বাসস
  ০৪ সেপ্টেম্বর ২০২৫, ১৮:২০

এক দশক ধরে পথশিশুদের জ্ঞানের আলো ছড়াচ্ছে শুভ

ছবি : বাসস

নুসরাত সুপ্তি

নারায়ণগঞ্জ, ৪ সেপ্টেম্বর, ২০২৫ (বাসস) : ঘড়ির কাটায় বিকেল ৫ টা। একের পর এক শিশু আসছে চাষাড়া রেলওয়ে প্লাটফর্মে। খোলা আকাশের নিচে কয়েকটি বেঞ্চ। প্রতেকেই বসে পড়ে যার যার আসনে। একটু পরেই শুরু হলো, জাতীয় সঙ্গীত। কোমলমতি শিশুদের কন্ঠে‘ আমার সোনার বাংলা, আমি তোমায় ভালোবাসি’, এরপর শুরু হয় শপথ বাক্য। দৃশ্যটি চাষাঢ়া রেলওয়ে স্টেশনে গড়ে উঠা পথশিশুদের স্কুল, যার নাম ‘লাল সবুজের পতাকা শ্রী শুভ চন্দ্র প্রাথমিক শিশু বিদ্যালয়’।

স্কুলের প্রতিষ্ঠাতা শুভ চন্দ্র (২৯), যার স্বপ্ন থেকেই সৃষ্টি সুবিধা বঞ্চিত শিশুদের এই স্কুল। তিনি প্রমাণ করেছেন ইচ্ছে শক্তির চাইতে বড় কিছু হতে পারেনা। নারায়ণগঞ্জের সদর উপজেলার উত্তর চাষাড়ার বাসিন্ধা শুভ। চার ভাই-বোনের মাঝে ছোট তিনি। মাধ্যমিকের গন্ডি না পেরুলেও তিনি এখন শত শত শিশুর কাছে শুভ স্যার নামেই পরিচিত।

দরিদ্র পরিবারে বেড়ে উঠা শুভর ছোটবেলা থেকেই স্বপ্ন তিনি শিক্ষক হবেন। তার স্কুলের শিক্ষকেরা যখন শিক্ষার্থীদের জিজ্ঞেস করতো, বড় হয়ে কি হতে চায়, প্রায় সকলেই ডাক্তার, ইঞ্জিনিয়ার হওয়ার আশা ব্যক্ত করলেও শুভ বলতো, আমি শিক্ষক হবো। শিক্ষক হওয়ার স্বপ্ন নিয়ে বেড়ে উঠলেও ষষ্ঠ শ্রেণিতে পড়া অবস্থায় তার মা গুরুতর অসুস্থ হয়ে পড়েন। এরপর মায়ের চিকিৎসার খরচের জন্য থমকে যায় তার একাডেমিক পড়াশোনা। যোগ দেন, স্থানীয় একটি গার্মেন্টসে। তবে পড়াশোনার বাসনা তখনো তার মাঝে বিদ্যমান। চাকরির পাশাপাশি একজন প্রাইভেট শিক্ষকের কাছে অষ্টম শ্রেণি পর্যন্ত তিনি লেখাপড়া করেন। এরপর পারিবারিক দায়বদ্ধতায় আর পড়ালেখা করা সম্ভব হয়নি।

এরপর কয়েকটা বছর পেরিয়ে গেলেও শুভর মনে তার স্বপ্নটা সুপ্ত হয়ে থেকে যায়। চাষাড়া রেলওয়ে স্টেশনে বন্ধুদের সাথে সময় কাটাতে আসতেন। দেখতেন, স্টেশনের পাশের বস্তির শিশুরা দিনভর কাঁদায় লেপে, মাটিতে মিশে খেলাধুলা করছে। দিনেরবেলা এসব শিশুর বাবা-মা দুজনই জীবিকা নির্বাহের তাগিদে ঘরের বাহিরে থাকে। শুভ এই শিশুদের সাথে প্রায়ই কথা বলতেন। কথা বলে জানতে পারে, তাদের অধিকাংশেরই অক্ষর জ্ঞান নেই। এসব দেখে শুভর মনে তার সুপ্ত স্বপ্নটা জেগে উঠে। সুবিধাবঞ্চিত শিশুদের মাঝে শিক্ষার আলো ছড়িয়ে দেওয়ার সিদ্ধান্ত নেয় শুভ।

বস্তির শিশুদের পড়ালেখায় মনোনিবেশ করানো কাজটা সহজ ছিল না। অভাবের মাঝে তাদের পরিবারে লেখাপড়ার খরচটা ছিল বিলাসিতা। তাই নিজের স্বল্প উপার্জন দিয়েই শিশুদের কিনে দেন শিক্ষা সামগ্রী। চাকরি ছেড়ে চাষাড়া রেলস্টেশন প্লাটফর্মে একটি চায়ের দোকান দিয়েছিলেন। ২০১৬ সালে দোকানের পাশে খোলা আকাশের নিচে পাটি বিছিয়ে শুরু হয় ‘শ্রী শুভ চন্দ্র দে প্রাথমিক শিশু বিদ্যালয়’।

চায়ের দোকান বন্ধ করে বর্তমানে আসবাবপত্রের দোকানে চাকরি করেন শুভ। সেই চাকরি থেকে উপার্জিত অর্থে চলছে তার স্কুল। তিনি বলেন, চায়ের দোকানটা ছেড়ে দেওয়ার পর আসাবাবপত্র তৈরির কাজ করি। সেইখান থেকে যে টাকা পাই তার ৬০ শতাংশ এই স্কুলের শিক্ষার্থীদের জন্য খরচ করি, বাকিটা আমি আমার ব্যক্তিগত খরচের জন্য রাখি। ২০২০ সালে বাবা মারা যায়, এখন আমার ভাইদের সাথে ভাড়া বাড়িতে আছি।

স্কুলের প্রারম্ভিক সময়ে তার শিক্ষার্থী ছিল ৭০ জন। দিন দিন এই সংখ্যা আরো বাড়তে থাকে। কিন্তু রেলস্টেশনে বস্তির উচ্ছেদ শুরু হলে এই সংখ্যা কমতে শুরু করে। বর্তমানে তার স্কুলে ৩৫ জন শিক্ষার্থী পড়ালেখা করে। রোদ, বৃষ্টি উপেক্ষা করেই চলছে তার শিক্ষা কার্যক্রম। সাপ্তাহিক ছুটির দিন ব্যতীত প্রতিদিন বিকাল পাঁচটা থেকে সন্ধ্যা পর্যন্ত তার স্কুল চলমান থাকে। শুভ আরও বলেন, আমি বস্তিতে দুইটা ঘর ভাড়া নিয়েছিলাম, বাচ্চাদের পড়ানোর জন্য। তখন বাচ্চার সংখ্যা বেশি ছিল। বৃষ্টিতে নয়তো পড়ানো বন্ধ করে দিতে হতো। সেসময় দিনে একাধিকবার বাচ্চাদের পড়াতাম। বস্তি উঠিয়ে দেওয়ার পরে আবার প্লাটফর্মে পড়ানোর ব্যবস্থা করেছি। আপাতত স্কুলে একটা ছাওনি দেওয়ার চেষ্টা করছি।

প্রায় দশ বছরে শুভ দুই শতাধিক শিক্ষার্থীকে পড়িয়েছেন। আদর্শলিপি বই পড়িয়ে এসব শিক্ষার্থীদের বয়স অনুযায়ী প্রাথমিক বিদ্যালয়ে ভর্তি করিয়ে দেন শুভ চন্দ্র। প্রাথমিক স্কুলের গন্ডি অতিক্রম করলে শিক্ষার্থীদের মাধ্যমিক বিদ্যালয়েও ভর্তির ব্যবস্থা করেন। অভিভাবকেরা লেখাপড়া বন্ধ করার চেষ্টা করলে তিনি তাদের সাথে যোগাযোগ করেন, বুঝানোর চেষ্টা করেন। শুভ বলেন, এই বাচ্চাগুলোকে যেন কেউ মূর্খ না বলে আমি তাদের অন্তত এইটুকু শিক্ষা দিতে চাই।

শুভর স্কুলে পড়ে ৫ বছর বয়সী সাবিহা। তাকে স্কুলে পৌঁছে দিতে এসেছেন তার মা মমতা বেগম। তার সাথে এই স্কুলের পড়ালেখা নিয়ে আলাপচারিতার এক পর্য়ায়ে তিনি বলেন, স্যার আমাদের বাচ্চাগুলানরে পড়ায়। টাকা ছাড়াই খাতা পেন্সিল দেয়। আমরা তো পড়ালেখা পারি না। বাচ্চা পড়াইতে অনেক খরচ। আমি বাসাবাড়িতে কাজ করে সংসার চালাই, এই স্যারে অনেক সাহায্য করে আমাগো।

শুভ চন্দ্রের লক্ষ্য নিজের একটি স্কুল প্রতিষ্ঠা করা। সেখানে তিনি দরিদ্র পরিবারের সন্তানদের পড়াবেন। বিদ্যালয়ের কার্যক্রম স্থায়ীভাবে পরিচালনা করতে একটি নির্দিষ্ট স্থানের প্রয়োজন বলে জানান শুভ চন্দ্র। এ বিষয়ে সমাজের বিত্তবান ব্যক্তি ও সরকারি সহায়তার আশা ব্যক্ত করেন তিনি।

নারায়ণগঞ্জের অতিরিক্ত জেলা প্রশাসক (সার্বিক) আলমগীর হুসাইন এ বিষয়ে বলেন, সুবিধাবঞ্চিত শিশুদের শিক্ষার আলোয় আলোকিত করা একটি ভালো উদ্যোগ। শুভর এই স্কুল সম্পর্কে আমরা পূর্বে অবগত ছিলাম না। আমরা এই মহৎ উদ্যোগে তাকে জেলা প্রশাসনের পক্ষ থেকে সহায়তা করার চেষ্টা করব।