শিরোনাম

দেলোয়ার হোসাইন আকাইদ
কুমিল্লা, ২৯ অক্টোবর, ২০২৫ (বাসস) : বাংলা ও হিন্দি চলচ্চিত্রের কালজয়ী সুরকার ও কণ্ঠশিল্পী শচীন দেব বর্মনের জন্মভিটায় আগামীকাল (৩০ অক্টোবর) বৃহস্পতিবার থেকে শুরু হচ্ছে দুই দিনব্যাপী শচীন মেলা। কুমিল্লা জেলা প্রশাসনের উদ্যোগে জেলার দক্ষিণ চর্থা এলাকায় অবস্থিত বাড়িতে আয়োজিত এ মেলায় অংশ নিচ্ছেন স্থানীয় সাংস্কৃতিক কর্মী, শিল্পী, গবেষক এবং শিক্ষার্থীরা। শচীন দেব বর্মনের জন্ম ও প্রয়াণ দিবস উপলক্ষে এ মেলা আয়োজন করা হয়।
শচীন দেববর্মন ১৯০৬ সালের ১ অক্টোবর কুমিল্লার দক্ষিণ চর্থায় জন্মগ্রহণ করেন। তিনি ত্রিপুরা রাজবংশের নবদ্বীপ চন্দ্র দেব বর্মনের ঘরে জন্মগ্রহণ করেন। শৈশব থেকেই কুমিল্লার গ্রামীণ পরিবেশ, নদী ও ভাটিয়ালির সঙ্গে পরিচয় তার সংগীত জীবনের মূল ভিত্তি স্থাপন করে। ছোটবেলায় স্থানীয় শিল্পীদের সঙ্গে সময় কাটানো এবং লোকসংগীত সংগ্রহ করা শচীনের সুরের জগতে নতুন দিগন্ত খুলে দেয়।
শচীনের বাবা নবদ্বীপ চন্দ্র রাজ পরিবারের উত্তরাধিকারের বিরোধ ও রাজনৈতিক কারণে কুমিল্লায় স্থায়ী বসতি স্থাপন করেন। চার্থার দক্ষিণে ৬০ একর জমির ওপর নির্মিত প্রাসাদটি শচীনের জন্মভিটা হিসেবে পরিচিত। প্রাসাদের ভেতরে সংগীতপ্রেমী পরিবার এবং স্থানীয় শিল্পীদের সঙ্গে সংগীত চর্চার সুবাতাসে শচীনের ছোটবেলা কাটে।
তিনি কুমিল্লা জিলা স্কুল ও ভিক্টোরিয়া কলেজ থেকে প্রাথমিক শিক্ষা সম্পন্ন করে ১৯২৪ সালে কলকাতায় যান। কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ার সময় আনুষ্ঠানিক সংগীত শিক্ষার পাশাপাশি বিভিন্ন কনফারেন্সে অংশগ্রহণ করে খ্যাতি অর্জন করেন। কলকাতা বেতারে ১৯২৩ সালে প্রথম গান রেকর্ড হয় এবং ১৯৩২ সালে তাঁর প্রথম গ্রামোফোন রেকর্ড প্রকাশিত হয়। এরপর তিনি বাংলা ও হিন্দি চলচ্চিত্রে সংগীত পরিচালনায় নাম লেখান।
শচীন দেবের সংগীত জীবনের সবচেয়ে উজ্জ্বল অধ্যায় শুরু হয় ১৯৪৪ সালে, মুম্বাইয়ে স্থায়ী বসতি গড়ে। হিন্দি চলচ্চিত্রে সংগীত, পরিচালনা এবং কণ্ঠে তাঁর অমর গান আজও শ্রোতাদের হৃদয় স্পর্শ করে। ‘শিকারি’, ‘দেবদাস’, ‘সুজাতা’, ‘আরাধনা’, ‘গাইড’ প্রভৃতি কালজয়ী চলচ্চিত্রে তার সংগীত পরিচালনা বিশেষভাবে প্রশংসিত হয়েছে। লতা মঙ্গেশকর, কিশোর কুমার, গীতা দত্তসহ বহু কিংবদন্তি তার সুরে গান গেয়েছেন।
১৯৩৭ সালে শচীন দেব বর্মন মীরা দেবীকে বিয়ে করেন। তিনিও ছিলেন সুপরিচিত গায়িকা। তাদের এক সন্তান রাহুল দেব বর্মন পরবর্তীতে ভারতীয় চলচ্চিত্রে খ্যাতিমান সংগীত পরিচালক হন। শচীনের পারিবারিক বন্ধন ও পরিবারের সহায়তা তার সংগীত চর্চ্চায় অনুপ্রেরণা হিসেবে কাজ করেছে।
শচীন দেব বর্মনের জন্মভিটা পাকিস্তান আমলে দীর্ঘদিন সরকারি খামার হিসেবে ব্যবহৃত হওয়ার পর দীর্ঘদিন পরিত্যক্ত ছিল। স্বাধীন বাংলাদেশে ২০১৪ সালে জেলা প্রশাসনের উদ্যোগে বাড়ির একটি অংশ উদ্ধার করা হয়।
তবে পূর্ণাঙ্গ সংস্কার ও সাংস্কৃতিক কেন্দ্র নির্মিত হয়নি। ২০১৮ সাল থেকে স্থানীয় শিল্পীরা ‘শচীন মেলা’ আয়োজন শুরু করেন। তারপর থেকেই তাঁর জন্মবার্ষিকী ও প্রয়াণ দিবসে মেলা আয়োজনের পাশাপাশি তাঁর স্মৃতিচারণ ও সংগীত আয়োজন করা হয়।
জাতীয় জাদুঘরের প্রতিনিধি মো. সেরাজুল ইসলাম বাসসকে জানান, শচীন দেবের জন্মভিটায় একটি পূর্ণাঙ্গ জাদুঘর, সাংস্কৃতিক কমপ্লেক্স, গবেষণা কক্ষ, মুক্তমঞ্চ এবং সংগীত শিক্ষাকেন্দ্র নির্মাণের পরিকল্পনা রয়েছে। এতে দেশের শিল্পী ও পর্যটকরা শচীন দেব বর্মনের জীবন ও সংগীত জীবন সম্পর্কে বিস্তারিত জানতে পারবেন।
সামাজিক সংগঠন ‘ঐতিহ্য কুমিল্লার সভাপতি ও শচীন গবেষক মোহাম্মদ জাহাঙ্গীর আলম ইমরুল বাসসকে বলেন, উপমহাদেশের প্রখ্যাত সংগীতশিল্পী শচীন দেব বর্মণ। যিনি ‘শচীন কর্তা’ ও ‘এস. ডি. বর্মন’ নামে অধিক পরিচিত। বাংলা ও হিন্দি চলচ্চিত্রের কালজয়ী সুরের স্রষ্টা। তাঁর জন্মভিটা দীর্ঘদিন পরিত্যক্ত ছিল। তবে ২০১৪ সালে জেলা প্রশাসনের উদ্যোগে সংস্কার কাজ শুরু করা হয়। ২০১৫ সালে আনুষ্ঠানিকভাবে সংস্কার কাজ শুরু হয় এবং ঐবছরই ১৬ জুন প্রথমবারের মতো ‘শচীনের গানে গানে’ অনুষ্ঠান আয়োজন করা হয়।
২০২৪ সালে রাজনৈতিক ও প্রাকৃতিক চ্যালেঞ্জ সত্ত্বেও দুই দিনের শচীন মেলা আয়োজন করা হয়। এরই ধারাবাহিকতায় জেলা প্রশাসকের উদ্যোগে এ বছর শচীন মেলা আয়োজন করা হয়েছে।
শচীন দেববর্মনের সংগীত শুধু বাংলা ও হিন্দি চলচ্চিত্রে নয়, কুমিল্লার সংস্কৃতি ও ইতিহাসেও স্থায়ী প্রভাব ফেলেছে। তাঁর জনপ্রিয় গান ‘টাকডুম টাকডুম বাজাই, বাংলাদেশের ঢোল’, ‘তোরা কে যাস রে ভাটি গাঙ বাইয়া’ ইত্যাদি গান আজও শ্রোতাদের হৃদয় ছুঁয়ে যায়।
শচীন দেব ১৯৭৫ সালের ৩১ অক্টোবর মুম্বাইয়ে প্রয়াত হন। জন্ম ও মৃত্যু উভয়ই অক্টোবর মাসে হওয়ায় কুমিল্লার সাংস্কৃতিক অঙ্গনের জন্য অক্টোবর মাস বিশেষ তাৎপর্য বহন করে। প্রতিবছর জেলা প্রশাসনের উদ্যোগে জন্মবার্ষিকী ও প্রয়াণ দিবস উপলক্ষে শচীন মেলা অনুষ্ঠিত হয়।
স্থানীয় গবেষক আহসানুল কবীর বলেন, শচীন দেব বর্মনের বাড়ি কেবল স্থাপত্য নয়, এটি আমাদের সংগীত ইতিহাসের জীবন্ত দলিল। জন্মস্থানে তার স্মৃতি সংরক্ষণ এবং সাংস্কৃতিক কমপ্লেক্স গড়ে তোলা অত্যন্ত জরুরি। এটি আন্তর্জাতিক পর্যটন ও গবেষণা কেন্দ্র হিসেবে গড়ে উঠলে কুমিল্লা পুনরায় সংগীত ও সংস্কৃতির কেন্দ্রবিন্দুতে পরিণত হবে।
দুই দিনব্যাপী শচীন মেলায় আলোচনা সভা, শোভাযাত্রা, সাংস্কৃতিক পরিবেশনা, প্রদর্শনী, দেশীয় ঐতিহ্যবাহী স্টলসহ মোট ১৫টি স্টল রয়েছে। অনুষ্ঠান স্থলটি শচীন ভক্ত, শিল্পী ও সাংস্কৃতিক কর্মীদের মিলনমেলায় পরিণত হয়েছে।
কুমিল্লার অতিরিক্ত জেলা প্রশাসক (সার্বিক) মো. সাইফুল ইসলাম বলেন, প্রতিবছরের মতো এবারও কুমিল্লা জেলা প্রশাসনের উদ্যোগে শচীন দেববর্মনের জন্মভিটায় মেলা আয়োজন করা হয়েছে। আশা করছি, মেলার মাধ্যমে দেশের সাংস্কৃতিক ঐতিহ্য ও সুরসম্রাটের অবদান নতুন প্রজন্মের কাছে পৌঁছাবে।
শচীন দেব বর্মনের জীবন ও সংগীত চর্চা আজও কোটি মানুষের হৃদয় স্পর্শ করছে। তাঁর জন্মভিটায় জাদুঘর ও সাংস্কৃতিক কমপ্লেক্স গড়ে তোলা হলে কুমিল্লা শুধু দেশের নয়, আন্তর্জাতিক পর্যায়ে সংগীত ও সংস্কৃতির কেন্দ্রবিন্দুতে পরিণত হবে।