম্মুখযুদ্ধে ২২ জন যোদ্ধা শহীদ হওয়া সত্ত্বেও সামনের সারিতে দাঁড়িয়ে মনোবল ভাঙতে দেননি ক্যাপ্টেন হাফিজ। দক্ষিণ দিক থেকে চার্লি কোম্পানি পিছিয়ে গেলে তিনি নিজেই দৌড়ে গিয়ে আবার তাদের যুদ্ধক্ষেত্রে ফেরান। 

দুপুর ৩টার দিকে শত্রুর কমান্ড পোস্টের দিকে আক্রমণ পরিচালনা করতে গিয়ে ১২০ মি. মর্টারের শ্যাপনেলে তাঁর ডান পা ও বাঁ হাত ক্ষতবিক্ষত হয়ে যায়। রক্তে ভিজে যায় ইউনিফর্ম।

অর্ডারলি তাঁকে সরিয়ে নিতে চাইলে উল্টো তিনি তাঁর এলএমজি কেড়ে নিয়ে গর্জে ওঠেন—

‘ধলাই দখল না করে কেউ পিছু হটবে না!’

এই কথাই হয়ে ওঠে ব্র্যাভো কোম্পানির জয়ের শপথ।

সন্ধ্যা ৬টায় মুক্তিযোদ্ধারা ভেদ করে শেষ বাঙ্কারটি। পাকিস্তানি কমান্ডার সাদা পতাকা তোলে। রাত ৮টায় ধলাই পুরোপুরি হানাদারমুক্ত হয়।

এই যুদ্ধে ৬৮ জন শহীদ ও ১২০ জন আহত হন। পাকবাহিনী ফেলে যায় ২২০-এর বেশি মরদেহ আর আত্নসমর্পণ করে ১৮৭ জন সৈন্য।

রক্তাক্ত পা নিয়েও মেজর হাফিজ উদ্দীন ধলাই বিওপির ওপর দাঁড়িয়ে বাংলাদেশের পতাকা উত্তোলন করেন। এটাই ছিল সিলেট-মুক্তির দ্বার খুলে দেওয়া সেই ঐতিহাসিক বিজয়। তাঁর অসামান্য বীরত্বের জন্যই তাকে বীর বিক্রম উপাধি দেওয়া হয়।

মুক্তিযুদ্ধের সেই রণাঙ্গনের স্মৃতিচারণ ও বর্তমান বাংলাদেশ নিয়ে খেতাবধারী এই বীর মুক্তিযোদ্ধা বাসসকে বলেন, স্বাধীনতার সংগ্রামে অংশ নিতে পেরে নিজেকে ভাগ্যবান মনে করছি। কিন্তু যে উদ্দেশ্যে দেশ স্বাধীন করা হয়েছিল, তা অর্জিত হয়নি। যারা যখন ক্ষমতায় এসেছেন, তারা বাংলাদেশের ইতিহাসকে বিকৃত করেছেন। ফলে রণাঙ্গণের যোদ্ধাদের প্রকৃত মূল্যায়ন হয়নি। স্বাধীনতার ঘোষক মেজর জিয়াউর রহমানের খেতাব কেড়ে নেওয়ার ধৃষ্টতা দেখানো হয়েছে বারবার।

তিনি মনে করেন, মানবিক মর্যাদা পুনরুদ্ধার, গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠা, সাম্য, সামাজিক ন্যায় বিচার ও অর্থনৈতিক মুক্তির জন্য বীর মুক্তিযোদ্ধারা যুদ্ধ করে দেশ স্বাধীন করেছিলেন। অথচ বাংলাদেশে গণতন্ত্র, মৌলিক অধিকার, বাকস্বাধীনতা সব ধ্বংস করে দিয়ে গেছে আওয়ামী লীগ সরকার। তবু আমি হতাশ নই। নতুন দিনের স্বপ্ন চোখে নিয়ে আগামী প্রজন্মকে বলতে চাই, তারা যেন মুক্তিযুদ্ধের লক্ষ্য বাস্তবায়নে এগিয়ে আসে।

বীর বিক্রম হাফিজ উদ্দিন আহমদ বলেন, ৭১ সালের মুক্তিযুদ্ধে যারা সশস্ত্র যুদ্ধ করেছে, তারা সকল কৃতিত্ব ও অধিকার থেকে বঞ্চিত। বাঙালি শ্রমিক, সৈনিক, ছাত্র-জনতার মিলিত উদ্যোগে মুক্তিযুদ্ধ শুরু হয়। এ সাধারণ সত্যটি স্বীকার করেনি তৎকালীণ ফ্যাসিষ্ট আওয়ামী লীগ সরকার। এমন কি তারা স্বাধীনতা যুদ্ধ কীভাবে শুরু হয়েছিল তা নিয়ে জনগণকে অন্ধকারে রেখেছিলো। 

একাত্তরে রণাঙ্গনের এই যোদ্ধা বলেন, সশস্ত্র যুদ্ধের ব্যাপারে ইতিহাসবিদেরা নীরব। এই যে সাধারণ মানুষের যুদ্ধকে রাজনৈতিক দলের যুদ্ধ হিসেবে চালিয়ে দেওয়ার জোর প্রবণতা আমাদেরকে আহত করেছে। 

তিনি বলেন, ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্ট মুক্তিযুদ্ধ শুরু না করলে দেশ আজও পাকিস্তান থাকত। দিন দিন মুক্তিযোদ্ধার সংখ্যা বাড়ছে, এটাও মুক্তিযুদ্ধের চেতনার বরখেলাপ।

মেজর হাফিজ বলেন, একাত্তরে অর্জিত স্বাধীনতা বাঙালি জাতির জন্য গর্বের বিষয়। অথচ স্বাধীনতা পরবর্তী সময়ে মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাসকে বিতর্কিত করা হয়েছে। 

তিনি আক্ষেপ করে বলেন, মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাসকে অতীতে গল্প-কবিতার মতো লেখা হয়েছিলো। এ ছাড়াও মুক্তিযুদ্ধে সম্মুখ সারিতে অংশগ্রহণ করা সেনা সদস্যদেরও যোগত্যা অনুয়ায়ী খেতাব না দেওয়ার অভিযোগ তুলে তিনি বলেন, মুক্তিযুদ্ধে অধিকাংশ খেতাব দেওয়া হয়েছে এমন ব্যক্তিদের যারা যুদ্ধে অংশ নেওয়া তো দূরের কথা; ৯ মাস ভারতেই অবস্থান করেছিলেন।

মুক্তিযুদ্ধের দুঃসহ স্মৃতি তুলে ধরে হাফিজ উদ্দিন আহমেদ বলেন, আমি পরিবার থেকে সম্পূর্ণ বিচ্ছিন্ন ছিলাম। আমার বাবা পাকিস্তান জাতীয় পরিষদের সদস্য ছিলেন। তিনি নিজেও পালিয়ে বেড়িয়েছেন। সীমান্ত অতিক্রম করেননি। ভোলার বিভিন্ন গ্রামে পালিয়ে বেড়ান। তার পক্ষে আমার খোঁজ নেওয়া সম্ভব হয়নি। আমিও পরিবারের সদস্যদের খোঁজ নিতে পারিনি। এমনকি স্বাধীন বাংলাদেশেও আমি আওয়ামী সরকারের অনেক রোষানলের শিকার হয়েছি। অসংখ্য মিথ্যা মামলায় আদালতের দরজায় দরজায় ঘুরতে হয়েছে আমাকে। ন্যায়বিচার পাইনি। গত ১৫ বছরে ৫ বার গ্রেপ্তার হয়ে জেলে গিয়েছি।

তিনি বলেন, দেশের পরিবর্তিত পরিস্থিতিতে এখন অন্তত আর গ্রেপ্তারের ভয় নেই। বাকিটা ভবিষৎ বলে দেবে- আমরা যারা রাজনীতি করি, তাদের ভবিষৎ কোন দিকে যাবে। দেশের জনতা বুকের রক্ত দিয়ে একটি পরিবর্তনের সূচনা করেছে। আশা করি আগামীতে অন্তত দেশে যেটাই হবে, তা যেন মানুষের জন্য, কল্যাণের জন্য কিছু হয়।

বিজয়ের মাসে এসে দেশের জনগণকে অভিনন্দন জানিয়ে রণাঙ্গণের মুক্তিযোদ্ধা মেজর হাফিজ বলেন, বিজয়ের মাসে ছাত্র-জনতাকে আমার অন্তরের অন্তরস্থল থেকে ভালোবাসা জানাই। তারা তুমুল সংগ্রাম করে স্বৈরাচার হটিয়েছেন। স্বৈরাচারের বিরুদ্ধে নতুন যুদ্ধে ছাত্ররা সাহসী বিপ্লবী সেনা।

তিনি আরও বলেন, স্বৈরাচার হটাতে ছাত্রদের পাশাপাশি আমার দল বিএনপির অবদানও কম নয়। এই দলটি গত ১৭ বছর ধরে স্বৈরাচারের বিরুদ্ধে লড়াই-সংগ্রাম করেছে। চূড়ান্ত পর্যায়ে ছাত্র জনতার মিলিত শক্তির কাছে ফ্যাসিস্ট বাহিনীর পরাজয় হয়েছে। ১৯৭১ সালের মুক্তিযুদ্ধ ছিল গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠা, মানবিক মর্যাদা ও সাম্য প্রতিষ্ঠার যুদ্ধ। জুলাই বিপ্লবও ছিল একই রকম।

মেজর হাফিজ প্রত্যাশা রাখেন বহু বছর পরে দেশের গণতন্ত্র পুনঃপ্রতিষ্ঠা করতে নতুন করে সুযোগ পেয়েছি। আশা করি সবাই মিলে বাংলাদেশকে একটি কল্যাণময় রাষ্ট্র হিসেবে গড়ে তুলব। আগস্ট বিপ্লব যেন ব্যর্থ না হয় এ জন্য আমরা বর্তমান সরকারকেও সাহায্য সহযোগিতা করব। তাইতো নতুন করে দেশ গড়তে আমরা একটি সুষ্ঠু নির্বাচনের অপেক্ষায় রয়েছি।

স্বাধিকার আন্দোলনের এই বীর সেনানী নিয়ে গর্বিত ভোলাবাসী। তাদের ভাষায় ‌‘আজ আমরা গর্ব করে বলি, আপনি আমাদের ব্র্যাভো কমান্ডো’। আপনি আমাদের বিজয়ের প্রতীক।

বীর বিক্রম মেজর হাফিজ উদ্দীন—বাংলার অমর সন্তান। তার মতো একজন হার না মানা জীবন্ত কিংবদন্তী সিপাহ সালার প্রতি কৃতজ্ঞ ভোলাবাসী।