বাসস
  ৩০ আগস্ট ২০২৫, ১৫:৫২

হাইমচরের অন্যতম অর্থকরী ফসল পানের সুনাম দেশজুড়ে 

চাঁদপুর জেলার হাইমচরে ঐতিহ্যবাহী পানের আবাদ। ছবি: বাসস

\ আবদুস সালাম আজাদ জুয়েল \ 

চাঁদপুর, ৩০ আগস্ট, ২০২৫ (বাসস) : দেশীয় খাবারের ঐতিহ্যের অংশ হচ্ছে পান। বিয়ে কিংবা বড় কোনো আয়োজন পান ছাড়া যেন অপূর্ণ। চাঁদপুর জেলার হাইমচরে রয়েছে ঐতিহ্যবাহী এই পানের আবাদ। জেলার ব্র্যান্ডিং পণ্যের অন্যতম এটি। মেঘনা উপকূলীয় উপজেলা হাইমচরের অর্থকরী ফসলের মধ্যে অন্যতম হচ্ছে পান। প্রতিবছর এই উপজেলা থেকে প্রায় ৫০ কোটি টাকার পান বিক্রি হয়। 

স্থানীয় চাহিদা মিটিয়ে এই পান বিক্রি হয় আশপাশের উপজেলায়। তবে প্রাকৃতিক দুর্যোগসহ নানা রোগবালাইতে ক্ষতিগ্রস্ত কৃষকরা কখনোই সরকারের পক্ষ থেকে কোনো প্রণোদনা পাননি। তবে কৃষি বিভাগ বলছে, প্রাকৃতিক দুর্যোগসহ যে কোনো সমস্যাসংকুল অবস্থায় কৃষকের পাশে আছেন তারা। 

ভৌগোলিকভাবে হাইমচর উপজেলার বাসিন্দারা মূলত দুইভাগে বিভক্ত। মেঘনা নদীর পূর্বের পাড়ে অধিকাংশ লোকের বসবাস। আর বাকিরা মেঘনার পশ্চিমে চরাঞ্চলে বসবাস করেন। নদী উপকূলীয় লোকজন বেশিরভাগ মৎস্য আহরণ ও কৃষি কাজ করে জীবিকা নির্বাহ করেন। এর মধ্যে মহানলী, চালতা কোঠা, নল ডোগ, সাঁচি জাতের পান চাষ করে যুগ যুগ ধরে পরিবার চালাচ্ছে বহু পরিবার। বংশ পরম্পরায় এই আবাদের সাথে জড়িত আছেন অনেকে।

সম্প্রতি সরেজমিনে উপজেলার পানের বরজ ঘুরে জানা যায়, উপজেলার আবাদকৃত পানে রোগবালাই না হলে উৎপাদনে কোন সমস্যা থাকে না। শীত মৌসুম ছাড়া বাকি মৌসুমে প্রতিদিনই পানের বাজার মেলে। একসময় জেলার বাইরে শুধু লক্ষ্মীপুর জেলার রায়পুরে পান বিক্রি করতে হত। এখন উপজেলা সদরের কাছেই মহজোমপুরে পানের আড়ৎ তৈরি হয়েছে। সেখান থেকেই পানের পাইকারি বিক্রি হয়।

উপজেলার উত্তর আলগী ইউনিয়নের মহজমপুর গ্রামের ফারুক ইসলাম দেড় একর জমিতে পানের বরজ করেছেন। তার এখানে প্রতিদিন ৩ থেকে ৫ জন শ্রমিক পানের পরিচর্যা করেন। তিনি জানান, আমরা বংশপরম্পরায় এই পানের আবাদ করে আসছি। প্রাকৃতিক দুর্যোগের কারণে অনেক সময় পানের বরজ ক্ষতিগ্রস্ত হয়। তবে আবার যখন ভালো বিক্রি হয়, ভালো দাম পাই তখন লোকসান উঠে আসে। পান চাষ করে আমরা ভালো আছি। 

পানের বরজের শ্রমিক একুব আলী বাসসকে বলেন, আমরা খুব কম বয়সে এই পানের বরজের কাজ শিখেছি। পানের পরিচর্যায় আমরা সব সময় নিয়োজিত থাকি। এই কাজের বিনিময়ে যে মজুরি পাই তাই দিয়ে সংসার চলে। আমরা এখন অন্য কাজ করতে পারি না। ভালোও লাগে না। 

নয়ানী গ্রামের পান চাষি আলমগীর হোসেন বলেন, আমাদের পূর্বপুরুষরাই এই পানের বরজ রেখে গেছেন। আমার পিতার মৃত্যুর পর থেকে আমি নিজে পান আবাদ করছি। পানের মধ্যে রোগবালাই দেখা দিলে উৎপাদন কম হয় এবং বিক্রিও কমে যায়। পানে রোগ দেখা দিলে অনেক সময় শিকড়গুলোও নষ্ট হয়ে যায়। তখন আবার নতুন করে শিকড় লাগাতে হয়। আমাদের কোন প্রশিক্ষণ নেই। এলাকার বয়োজ্যেষ্ঠদের দেখেই পানের আবাদ শিখেছি। এখনও আবাদ করছি। তবে কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের কর্মকর্তারা মাঝেমধ্যে পরামর্শ দেন। 

উত্তর আলগী গ্রামের বাসিন্দা পান ব্যাপারী নবির হোসেন। কয়েক দশক ধরে তিনি এই পানের ব্যবসায় জড়িত। তিনি বলেন, আমি হাইমচরের পান বরজের মালিকদের কাছ থেকে পান পাইকারিতে কিনে  জেলা সদরের বাবুরহাট, মহামায়া, চান্দ্রা বাজার ও আশপাশের এলাকার বাজারে বিক্রি করি। পান বিক্রির সাথে জড়িত আছে আরো শতাধিক খুচরা ব্যাপারী। তারা পাশের জেলা লক্ষ্মীপুর, শরিয়তপুর, কুমিল্লা, নোয়াখালী ও ফেনীতে নিয়েও পান বিক্রি করেন। 

হাইমচরের পার্শ্ববর্তী ফরিদগঞ্জ উপজেলার কামতা গ্রামের প্রবীণ ব্যক্তি চেরাগ আলী ৪ দশক ধরে পান ব্যবসায় জড়িত। বাসসের সাথে আলাপকালে তিনি বলেন, প্রতি শুক্রবার ও মঙ্গলবার আমি কামতা, মুন্সিরহাট, লক্ষ্মীপুর গ্রামে পান বিক্রি করি। হাইমচর থেকে অর্ধ লাখ টাকার পান ক্রয় করি। প্রয়োজন হলে অতিরিক্ত কিনতে হয়। এই ব্যবসার উপর নির্ভর করে আমার সংসার চলে। পরিবার পরিজন নিয়ে আমি আলহামদুলিল্লাহ ভালো আছি। 

হাইমচর উপজেলা কৃষি কর্মকর্তা মো. শাকিল খন্দকার  জানান, এই বছর হাইমচর উপজেলায় ২৩৫ হেক্টর জমিতে পানের আবাদ হয়েছে। ছোট বড় পানের বরজ রয়েছে ১ হাজার ৭২টি। প্রতিবছর পান বিক্রি হয় প্রায় ৫০ থেকে ৫২ কোটি টাকা। প্রাকৃতিক দুর্যোগ কিংবা রোগবালাই দেখা দিলে কৃষকদের পাশে থেকে পরামর্শ দেওয়া হয়। তবে ক্ষতিগ্রস্ত কৃষকদের জন্য প্রণোদনার বিষয়ে আমরা ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষকে অবগত করি। এই পান জেলার একটি ঐতিহ্যের সাথে জড়িত হয়ে আছে। এখানে কয়েক হাজার মানুষ এই কাজে জড়িত থেকে জীবিকা নির্বাহ করেন।