বাসস
  ২৭ সেপ্টেম্বর ২০২৫, ১৬:১১

ঝালকাঠিতে রঙ-তুলির শেষ আঁচড়ে ফুটে উঠছে দেবীর সৌন্দর্য 

রঙ-তুলির শেষ আঁচড়ে ফুটে উঠছে দেবীর সৌন্দর্য । ছবি : বাসস

আককাস সিকদার

ঝালকাঠি, ২৭ সেপ্টেম্বের, ২০২৫ (বাসস) : সনাতন ধর্মাবলম্বীদের ‎গত রোববার ২১ সেপ্টেম্বর প্রথম প্রহরে শুভ মহালয়ার মধ্য দিয়ে দুর্গাপূজার আগমনী বার্তা শুরু হয়েছে। এদিন প্রথম প্রহরে চন্ডিপাঠের মাধ্যমে দেবী পক্ষের সূচনা হয়েছে যা শেষ হবে দশমীর দিন।

বাংলাদেশের সনাতন ধর্মাবলম্বীদের সবচেয়ে বড় ধর্মীয় উৎসব শারদীয় দুর্গাপূজা। হিন্দু সম্প্রদায়ের এই পূজা মূলত দেবী দুর্গার মহিশাসুর বধ কাহিনীকে কেন্দ্র করে রচিত হয়। ধর্মীয় আচার-অনুষ্ঠানের পাশাপাশি দুর্গাপূজা এখন হিন্দু বাঙালিদের ঐতিহ্য ও সংস্কৃতির উৎসব। দেবী দুর্গাকে মা হিসেবে পূজা করা হয়, যিনি অসুর শক্তিকে দমন করে মানবজাতিকে অশুভ থেকে রক্ষা করেন। কল্পারম্ভ, বোধন, আমন্ত্রণ ও অধিবাসের মধ্য দিয়ে ষষ্ঠীতে পূজা শুরু হয় এবং বিজয়া দশমীতে প্রতিমা বিসর্জনের মাধ্যমে শেষ হয়। এ উৎসবকে ঘিরে মণ্ডপে বাজে ঢাক-ঢোল, চলে সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান, ভক্তদের আনাগোনায় মুখর হয়ে ওঠে শহর ও গ্রামাঞ্চল। পরিবারের সকলকে দেয়া হয় নতুন কাপড় চোপর। আর তাই বর্তমানে তৈরি পোষাক এবং কাপড়ের দোকানে চলছে প্রচুর- বেচাকেনা। 

‎এ বছর সনাতন পঞ্জিকা অনুযায়ী আগামী ২৮ সেপ্টেম্বর মহাষষ্ঠী দিয়ে শুরু হবে দুর্গাপূজার মূল আয়োজন। মহাপঞ্চমীতে দেবীপক্ষের আবহে বাজবে ঢাক-ঢোল, আর ২ অক্টোবর দশমীতে প্রতিমা বিসর্জনের মধ্য দিয়ে শেষ হবে এই মহোৎসব। ঝালকাঠির মণ্ডপে মণ্ডপে এখন চলছে দেবীর মুখাবয়বে রং তুলির শেষ আচড়। মৃৎ শিল্পী এবং ভাস্কররা তাদের মেধার সবটুকু ঢেলে দিয়ে প্রতিমার সৌন্দর্য ফুটিয়ে তোলার চেষ্টা করছে।

‎ঝালকাঠি জেলায় এ বছর মোট ১৬২টি মণ্ডপে দুর্গাপূজা অনুষ্ঠিত হবে। এর মধ্যে ঝালকাঠি সদর উপজেলায় ৭৫টি, নলছিটিতে ২৪টি, রাজাপুরে ১৮টি এবং কাঠালিয়ায় ৪৫টি মণ্ডপে পূজা আয়োজনের প্রস্তুতি চলছে। প্রতিটি মণ্ডপে মণ্ডপে এখন চলছে প্রতিমা নির্মাণ ও সাজসজ্জার শেষ মুহূর্তের ব্যস্ততা।

প্রতিমা নির্মাণের কারিগররা মূলত পাল বংশের মৃৎশিল্পী। তাদের আদি পেশা মাটির প্রতিমা গড়া। দুর্গাপূজাকে কেন্দ্র করে প্রতিবছর নিজ জেলা ছাড়াও খুলনা, ফরিদপুর, গোপালগঞ্জ, পিরোজপুরসহ দেশের বিভিন্ন জেলা থেকে মৃৎশিল্পীরা ঝালকাঠিতে আসেন। এই সময়টাই তাদের সবচেয়ে ব্যস্ত মৌসুম। কাদামাটি, বাঁশ, খড়, সুতলি দিয়ে কাঠামো তৈরি হয় প্রতিমার। এরপর দিনরাত এক করে তারা মূর্তির গায়ে রঙ-তুলির আঁচড়ে প্রাণ সঞ্চার করেন।

‎মৃৎশিল্পী উত্তম পাল বলেন, শিল্পীদের কাছে দুর্গা প্রতিমা তৈরি শুধু জীবিকার বিষয় নয়, এটি ভক্তির বিষয়ও। আমরা যখন দেবীর চোখ আঁকি তখন মনে হয় সত্যিই মা আমাদের সামনে উপস্থিত। অনেক কষ্টের পরিশ্রম, কিন্তু মানুষের প্রশংসা আর ভক্তদের আনন্দ দেখে সব ক্লান্তি দূর হয়ে যায়। 

আরেক ‎মৃৎশিল্পী শেখর পাল বলেন, বছরের বাকি সময়ে কাজ কম থাকে। কারও জন্য মাটির হাঁড়ি বানাই, কারও জন্য মূর্তি। তবে দুর্গাপূজার সময় এত অর্ডার পাই যে একসঙ্গে ৩-৪টা মণ্ডপে কাজ করতে হয়। প্রতিমা বানাতে রাতদিন কাজ করি, কিন্তু এর মধ্যে আনন্দও আছে।

‎শুধু প্রতিমাশিল্পী নয়, দুর্গাপূজাকে কেন্দ্র করে কর্মব্যস্ত হয়ে ওঠেন বাদ্যযন্ত্র কারিগর ও ঢাকবাদকেরাও। ঝালকাঠির সদর উপজেলার বাদ্যযন্ত্র শিল্পী শুকলাল দাস জানান, পূজার সময় তাদের সবচেয়ে বেশি ব্যস্ততা থাকে। ‎তিনি বলেন, আমরা সারা বছর ঢোল-ঢাক ঠিকঠাক করি, বিয়ে-শাদিতেও বাজাই। তবে দুর্গাপূজার সময় আমাদের আয় বেশি হয়। এক মণ্ডপ থেকে আরেক মণ্ডপে ছুটতে হয়। ভোর থেকে গভীর রাত পর্যন্ত বাজাতে হয়, কিন্তু আনন্দের মধ্যে কষ্ট ভুলে যাই। তবে যন্ত্রপাতির কারণে আমরা অনেক পিছিয়ে পড়েছি। এখন কাজ আগের মত পাইনা। সব জায়গায় এখন সাউন্ড সিস্টেম ব্যবহার করা হয়।

দেবীর সাজসজ্জা দেখতে ইতোমধ্যেই বিভিন্ন মণ্ডপে ভিড় শুরু হয়েছে। অনেকে পরিবারের সদস্যদের নিয়ে প্রতিমা দেখতে আসছেন। মণ্ডপে বাজছে শঙ্খ ও উলুধ্বনি, চলেছে আলোকসজ্জা ও সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান। বিজয়া দশমীর দিন বিভিন্ন স্থানে বসবে মেলা। 

‎ঝালকাঠি জেলা পূজা উদযাপন পরিষদের সভাপতি প্রফেসর ডা. অসীম কুমার সাহা বলেন, এ বছর জেলায় ১৬২টি মণ্ডপে পূজা অনুষ্ঠিত হবে। আমরা প্রতিটি মণ্ডপে নিরাপত্তা ও সুষ্ঠু আয়োজন নিশ্চিত করতে প্রশাসনের সঙ্গে নিয়মিত যোগাযোগ রাখছি। শিল্পীরা দিনরাত পরিশ্রম করে প্রতিমা তৈরি করছেন। আশা করছি, এ বছরও পূজা উৎসব শান্তিপূর্ণভাবে সম্পন্ন হবে।

‎ধর্মীয় এ বৃহৎ উৎসব নির্বিঘ্নে করতে প্রশাসনের পক্ষ থেকে নেওয়া হয়েছে ব্যাপক প্রস্তুতি। 

ঝালকাঠির পুলিশ সুপার উজ্জল কুমার রায় বলেন, প্রতিটি মণ্ডপে নিরাপত্তা নিশ্চিতে পুলিশ মোতায়েন করা হবে। এছাড়া আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর বিশেষ টহল থাকবে। দর্শনার্থীরা যাতে নির্ভয়ে পূজা উপভোগ করতে পারেন, সে ব্যবস্থা আমরা নিচ্ছি। তিনি আরও জানান প্রয়োজনে সেনাবািহনীর সহায়তা নেয়া হবে। 

‎ঝালকাঠির জেলা প্রশাসক আশরাফুর রহমান বলেন, দুর্গাপূজা ঘিরে আমাদের প্রশাসনের প্রস্তুতি সম্পূর্ণ। প্রস্তুতিমূলক বেশ কয়েকটি সভা করা হয়েছে ইতিমধ্যে। প্রতিটি মণ্ডপে নিরাপত্তা কমিটি গঠন করা হয়েছে। আইনশৃঙ্খলা বাহিনী সার্বক্ষণিক দায়িত্ব পালন করবে। আমরা চাচ্ছি সনাতন ধর্মাবলম্বীরা মিলেমিশে নির্বিঘ্নে এ উৎসব উদযাপন করবে।