বাসস
  ২৬ সেপ্টেম্বর ২০২৫, ১৯:৩৩

ময়মনসিংহে শারদীয় দুর্গোৎসবের শেষ সময়ের প্রস্তুতি

ছবি : বাসস

আব্দুল কাইয়ুম

ময়মনসিংহ, ২৬ সেপ্টেম্বর, ২০২৫ (বাসস) : জেলায় সনাতন ধর্মাবলম্বীদের সবচেয়ে বড় ধর্মীয় উৎসব শারদীয় দুর্গাপূজা উপলক্ষে শহর থেকে গ্রাম- সব জায়গায় চলছে শেষ মুহূর্তের প্রস্তুতি। আনন্দ, ব্যস্ততা ও উৎসবের আমেজ ছড়িয়ে পড়েছে সবখানে। প্রশাসন- পুলিশ ও জেলা পূজা উদযাপন পরিষদ এবং স্থানীয় জনপ্রতিনিধিদের সার্বিক তত্ত্বাবধানে প্রতিটি মণ্ডপে নিশ্ছিদ্র নিরাপত্তা, আলো, পানি ও স্বাস্থ্যসম্মত পরিবেশ নিশ্চিত করা হয়েছে। 

এবার জেলায় ময়মনসিংহ নগরী সহ ১৩টি উপজেলায় মোট ৭৫৯টি পূজামণ্ডপে দুর্গাপূজার আয়োজন হয়েছে, পাশাপাশি পারিবারিকভাবে আরও ২২টি ঘটপূজা অনুষ্ঠিত হবে।

সরেজমিন যায়, বেশিরভাগ মণ্ডপে শেষ হয়েছে প্রতিমা তৈরির কাজ। কিছু মণ্ডপে কারিগররা এখনও তুলির টান দিচ্ছেন, কেউ প্রতিমার মাথায় মুকুট বসাচ্ছেন, কেউ দেবীর হাতে তুলে দিচ্ছেন অস্ত্র, আবার কেউ রোদে শুকোতে দিচ্ছেন কাদামাটির গড়ন। তাদের ঘর্মাক্ত মুখেও আনন্দের ঝিলিক। যদিও এবছর উপকরণের দাম বেড়ে গেছে, পারিশ্রমিকের তেমন পরিবর্তন হয়নি, তবুও ঐতিহ্য আর ভক্তির টানে শিল্পীরা দিনরাত পরিশ্রম করে যাচ্ছেন। 

দুর্গাবাড়ীর শিল্পী রাজীব পাল জানান, খরচ বেড়েছে অনেক, মজুরি বাড়েনি, তারপরও কাজ করতে ভালো লাগে-এটি শুধু ধর্মীয় উৎসব নয়, আমাদের শেকড়ের টান। শুধু পুরুষ নয়, এবার নারীদের উদ্যোগে নগরীর শিববাড়িসহ তিনটি স্থানে পৃথক দুর্গাপূজার আয়োজনও চলছে। শতবর্ষের ইতিহাসবাহী দুর্গাবাড়ী ও নাগবাড়ী মন্দিরসহ বিভিন্ন এলাকায় আত্মীয়স্বজন, বন্ধু-বান্ধব, ছোট-বড় সবাই মিলে একসাথে পূজার আনন্দ ভাগাভাগি করছেন।

এদিকে ময়মনসিংহ শহরের অলিগলি থেকে শুরু করে বড় বড় মন্দির-মণ্ডপ, সর্বত্র আলোকসজ্জা, রঙিন সাজসজ্জা, নানান রকমের কাগজের ফুল, ঝলমলে বৈদ্যুতিক বাতি, ঢাক-উলুধ্বনিতে মুখরিত। সন্ধ্যা নামলেই প্রতিটি মণ্ডপ একেকটি আলোর উৎসবে পরিণত হয়। মণ্ডপ সজ্জায় চলছে প্রতিযোগিতা। কোথাও সাবেকি ঢঙ, কোথাও আবার আধুনিক কল্পনাশক্তি আর বৈচিত্রের ছাপ। প্রতিমা সাজানোর উপকরণ, পোশাক, গয়না সবই এখন চূড়ান্ত পর্বে। শিল্পী সাগর পাল জানান, উপকরণের দাম বেড়েছে, প্রতিমার চাহিদা বেড়েছে, কিন্তু দাম বাড়েনি, তবে এই চাহিদা এবং মানুষের আনন্দেই আমাদের শ্রম সার্থক।

অপরদিকে দুর্গাপূজাকে ঘিরে ময়মনসিংহ শহরের বিপণিবিতান, মার্কেট, শপিং মল সবখানে উপচেপড়া ভিড় দেখা যাচ্ছে। নতুন পোশাক, শাড়ি, থ্রি-পিস, জুতা, কসমেটিকস, শাঁখা-সিঁদুরসহ পূজার নানা সামগ্রী কিনতে ছুটছেন সনাতন ধর্মাবলম্বী সববয়সী নারী-পুরুষ। এবারের পূজোয় বিক্রেতারা ক্রেতা আকৃষ্ট করতে ২০ থেকে ৫০ শতাংশ পর্যন্ত ছাড় দিচ্ছেন। দেশি, টাঙ্গাইল ও ভারতীয় শাড়ির চাহিদা বেশি, মেয়েদের থ্রি-পিসও বিক্রি হচ্ছে ব্যাপক। কসমেটিকস, জুতা এবং ঘর সাজানোর জিনিসপত্রও সমানতালে বিক্রি হচ্ছে। 

ময়মনসিংহ শহরের স্টেশনরোড, গাঙিনারপাড়, নতুনবাজার, রামবাবু রোড, চরপাড়ার মার্কেটগুলোতে সকাল থেকে রাত পর্যন্ত ক্রেতার ভিড় লেগে আছে। কেউ আগেভাগে কেনাকাটা শেষ করেছেন, কেউ বা শেষমুহূর্তে আসছেন পরিবার-পরিজন নিয়ে। কেনাকাটা করতে আসা তরুণী পূজা মণ্ডল তার ভাই-বোনকে নিয়ে ঘুরে ঘুরে জামা-কাপড় কিনছিলেন। তিনি জানান, এবার নিরাপত্তা পরিস্থিতি ভালো, তাই সবাই নিশ্চিন্তে মার্কেটে আসতে পারছি।

শুধু জামা-কাপড় নয়, ছোটবাজার ও বিপণিবিতানের শাঁখা-সিঁদুর, তামা-কাঁসার তৈজসপত্রের দোকানগুলোতেও ক্রেতার উপচে পড়া ভিড়। ৩০০ টাকা থেকে শুরু করে ৬ হাজার টাকা পর্যন্ত বিভিন্ন ডিজাইনের শাঁখা বিক্রি হচ্ছে। পূজার জন্য প্লেট, গ্লাস, কুলা, প্রদীপদানি, কলস, চন্দন, শঙ্খসহ প্রয়োজনীয় সব উপকরণ কিনছেন সনাতন ধর্মাবলম্বীরা।

উৎসবের নিরাপত্তায় এবার জেলা পুলিশ, র‌্যাব, সেনাবাহিনী ও আনসার বাহিনী সমন্বয়ে নজিরবিহীন ব্যবস্থা নেওয়া হয়েছে। ময়মনসিংহের অতিরিক্ত পুলিশ সুপার (ক্রাইম এন্ড অপস) মো. আবদুল্লাহ আল-মামুন জানান, মণ্ডপগুলোকে সাধারণ, গুরুত্বপূর্ণ ও অতিগুরুত্বপূর্ণ এই তিন ক্যাটাগরিতে ভাগ করে তিন স্তরের নিরাপত্তা বলয় তৈরি করা হয়েছে। কোথাও কোন ধরণের ঝুঁকি বা হুমকির তথ্য না থাকলেও আইনশৃঙ্খলা বাহিনী সতর্ক অবস্থায় আছে। বিট পুলিশ ও স্থানীয় গণ্যমান্য ব্যক্তিদের সম্পৃক্ত করে গুজব রোধে জনসচেতনতা তৈরি করা হচ্ছে। একই সঙ্গে প্রতিটি এলাকার বিট অফিসাররা শুক্রবার জুমার নামাজে অংশগ্রহণ করে মসজিদে গিয়ে সম্প্রীতির বার্তা দিচ্ছেন এবং অপ্রীতিকর ঘটনা ঠেকাতে জনগণের সহযোগিতা চেয়েছেন। সিসিটিভি ক্যামেরা, গোয়েন্দা নজরদারি ও মোবাইল টিম প্রস্তুত রাখা হয়েছে যে কোনো পরিস্থিতি মোকাবিলায়।

শতবর্ষের ঐতিহ্য ধরে রাখা ময়মনসিংহ নগরীর দুর্গাবাড়ী, নাগবাড়ী, শিববাড়ীসহ জেলার প্রত্যন্ত গ্রামজুড়ে পূজা উপলক্ষে আত্মীয়-স্বজন, বন্ধু-বান্ধব, ভক্ত-অনুরাগীদের মিলনমেলা বসেছে। অনেকে দূর-দূরান্ত থেকে আত্মীয়ের বাড়িতে এসে এ উৎসবে অংশ নিচ্ছেন। শহরের বাইরেও গৌরীপুর, মুক্তাগাছা, ফুলবাড়িয়া, ভালুকা, তারাকান্দা, নান্দাইল, ঈশ্বরগঞ্জসহ প্রতিটি উপজেলায় মণ্ডপভিত্তিক সামাজিক যোগাযোগ, সংস্কৃতি ও সম্প্রীতির এক অনন্য আবহ বিরাজ করছে। পূজাকে কেন্দ্র করে সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান, নানা প্রতিযোগিতা, আরতি, প্রসাদ বিতরণ, সামাজিক মিলনমেলা ও ধর্মীয় সম্প্রীতির এক অপরূপ পরিবেশ গড়ে উঠেছে।

পূজা উদযাপন পরিষদ ময়মনসিংহ শাখার যুগ্ম-সম্পাদক শংকর সাহা জানান, সুষ্ঠুভাবে পূজা আয়োজনের জন্য প্রতিটি মন্ডপে নিশ্চিদ্র নিরাপত্তা ব্যবস্থা নিশ্চিত করেছে সেনাবাহিনী, পুলিশ, র‌্যাব, ও আনসার বাহিনী। অন্যান্য বছরের তুলনায় এ বছর তারা ভালোভাবে পূজা উদযাপন করছেন। 
তিনি জানান, আর পুরো জেলা জুড়ে দুর্গাপূজার উৎসব জমে উঠেছে। কোন ধরণের নিরাপত্তার ঘাটতি নেই।

র‌্যাব-১৪ এর অধিনায়ক (অতিরিক্ত ডিআইজি) নয়মুল হাসান বলেন, র‌্যাবসহ অন্যান্য আইনশৃঙ্খলা বাহিনী কাজ করছে। পূজা উপলক্ষে যেকোন ধরণের নাশকতা ও গুজব প্রতিরোধ করতে র‌্যাব কাজ করেছে। পূজা সংক্রান্ত যেকোন ধরণের সংবাদ প্রকাশের আগে স্থানীয় আইনশৃঙ্খলা বাহিনী ও পূজা কমিটির দায়িত্বশীলদের সাথে কথা বলে নিশ্চিত হওয়ার জন্য তিনি সাংবাদিকদের সহযোগিতাও কামনা করেন। 

এবারের দুর্গাপূজার মূল আনুষ্ঠানিকতা শুরু হবে ২৮ সেপ্টেম্বর মহাষষ্ঠীর মধ্য দিয়ে। ২৯ সেপ্টেম্বর মহাসপ্তমী, ৩০ সেপ্টেম্বর মহাষ্টমী, ১ অক্টোবর মহানবমী, ২ অক্টোবর বিজয়া দশমীর দিন প্রতিমা বিসর্জনের মধ্য দিয়ে শেষ হবে পাঁচ দিনব্যাপী দুর্গোৎসব। 

বর্ডার গার্ড বাংলাদেশ (বিজিবি) -এর ময়মনসিংহ ব্যাটালিয়নের (৩৯ বিজিবি) অধিনায়ক লেফটেন্যান্ট কর্নেল মেহেদী হাসান জানান, ময়মনসিংহে সনাতন ধর্মালম্বীদের শারদীয় দুর্গোৎসবে নিরাপত্তায় ১০ প্লাটুন বিজিবি মোতায়েন করা হয়েছে। এ ছাড়া ব্যাটালিয়ন দপ্তরে অতিরিক্ত আরো ২ প্লাটুন বিজিবি স্ট্যান্ডবাই থাকবে। এছাড়া সীমান্তের ৮ কিলোমিটার বিওপির মধ্যে শান্তিপূর্ণভাবে শারদীয় দুর্গোৎসব উদযাপনে বিজিবির পক্ষ থেকে সব ধরনের নিরাপত্তা জোরদার করা হয়েছে।