শিরোনাম

বিপুল ইসলাম
লালমনিরহাট, ২৯ অক্টোবর, ২০২৫ (বাসস) : মাছ বাঙালির খাদ্যতালিকার অপরিহার্য উপাদান। দেশীয় প্রজাতির মাছ যুগ যুগ ধরে বাঙালির জীবন, সংস্কৃতি ও ঐতিহ্যের সঙ্গে গভীরভাবে জড়িয়ে আছে। ‘মাছে-ভাতে বাঙালি’ প্রবাদটির মূলেই রয়েছে সেই ঐতিহ্য। কিন্তু নদ-নদী ও খাল-বিল সমৃদ্ধ লালমনিরহাট জেলায় দিন দিন কমে যাচ্ছে দেশীয় প্রজাতির মাছ।
জানা গেছে, জেলার পাঁচ উপজেলাজুড়ে তিস্তা, ধরলা, রতনাই, স্বর্ণামতী, সানিয়াজান, সাঁকোয়া, বুড়ি তিস্তা, মালদহ, গিদারী, তিরিমোহিনী, সতী, ছিনাকাটা ও ভেটেশ্বরীসহ একাধিক নদী প্রবাহিত। এছাড়া চেনাকাটা, টেংরামারীসহ বহু খাল-বিল জেলার প্রাণস্রোত হিসেবে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখছে। কিন্তু এসব নদী-নালা ও জলাশয়ে এখন দেশীয় মাছের সংখ্যা উল্লেখযোগ্যভাবে কমে গেছে।
দেশীয় প্রজাতির বিশেষ করে মাগুর, শিং, বাইন, বৈরালী, বুড়াল, বালিয়া, গজার, খলিসা, পুঁটি, কৈ, শোল, বোয়াল, সরপুঁটি, শাল, ওপর চকুয়া, চোপড়া, চান্দা, খরকাটি, চেং, টাকি, মলা, ঢেলা, চিংড়ি, টেংরা, গতা, পোয়া, কানি পাবদা, বাঘা আইড়, খৈলসা, গাং মাগুর, গুঁজি আইড়, পাবদা, রুই, কাতল, মৃগেল, চিতল, বাতাসি, বউরাণী, তারাবাইন ও কালোবাউশসহ নানা জাতের মাছের ব্যাপক চাহিদা থাকলেও এখন বাজারে এসব মাছ সহজে পাওয়া যাচ্ছে না।
জেলার বিভিন্ন বাজারে দেখা গেছে, বড় মাছ সহজে পাওয়া যায় কিন্তু ছোট দেশীয় মাছ মিলছে না। স্থানীয়দের মতে, দেশীয় মাছ বাঙালির খাবারের গুরুত্বপূর্ণ অংশ, কিন্তু এখন সেগুলো বাজারে পাওয়া যায় না বা দাম বেশি হওয়ায় সাধারণ মানুষ কিনতে পারছেন না। এ সমস্যা সমাধানে সরকারকে উদ্যোগী হওয়ার আহ্বান জানিয়েছেন তারা।
মোস্তফী মাছের আড়তে মাছ কিনতে আসা ব্যবসায়ী লিটন মিয়া, আব্দুস সালাম ও আতাউর ইসলাম বাসসকে জানান, ছোট মাছ এখন বাজারে খুব কম পাওয়া যায়। অল্প যে পরিমাণ আসে, তার দামও অনেক বেশি।
তারা অভিযোগ করেন, আগে জলাশয় ইজারা নিয়ে দেশীয় মাছ চাষ করা হতো, কিন্তু এখন অনেক ধনী ব্যবসায়ী দ্রুত লাভের আশায় হাইব্রিড মাছ চাষে ঝুঁকছেন। এতে দেশীয় মাছের প্রজনন বাধাগ্রস্ত হচ্ছে এবং অনেক জেলে জীবিকা হারাচ্ছেন।
বড়বাড়ী বাজারের মাছের আড়ত মালিক পলাশ রায় বলেন, এতো নদ-নদী ও খালবিল থাকা সত্ত্বেও এখন ছোট মাছ খুবই দুর্লভ। চাহিদা রয়েছে প্রচুর কিন্তু সরবরাহ নেই।
মাছ কিনতে আসা জাহিদ হাসান বাসসকে জানান, এখানে মাত্র এক কেজি পুঁটি ও টাকি মাছ পেয়েছি। কিন্তু বাড়ির বাচ্চারা ছোট মাছ খেতে চায়। গোশালা, পুরাতন বাসস্ট্যান্ড, চাঁদনী, মহেন্দ্রনগর ও বড়বাড়ীসহ বিভিন্ন বাজার ঘুরেও চিংড়ি, টেংরা, গতা বা পোয়া মাছ পাইনি। বিষয়টি সত্যিই হতাশাজনক।
আদিতমারীর স্বর্ণামতী নদীর পাড়ের জেলে আফজাল আলী বলেন, এক যুগ আগে নানা প্রজাতির দেশীয় মাছ পাওয়া যেত। এখন নদীতে জাল ফেললেও আগের মতো মাছ মেলে না।
একই কথা জানান ধরলা নদীর পাড়ের জেলে নজরুল ইসলাম। তিনি বলেন, সারা জীবন ধরলার মাছ ধরে সংসার চালিয়েছি। এখন মাছের অভাবে পেশা বদলের চিন্তা করছি।
জেলা মৎস্য কর্মকর্তা মো.সারোয়ার জামান বলেন, দেশীয় মাছ রক্ষায় বিভিন্ন হাট-বাজারে অভিযান চালিয়ে চায়না দুয়ারী ও কারেন্ট জাল ধ্বংস করা হচ্ছে। পাশাপাশি মাছ সংরক্ষণ ও উৎপাদন বৃদ্ধির লক্ষ্যে নানা কর্মসূচি বাস্তবায়ন চলছে।
তিনি আরও বলেন, জলাশয়ে ডিমওয়ালা মাছ অবমুক্ত করা, জনসচেতনতা বৃদ্ধি, প্রশিক্ষণ ও বিকল্প কর্মসংস্থান নিশ্চিত করা গেলে দেশীয় মাছ রক্ষা সম্ভব হবে। এছাড়া কীটনাশকের অতিরিক্ত ব্যবহার কমিয়ে সমন্বিত বালাইনাশক পদ্ধতি প্রয়োগেও ইতিবাচক ফল পাওয়া যাবে।
জেলা মৎস্য দপ্তর জানিয়েছে, দেশীয় মাছ সংরক্ষণ ও উৎপাদন বৃদ্ধির কার্যক্রম ইতোমধ্যে শুরু হয়েছে এবং তা অব্যাহত রয়েছে।