বাসস
  ০৮ অক্টোবর ২০২৫, ১১:২৪

বিপদে মানুষের ভরসা ৯৯৯

\ ওবাইদুর রহমান \

ঢাকা, ৮ অক্টোবর, ২০২৫ (বাসস) : বিপদের সময় একটি ফোন কল যা জীবন বাঁচায়, সাহস যোগায় এবং মানবিক সহায়তার হাত বাড়িয়ে দেয়। নম্বরটি হলো জাতীয় জরুরি সেবা ৯৯৯। শুধু মায়ের সন্তান প্রসব কিংবা আগুনে ঝলসে যাওয়া নয়, বরং নৈরাশ্যে থাকা মানুষকে পুলিশের সাহসী পদক্ষেপ ও মাদকবিরোধী অভিযানে উদ্ধারসহ নানা জরুরি সেবা নিশ্চিত করে ৯৯৯। এটি এখন এদেশের মানুষের জীবনের এক অপরিহার্য অংশ হয়ে উঠেছে।

গত বছর যশোরের রূপদিয়া রেলস্টেশনে এক নারী প্রসব বেদনায় কাতর হয়ে পড়েন। স্টেশন মাস্টার বাবুল আক্তার ৯৯৯-এ কল করে অবিলম্বে সহায়তা চাইলেন। সেই কল পেয়ে কোতোয়ালি থানার কনস্টেবল দ্বীন ইসলাম এবং ফায়ার সার্ভিসের দল দ্রুত ঘটনাস্থলে পৌঁছে প্রসূতি ও নবজাতককে নিরাপদে হাসপাতালে পৌঁছে দেয়। মানবিক এই সেবার উদাহরণ প্রমাণ করে, কীভাবে ৯৯৯ বিপদের মুহূর্তে মানুষের ভরসা হয়ে ওঠে।

অন্যদিকে, ঢাকা শহরের কদমতলী এলাকার বাসিন্দা রিনা বেগম জানান, মধ্যরাতে পরিচিত দুই ব্যক্তি বাসায় ঢুকে প্রথমে কথা বলার অজুহাতে অবস্থান নিয়েছিল, কিন্তু পরে তারা মাদক সেবনে লিপ্ত হয়। বাড়ির ভেতরে থাকা অবস্থায় তাদের হাতে ছুরি দেখে তিনি আতঙ্কিত হন এবং ৯৯৯-এ ফোন করেন। পুলিশের উপস্থিতি টের পেয়ে মাদকসেবীরা পালিয়ে যায়। 

জরুরি ফোন কল ৯৯৯ সম্পর্কে কীভাবে জানেন জানতে চাইলে তিনি বলেন, ঘটনার কিছু দিন আগে শুনেছিলেন বিপদে পড়ে এই নাম্বারে কল করলে পুলিশের সহযোগিতা পাওয়া যায়। যার প্রেক্ষিতে তিনি কল করেছিলেন।

ভুক্তভোগী জানান, অপরাধীরা বাসায় মাদকদ্রব্য ঢুকিয়ে তাদের ফাঁসানোর চেষ্টাও করে। পুলিশের তাৎক্ষণিক সহায়তায় অপরাধীরা পালিয়ে যায় এবং কোনো বড় ধরনের ক্ষতি হয়নি।

জাতীয় জরুরি সেবা ৯৯৯-এর পরিসংখ্যান বলছে, ২০১৭ সালে  প্রতিষ্ঠার পর থেকে চলতি বছরের ৩০ সেপ্টেম্বর  পর্যন্ত ৬ কোটি ৬০ লাখ ৩৮ হাজার ৮৪৩টি জরুরি কল করা হয়েছে এই নম্বরে। এর মধ্যে ২ কোটি ৯০ লাখ ৩৯ হাজার ২৪১টি কলে সেবা দেওয়া হয়। সেবার হার ৪৩ দশমিক ৯৭। বাকি ৩ কোটি ৬৯ লাখ ৯৯ হাজার ৬০২টি কল জরুরি সেবার বাইরে হওয়ায় কলারকে সংশ্লিষ্ট বিভাগে যোগাযোগের পরামর্শ দেওয়া হয়। 

ওই সময়ে সবচেয়ে বেশি পুলিশিং সেবা দেয়া হয়েছে। যাতে কল সংখ্যা ছিল ১৯ লাখ ৪৪ হাজার ৫১৫ টি। যা মোট কলের ৮৩ দশমিক ৫১ শতাংশ। আর সবচেয়ে কম কলের অনুরোধ এসেছিল ফায়ার সার্ভিসে ১ লাখ ৮১ হাজার ৬৭১টি। যা ৭ দশমিক ৮ শতাংশ। আর এম্বুলেন্স সেবা দেয়ার হার ৮ দশমিক ৬৮ শতাংশ যাতে কল সংখ্যা ছিল ২ লাখ ২ হাজার ২১৩ টি।

জরুরি সেবাদানকারী জাতীয় হেল্পলাইন ‘৯৯৯’-এর সার্বিক সক্ষমতা বাড়ানোর জন্য একাধিক পরিকল্পনা হাতে নেওয়া হয়েছে। বর্তমানে পূর্বাচলে অতিরিক্ত ১০০টি ওয়ার্কস্টেশন স্থাপন এবং ডেমরার আমুলিয়ায় প্রায় ৫৫২ কোটি টাকার একটি বৃহৎ ওয়ার্কস্টেশন প্রকল্পের প্রস্তাবনা রয়েছে। তবে এগুলোর অনুমোদন এখনো বিভিন্ন পর্যায়ের সরকারি যাচাই-বাছাইয়ের মধ্যে রয়েছে।

বর্তমানে ৯৯৯-এ প্রতিদিন প্রায় ২৪ হাজারের মতো কল আসে, যেখানে মাত্র ৮০ জন কল টেকার এবং ২০ জন ডিসপ্যাচার দিয়ে এই বিপুল সংখ্যক জরুরি কল পরিচালনা করা হয়, যা একটি অত্যন্ত চাপসৃষ্টিকারী বাস্তবতা।

এছাড়াও, প্রায় ৫৬ শতাংশ কল অপ্রয়োজনীয় বা বিরক্তিকর হওয়ায় প্রকৃত জরুরি কলগুলোর সেবা বিঘ্নিত হচ্ছে। কল টেকাররা নানাভাবে মানসিক চাপে পড়ছেন, বিশেষত যখন কলগুলিতে অশালীন ভাষা, গালিগালাজ বা হয়রানি থাকে।

এই সমস্যা মোকাবেলায় ৯৯৯ কর্তৃপক্ষ জনসচেতনতা বাড়াতে মিডিয়া ক্যাম্পেইন চালু করেছে এবং নতুনভাবে প্রশিক্ষিত, শিক্ষিত, তরুণ এবং পেশাদার কর্মী নিয়োগের প্রক্রিয়া শুরু করেছে। এছাড়া কমিউনিটি পুলিশিং ব্যবস্থাকে ব্যবহার করে শিক্ষা প্রতিষ্ঠান, মসজিদ ও সমাজভিত্তিক প্রচারণা চালানোর পরিকল্পনাও করা হয়েছে।

বর্তমানে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ চাহিদা ওয়ার্কস্টেশন বাড়ানো এবং প্রয়োজনীয় জনবল ও প্রযুক্তি সহায়তা পাওয়া, যাতে ৯৯৯ তার জাতীয় জরুরি সেবা আরও দক্ষভাবে দেয়া যায়।

৯৯৯-এর প্রধান ও পুলিশের অতিরিক্ত ডিআইজি মহিউল ইসলাম বাসসকে বলেন, ‘৯৯৯-এর সেবাগুলো দিন দিন জনগণের মধ্যে আস্থার জায়গা তৈরি করেছে। তবে একদিকে সেবার পরিধি বাড়ছে, অন্যদিকে আমাদের সক্ষমতা এখনো সীমিত। পূর্বাচলে ১শ’টি নতুন ওয়ার্কস্টেশন স্থাপনের প্রস্তাব এবং আমুলিয়ায় বড় পরিসরে ৫শ’ ওয়ার্কস্টেশনের একটি কেন্দ্র নির্মাণের প্রক্রিয়া চলছে যা বাস্তবায়িত হলে আমরা নাগরিকদের আরও দ্রুত, নির্ভুল ও সুরক্ষিত সেবা দিতে পারবো।

তিনি আরও বলেন, প্রতিদিন আসা ২৪ হাজার কলের মধ্যে বেশিরভাগই অপ্রয়োজনীয়। এই অপ্রয়োজনীয় কলগুলো শুধু আমাদের কলটেকারদের মানসিকভাবে বিপর্যস্ত করে তোলে না, বরং প্রকৃত জরুরি কলগুলোকে বিলম্বিত করে যা অনেক সময় জীবনের জন্য হুমকিস্বরূপ হতে পারে। আমরা এ বিষয়ে জনসচেতনতা বাড়াতে বিভিন্ন মিডিয়া ক্যাম্পেইন চালাচ্ছি। পাশাপাশি, প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত তরুণ ও শিক্ষিত কর্মী নিয়োগের মাধ্যমে কল হ্যান্ডলিং আরও পেশাদার ও সংবেদনশীলভাবে পরিচালনার চেষ্টা করছি।

জাতীয় জরুরি সেবার গণমাধ্যম ও জনসংযোগ কর্মকর্তা  আনোয়ার সাত্তার বলেন, বর্তমানে আমাদের কল গ্রহণ সক্ষমতা ৮০টি ইনকামিং লাইনে সীমিত, যেখানে প্রতিদিন অপ্রয়োজনীয় কল একটি বড় প্রতিবন্ধকতা তৈরি করছে। এই কলগুলোর কারণে সত্যিকারের বিপদগ্রস্ত ব্যক্তির সহায়তা পেতে দেরি হয়ে যায়।

সবার প্রতি অনুরোধ জানিয়ে তিনি বলেন, ‘জরুরি প্রয়োজন ছাড়া ৯৯৯-এ কল না করে প্রকৃত সেবাপ্রত্যাশীদের সহায়তার সুযোগ দিন।’