শিরোনাম

।। শফিকুল ইসলাম বেবু।।
কুড়িগ্রাম, ১৬ নভেম্বর ২০২৫ (বাসস): জেলার সার্বিক শিক্ষা পরিস্থিতি নিয়ে সব শ্রেণি পেশার মানুষের মধ্যে চরম উদ্বেগ দেখা দিয়েছে। শিক্ষার মানোন্নয়নে প্রশাসনসহ, শিক্ষক, শিক্ষার্থী ও অভিভাবকদের আরো দায়িত্বশীল হওয়ার আহ্বান জানিয়েছেন জেলার সচেতন নাগরিকরা। শিক্ষকদের রাজনৈতিক সংশ্লিষ্টতা, শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে অনিয়ম, শিক্ষকদের দায়িত্বহীনতা, ক্লাসে অনুপস্থিতিসহ প্রশাসনের নজরদারির অভাবকে এর জন্য দায়ী মনে করছেন তারা।
সরকার প্রতি বছর এমপিওভুক্ত বিদ্যালয় ও কলেজের শিক্ষক-কর্মচারীদের বেতন-ভাতায় প্রায় ৪৮০ কোটি টাকা ব্যয় করলেও শিক্ষা প্রশাসনের নিষ্ক্রিয়তা, শিক্ষক অনুপস্থিতি, রাজনৈতিক ও ব্যবসায়িক কর্মকাণ্ডে শিক্ষকদের সম্পৃক্ততা এবং একাধিক প্রতিষ্ঠানে দায়িত্বহীনতার কারণে জেলার শিক্ষাব্যবস্থা কার্যত ভেঙে পড়েছে।
জেলা শিক্ষা অফিস সূত্রে জানা যায়, কুড়িগ্রামের ৯টি উপজেলায় এমপিওভুক্ত ৩১৮টি মাধ্যমিক বিদ্যালয়, ৬২টি নিম্ন মাধ্যমিক বিদ্যালয়, ১৯টি স্কুল অ্যান্ড কলেজ, ৯২টি কলেজ এবং ২১২টি মাদ্রাসা রয়েছে। এসব প্রতিষ্ঠানের বেতন ভাতা বাবদ সরকার প্রতি মাসে ব্যয় করে প্রায় ৪০ কোটি টাকা (তথ্যসূত্র : সোনালি ব্যাংক, কুড়িগ্রাম)। বছরে এই ব্যয় ৪৮০ কোটি টাকার বেশি।
সরজমিনে দেখা যায়, হাতে গোনা কয়েকটি শিক্ষা প্রতিষ্ঠান ছাড়া অধিকাংশ স্কুল-কলেজে শিক্ষার বেহাল দশা। শিক্ষকরা নিয়মিত ক্লাসে উপস্থিত হন না। অনেকেই রাজনীতি, ব্যবসা, সাংবাদিকতা বা কোচিং সেন্টার পরিচালনায় ব্যস্ত থাকেন। ফলে সরকারি বিশাল বরাদ্দ থাকা সত্ত্বেও শিক্ষার্থীরা মানসম্মত শিক্ষা থেকে বঞ্চিত হচ্ছে।
কুড়িগ্রাম সদরের কাঠালবাড়ি ডিগ্রি কলেজে শিক্ষক ২৯ জন, কর্মচারী ১১ জন। কিন্তু এবারের এইচএসসি পরীক্ষায় ২০৯ জনের মধ্যে পাস করেছে মাত্র ৩০ জন। শিক্ষার্থী অনুযায়ী এই কলেজের পাসের হার ১৪ শতাংশ।
কলেজ কর্তৃপক্ষ জানায়, শুধু বেতন বাবদ গত দুই বছরে কাঠালবাড়ি ডিগ্রি কলেজের পেছনে সরকার ব্যয় করেছে ২ কোটি ৬৪ লাখ টাকা। অথচ শিক্ষার্থীদের পাশের হার অত্যন্ত হতাশাজনক।
কাঠালবাড়ি ডিগ্রি কলেজের অধ্যক্ষ আব্দুল আজিজ বাসসকে বলেন, ‘কয়েকজন দায়িত্বহীন শিক্ষকের কারণে পুরো কলেজের ভাবমূর্তি ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে।’
কলেজের গভর্নিং বডির নতুন সভাপতি আব্দুল মালেক বলেন, ‘এখন থেকে বিধি মোতাবেক কলেজ পরিচালিত হবে। অনিয়ম পেলে সংশ্লিষ্ট ব্যক্তির বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়া হবে।’
জেলার শিক্ষকদের বিরুদ্ধে রাজনৈতিক ব্যস্ততা ও প্রক্সি দিয়ে ক্লাস নেওয়ার অভিযোগ দীর্ঘদিনের। রাজনৈতিক প্রভাব খাটিয়ে এতদিন তারা নিজেদের দায়িত্ব পালন না করেও বেতন নিয়েছেন। এদিকে সার্বিক শিক্ষা পরিস্থিতি হতাশাব্যাঞ্জক হওয়ায় এখন বিষয়টি সবার আলোচনায় এসেছে।
শিক্ষার্থীদের সাথে কথা বলে জানা যায়, বেশিরভাগ শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের শিক্ষকরা নিয়মিত ক্লাস নেন না। পরীক্ষায় ভালো করার জন্য কোনো সুনির্দিষ্ট গাইডলাইন নেই। অনেক শিক্ষক রাজনীতি, ইউনিয়ন পরিষদের কাজ, এনজিও কার্যক্রম, ব্যক্তিগত ব্যবসা বা মিডিয়া কর্মকাণ্ডে ব্যস্ত থেকে প্রক্সি দিয়ে ক্লাস নেন। এতে শিক্ষার্থীরা ক্লাসে উপস্থিত হওয়ার আগ্রহ হারিয়ে ফেলে। পরীক্ষার সময় তারা কোনোমতে পরীক্ষায় অংশ নিলেও ফলাফলে যেয়ে দেখা যায় বেশিরভাগ শিক্ষার্থীই ফেল করে।
এলাকাবাসীর সাথে কথা বলে জানা যায়, মালেকা খাতুন বালিকা উচ্চ বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক ও ইউপি চেয়ারম্যান আব্দুল মালেক এবং মধ্য কুমারপুর গার্লস স্কুল অ্যান্ড কলেজের অধ্যক্ষ ও ইউপি চেয়ারম্যান সাইদুর রহমানের বিরুদ্ধে দীর্ঘদিনের অনিয়মের অভিযোগ রয়েছে। রাজারহাট ছিনাই ইউনিয়নের চেয়ারম্যান এবং কাঠালবাড়ি কলেজের সহকারী অধ্যাপক সাদেকুল ইসলাম নুরু কয়েক মাস কারাগারে থাকলেও নিয়মিত ক্লাস না নিয়েও বেতন পাচ্ছেন বলে অভিযোগ রয়েছে। তাদের অভিযোগ, এসব অনিয়মের কথা সবার জানা থাকলেও তাদের বিরুদ্ধে কোনো ব্যবস্থা নেওয়া হয়নি।
শিক্ষার সার্বিক পরিস্থিতি বিবেচনা করে জেলার শিক্ষার মান উন্নয়নে গত ২ নভেম্বর ১০ দফা নির্দেশনা দিয়েছেন জেলা শিক্ষা কর্মকর্তা মো. শফিকুল ইসলাম।
জেলা শিক্ষা কর্মকর্তা মো. শফিকুল ইসলাম বাসসকে বলেন, ‘১০ দফা নির্দেশনা মানছে না অধিকাংশ শিক্ষা প্রতিষ্ঠান। শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে নিয়মিত অ্যাসেম্বলি, রুটিন অনুযায়ী ক্লাস ও শিক্ষার্থীদের নিয়মিত উপস্থিতি সবই কাগজে-কলমে সীমাবদ্ধ।’ তিনি জেলা শিক্ষা পরিস্থিতির উন্নয়নে শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলোর ওপর নজরদারি বাড়ানো হবে বলে জানান।
শিক্ষার এই বেহাল দশা পর্যালোচনা করে আইনশৃঙ্খলা কমিটির সভায় তীব্র উদ্বেগ প্রকাশ করেছে প্রশাসনের বিভিন্ন দপ্তরের কর্মকর্তারা। গত ৯ নভেম্বর জেলা প্রশাসকের কার্যালয়ে অনুষ্ঠিত আইনশৃঙ্খলা কমিটির সভায় জেলা প্রশাসক সিফাত মেহনাজ শিক্ষার মান উন্নয়নে সংশ্লিষ্ট সবাইকে কঠোর অবস্থান নেওয়ার নির্দেশ দেন। তিনি বলেন, ‘প্রয়োজনে আকস্মিক পরিদর্শন বাড়াতে হবে। ক্লাসে উপস্থিত না হলে শিক্ষক ও শিক্ষার্থী উভয়কেই জবাবদিহি করতে হবে।’
জেলা দুর্নীতি প্রতিরোধ কমিটির সভাপতি অধ্যাপক লিয়াকত আলী বলেন,‘শিক্ষকদের বিরুদ্ধে ক্লাসে অনুপস্থিতি ও দায়িত্বহীনতার অভিযোগ আমাদের কাছে নিয়মিত আসে। শিক্ষার নিম্নমানের কারণে কুড়িগ্রামের শিক্ষার্থীরা প্রতিযোগিতায় পিছিয়ে যাচ্ছে।’ তিনি এ পরিস্থিতি পরিবর্তনে সংশ্লিষ্ট সবাইকে নিজ নিজ দায়িত্ব সঠিকভাবে পালনের আহ্বান জানান।
সৈয়দপুরের বাংলাদেশ সেনাবাহিনী বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের সম্মান শেষ বর্ষের ছাত্রী সামিয়া ইসলাম লাবণ্য বাসসকে বলেন, কুড়িগ্রামের শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলোতে বেশিরভাগ দিনে ক্লাস ঠিকমতো হয় না। অনেক শিক্ষক আসেনই না। আবার আসলেও তাড়াহুড়া করে ক্লাস শেষ করেন। একারণেই পরীক্ষায় আমরা পিছিয়ে পড়ছি। ভালো ফল করতে হলে আমাদেরও নিয়মিত পড়াশোনা দরকার। আর সেটা অনেকটাই নির্ভর করে শিক্ষকদের উপস্থিতি ও দিকনির্দেশনার ওপর। আমরা চাই শিক্ষকেরা আমাদের পাশে থাকুন। তারা আমাদের ক্লাস নিন। আমাদের সঠিক দিকনির্দেশনা দিন। ’
কুড়িগ্রাম সদরের বাসিন্দা ব্যবসায়ী আব্দুল আখের জেলার শিক্ষার মান নিয়ে উদ্বেগ প্রকাশ করে বলেন, ‘আমরা সন্তানদের ভালো শিক্ষার জন্য স্কুল-কলেজে পাঠাই। সেখানে শিক্ষকরা যদি নিয়মিত ক্লাসই না নেন, তাহলে আমাদের সন্তানরা শিখবে কীভাবে? সরকার কোটি কোটি টাকা দিচ্ছে। কিন্তু বাস্তবতা খুবই হতাশাজনক। আমরা চাই শিক্ষকরা আরও দায়িত্বশীল হোন। তিনি শিক্ষার মানোন্নয়নে প্রশাসন নজরদারি বাড়ানোর আহ্বান জানান।’
দৈনিক কালবেলার সিনিয়র সাংবাদিক সাইয়েদ আহমেদ বাবু বাসসকে বলেন, ‘জেলায় বছরের পর বছর ধরে একই সমস্যা চলছে। শিক্ষকদের অনুপস্থিতি, রাজনৈতিক ও ব্যবসায়িক কর্মকাণ্ডে জড়িত থাকা, প্রক্সি শিক্ষক দিয়ে ক্লাস নেওয়া, এমনকি জেল থেকে বেরিয়ে এসে ক্লাস না করেও বেতন তোলার ঘটনা কুড়িগ্রামের শিক্ষা পরিস্থিতির ওপর বড় ধরনের নেতিবাচক প্রভাব ফেলেছে।’
তিনি বলেন, ‘দীর্ঘদিনের অনিয়ম ও দুর্নীতি জেলার শিক্ষা ব্যবস্থাকে ভেঙে দিয়েছে। শিক্ষার্থীদের পরীক্ষার ফলাফলে সরকারের বিপুল ব্যয়ের কোনো প্রতিফলন নেই। এখন কঠোর নজরদারি ও জবাবদিহি ছাড়া শিক্ষার মানোন্নয়ন সম্ভব নয়।’